<p style="text-align:justify">কথা ছিল কারখানা স্থাপন ও ব্যবসার প্রক্রিয়া সহজ করতে বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগসুবিধা দেবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এজন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের প্রকল্পটি হাতে নেয় সংস্থাটি। এ কাজের জন্য ২০১০ সালে বিশেষ আইন করে বেজার যাত্রা শুরু হয়। কারখানা স্থাপন ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য ভূমি পাওয়া, নামজারি, পরিবেশ ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি-সংযোগসহ ১২৫ ধরনের সেবা ওয়ানস্টপ সার্ভিসের আওতায় দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ২০ ধরনের সেবাও পাওয়া যায় না। বরং এসব সেবা পেতে এখনো পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় বিনিয়োগকারীদের। ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগ করলে কর ছাড়ের কথা থাকলেও উল্টো অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চলের চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ভ্যাট আইন হয়েছে। ভ্যাট আইনটি সাধারণ অন্যান্য আইন ও চুক্তির ঊর্ধ্বে। ফলে চুক্তির পর উদ্যোক্তাদের জমির ওপর ভ্যাট আরোপ হয়েছে। ইজারা নেওয়া জমির মূল্যের ওপর বাড়তি ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে বিনিয়োগকারীদের বাধ্য করা হচ্ছে যদিও ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই অপারগতা প্রকাশ করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার যৌক্তিকতা নেই। এই লক্ষ্য থেকে সরে আসছে সরকার। বিদ্যুৎ, গ্যাস, অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংখ্যা পাঁচ অথবা দশটি হবে। কবে নাগাদ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবকাঠামো নিশ্চিত করা হবে তারও একটি টাইমলাইন দেওয়া হবে।</p> <p style="text-align:justify">জানা গেছে, ২০১০ সালে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এর ১৫ বছর পর এখন পর্যন্ত বাস্তবে কতটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এর প্রায় ৫ বছর পর ২০১৫ সালে সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু করে বেজা। সরকারের সেই মহাপরিকল্পনা এক দশক পর কাজ এগিয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। অথচ ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ডেকে আনা হয় এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে। কারখানা স্থাপনের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগের পর বছরের পর বছর বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগ না পেয়ে অনেক বিনিয়োগকারীই হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই আগ্রহ নিয়ে এসে আবার ফিরেও গেছেন। আর দেশীয় বিনিয়োগকারীরা কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করে ভ্যাট আইনের জটিলতায় পড়েছেন এবং কাক্সিক্ষত সেবা না পাওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনে যেতে পারছে না। যার ফলে কারখানা চালুর আগেই লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেক শিল্পোদ্যোক্তাই।</p> <p style="text-align:justify">জানা গেছে, গত এক দশকে মোট ৯৭টি ইকোনমিক জোনের অনুমোদন দিয়েছে বেজা বোর্ড। এর মধ্যে ৬৮টি গড়ে তুলবে সরকার এবং ২৯টি গড়ে তুলবে বেসরকারি খাত। এগুলো গড়ে তোলার প্রাথমিক সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০৩০ সাল। তবে, সেই সময়সীমা পরে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, এত বেশি সংখ্যক প্রকল্প সম্পাদন করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। এখানে বেশি সময় লাগা খুব সাধারণ বিষয়, কারণ জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ।</p> <p style="text-align:justify">প্রসঙ্গত, দেশের দশটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে দুটি সরকার পরিচালনা করে, যথাক্রমে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর (বিএসএমএসএন), সিলেটের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাকি আটটি বেসরকারি খাত পরিচালনা করে আসছে। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো হলো- সিটি ইকোনমিক জোন, মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন, মেঘনা ইকোনমিক জোন, হোসেন্দি ইকোনমিক জোন, আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোন, বে ইকোনমিক জোন, আমান ইকোনমিক জোন এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইকোনমিক জোন। বেজার নথি অনুযায়ী, সরকার পরিচালিত দুই ইকোনমিক জোনে ইতোমধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করছে। এর মধ্যে বিএসএমএসএনে ১১টি কারখানা এবং শ্রীহট্টায় দুটি কারখান স্থাপন করা হয়েছে। জানা গেছে, গত এক দশকে প্রায় ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬৮টি গড়ে তোলার কথা সরকারের এবং ২৯টি গড়ে তুলবে বেসরকারি খাত। এগুলো গড়ে তোলার প্রাথমিক সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০৪১ সাল। তবে গত এক দশকে মাত্র ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা গেছে। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব অঞ্চলগুলোর ভাগ্য সুতোয় ঝুলছে।</p> <p style="text-align:justify">সিপিডির ওই অনুষ্ঠানে সম্প্রতি আশিক চৌধুরী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পাঁচটি বিষয় উন্নয়নের চেষ্টা করছি। প্রথমেই আমরা সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা করছি। সেখানে ব্যবসায়ীদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। বিডা, বেজা বেপজা, হাইটেক পার্ক সবকিছুকে একীভূত করার চেষ্টা করছি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলছি; তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রয়োজনে বিজনেস রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন গঠন করা হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা সরকারের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনছি। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।</p> <p style="text-align:justify">ফিকি সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আনলে দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে হবে। বিদেশে বিনিয়োগ এলে শুধু অর্থ নয়, সেখানে জ্ঞান, প্রযুক্তি আসে। এই জ্ঞান, প্রযুক্তি সুরক্ষায় নীতিমালা প্রয়োজন। সুরক্ষা দিতে না পারলে বিনিয়োগ আসব না। বছর শেষে কর হারের পরিবর্তন হয়, এটা কোথাও হয় না। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বিনিয়োগকারীদের প্লট দেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের উচিত স্থাপনাগুলোর উন্নয়ন করা। অন্যথায় বিনিয়োগকারীরা সেখানে গেলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন, যেসব জোনে বিনিয়োগকারীরা প্লট পেয়েছেন তারা এখনো ইউটিলিটি সংযোগ পাননি এবং নিজেরাই পানি সরবরাহ নিশ্চিত করছেন। এদিকে পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ আরেকটি অনুষ্ঠানে বলেন, করবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হলে বিনিয়োগ বাড়বে। গবেষণায় দেখা গেছে, কর হার ১ শতাংশ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ সাড়ে ৩ শতাংশ কমে। আবার করভার ২০ শতাংশ কমালে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ১৪ গুণ এবং রাজস্ব আয় ছয় গুণের বেশি বাড়ে। তাই শুল্ক-কর খাতে সংস্কার প্রয়োজন। নেস্লে বাংলাদেশের হেড অব লিগ্যাল দেবব্রত রায় চৌধুরী বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা ২৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করলাম। তখনকার করহার দেখেই বিনিয়োগ পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু দুই বছর পর করহার পরিবর্তন হওয়ায় আমাদের পরবর্তী বিনিয়োগ বাদ দিতে হয়েছে। এতে কর্মসংস্থান ও রাজস্বে ক্ষতি হয়েছে।’</p>