দীর্ঘ ৩১ দিন পর শেষ হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। আবার এক বছর পর আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বসবে লেখক-পাঠক-প্রকাশকের এই প্রাণের মেলা। তবে সেই মেলা কোথায় অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েই গেল। গতকাল শনিবার বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে দুই ধরনের বক্তব্য।
বইমেলার জন্য স্থায়ী অবকাঠামোর কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। অন্যদিকে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সদ্য নিযুক্ত সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান জানান, আগামী দিনেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বইমেলা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন তিনি।
লেখক, পাঠককুল ছাড়াও মেলা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত প্রকাশকরা জোরের সঙ্গেই দাবি করে আসছেন মেলার চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে, তা বর্তমানের স্থানেই রাখতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজন ছাড়াও বইমেলাকে স্থানান্তরের তৎপরতার পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী মহলের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
অধিবর্ষ (লিপইয়ার) হওয়ায় এবার ফেব্রুয়ারি মাস ছিল ২৯ দিনের। মাসের শেষ দিনটি পড়ে বৃহস্পতিবার। এ কারণে শুরুর দিকে প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলে প্রকাশকরা পরের দুটি ছুটির মেলা বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন। কর্তৃপক্ষ তা মেনে নেয়।
তবে সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও বাড়তি দুটি দিনে মেলায় জনউপস্থিতি ছিল বেশ কম। এর পেছনে বেইলি রোডের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ধাক্কার কথা বলেছেন অনেকেই। আবার ফেব্রুয়ারি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলার আমেজ শেষ হওয়ার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে অবশ্য এবারের বইমেলায় শুরু থেকেই বেশ ভিড় ছিল। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মেট্রো রেলের সুবাদে দূরের পাঠক-ক্রেতারা এবার বড় সংখ্যায় মেলায় এসেছে।
মেট্রোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনটি মেলার দ্বারেই। তবে অনেক প্রকাশকই বলেছেন, ভিড়ের তুলনায় বিক্রি খুব একটা বাড়েনি এবার। এ জন্য অর্থনৈতিক টানাপড়েন এবং সাধারণভাবে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন অনেকে।
২০০৬ সালের পর থেকে ব্যবস্থাপনার জন্য মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিত। এবার ব্যবস্থাপনার যাবতীয় দায়িত্ব একাডেমির নিজের হাতেই ছিল। মেলার ব্যবস্থাপনা নিয়ে এবার বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। স্টলগুলোর সামনে ফাঁকা জায়গা ছিল খুব কম। ছুটির দিনগুলোতে গাদাগাদি ভিড়ে অসুবিধা হয়েছে দেখেশুনে বই কেনায়। ধুলা উড়েছে অনেক। মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা না থাকায় বিশেষ করে বয়স্করা ক্ষোভ জানিয়েছেন।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তাদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা জানান, মেলায় ৬০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বই বিক্রি হয়েছে। গত বছর বিক্রি ছিল প্রায় ৪৭ কোটি টাকা।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কবি কামাল চৌধুরী স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বইমেলাটা শুরু হয়েছিল ছোট্ট একটি জায়গায়। তখন আমরা দীর্ঘ আড্ডা দিতাম। এখানে একুশের দিনে কবিতা পড়া দারুণ আনন্দের ছিল।’
সম্মানিত অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান বলেন, ‘বইমেলা নিজেই একটি ঐতিহ্য। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব আগামী দিনেও এখানেই (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বইমেলা করার।’
জমা পড়া মোট বই ৩৭০০
গতকাল বইমেলার শেষ দিনেও একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই এসেছে ১৪৯টি। এ নিয়ে জমা পড়া বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৫১টি, যা গত বছর ছিল প্রায় এক সমান—তিন হাজার ৭৩০টি।
নতুন আসা বইয়ের মধ্যে ছিল পাঠক সমাবেশ থেকে সৈয়দ আকরম হোসেনের ‘বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ঘাসফুল থেকে ফয়েজ আলমের গবেষণামূলক বই ‘বাঙালির ইতিহাসচর্চার পথের কাঁটা’, বাতিঘর থেকে আলতাফ পারভেজের ‘সোহরাওয়ার্দী ও বাংলায় মুসলমানের রাষ্ট্র সাধনা’, প্রথমা থেকে ফরহাদ খানের শব্দের অর্থ ও নেপথ্য কারণ নিয়ে অভিধানমূলক বই ‘শব্দের গল্প’।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান
বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি পরিচালিত চারটি পুরস্কারের বিজয়ীদের মধ্যে গতকাল তা তুলে দেওয়া হয়৷ ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশের জন্য চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছে কথাপ্রকাশ, মনজুর আহমদ রচিত ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ : শিক্ষার রূপান্তর’ গ্রন্থের জন্য গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের পুরস্কার পেয়েছে প্রথমা প্রকাশন। মঈন আহমেদ রচিত ‘যাত্রাতিহাস : বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত ‘কিলো ফ্লাইট’ গ্রন্থের জন্য জার্নিম্যান বুকস পেয়েছে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার। ২০২৩ সালে গুণমান বিচারে সর্বাধিক সংখ্যক শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খি পেয়েছে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার।
এবারের বইমেলায় স্টলের নান্দনিক সজ্জার জন্য সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেঙ্গল বুকস, নিমফিয়া পাবলিকেশন ও অন্যপ্রকাশ পায় কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার।