<p style="text-align:justify">কালিয়াকৈরে একসময় মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল গাজীপুরের তৎকালীন এসপি হারুন অর রশীদ। টাকার জন্য ব্যক্তিগত বাহিনী দিয়ে এলাকার প্রভাবশালীদের ধরে নিয়ে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে না পারলে জোর করে লিখে নেওয়া হতো জমি। অনেকে কিস্তিতে টাকা দিয়ে বাঁচিয়েছেন জীবন।</p> <p style="text-align:justify">হারুনের এসব কাজে সহযোগিতা করতেন গুলিতে নিহত বনখেকো মুচি জসিম। হারুনের নির্দেশে মুচি জসিম ডিবি পুলিশ দিয়ে এলাকার প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে বিপুল টাকা দাবি করতেন। দিতে না পারলে সারা রাত নির্যাতন চালিয়ে ভোররাতে নিয়ে যাওয়া হতো ডিবি হারুনের গাজীপুর কার্যালয়ে। সেখানে দ্বিতীয় দফায় চালানো হতো নির্যাতন।</p> <p style="text-align:justify">উপায় না পেয়ে জীবন বাঁচাতে ভুক্তভোগীরা গরু-ছাগল, পরিবারের সদস্যদের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে তাঁদের টাকা দিতেন। টাকা দিতে না পারলে জমি লিখে নিতেন হারুনের লোকজন। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কালিয়াকৈর উপজেলার অনেক ব্যবসায়ী কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই সময় কেউ ভয়ে হারুনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস না পেলেও বর্তমানে অনেকে মুখ খুলছেন। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে তাঁদের টাকা বা জমি ফেরত পেতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।</p> <p style="text-align:justify">তথ্য মতে, ২০১৭ সালে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ। যোগদানের কয়েক মাস পর থেকে একসময়ের কারখানার পিয়ন মুচি জসিম এসপি হারুনের দাপট দেখাতে শুরু করেন। এসপি হারুনের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় শুরু হয় তাঁর আধিপত্য। হারুনের নির্দেশে গড়ে তোলেন জসিম বাহিনী।</p> <p style="text-align:justify">বন কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চান্দরা জোড়া পাম্প এলাকায় পাঁচ শতাধিক বাড়ি নির্মাণ করে জসিম হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এর বড় অংশ দেওয়া হতো এসপি হারুনকে। একসময় চান্দরা জোড়া পাম্প এলাকায় মুচি জমিসের আস্তানায় প্রতি রাতে হারুনের ডিবি পুলিশ হাজির হতো। ওই ডিবি পুলিশ ও জসিমের বাহিনী রাতে মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে টার্গেট করা ব্যাক্তিকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারের লোকজনকে ফোন করিয়ে টাকা নিয়ে আসার জন্য বলত। ওই টাকার পরিমাণ থাকত ৫০ লাখ থেকে এক কোটি। এসব করা হতো হারুনের সঙ্গে যোগসাজশে। চাহিদামতো টাকা দিতে না পারলে চলত নির্যাতন।</p> <p style="text-align:justify">কালিয়াকৈর যুবলীগ নেতা রফিক হত্যাকাণ্ডের পর ডিবি পুলিশের অত্যাচারে কালিয়াকৈরের সফিপুর, চন্দ্রা, পল্লী বিদ্যুৎ, হরিণহাটি, কালিয়াকৈর বাজারসহ আশপাশের এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। রফিক হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে শতাধিক লোককে আটক করে ডিবি পুলিশ হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। রফিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এসপি হারুন কালিয়াকৈরের প্রভাবশালীদের মামলার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। হত্যাকাণ্ডের ওই ঘটনায় হারুনের দোসররা হাতিয়ে নিয়েছেন ৫০ কোটি টাকার বেশি।</p> <p style="text-align:justify">এসপি হারুন গাজীপুর থেকে বদলি হওয়ার কয়েক দিন পর মুচি জসিমের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় বনের ভেতর। এরপর মুচি জসিমের দখল করা বাড়িঘর ও বনের জমিতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা পাঁচ শতাধিক বাড়ি উচ্ছেদ করা হয়। তবে হারুনের অন্য দোসররা এখনো এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">ভুক্তভোগী সফিপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মাহমুদ সরকার এসপি হারুনকে দেওয়া টাকা ও জমি ফেরত চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি জানান, ২০১৮ সালের ১৬ মে সন্ধ্যা ৭টার সময় তাঁর নিজ মার্কেটের সামনে থেকে তৎকালীন গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে সাত-আটজন ডিবি পুলিশ তাঁকে চোখ বেঁধে একটি হায়েস গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।</p> <p style="text-align:justify">এরপর জঙ্গলে নিয়ে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এক পর্যায়ে তাঁরা বলেন, এসপি হারুনের নির্দেশ তাঁদের এক কোটি টাকা দিতে হবে। তা না হলে তাঁকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি টাকা দিতে এক দিন সময় চান। পরের দিন ধারদেনা করে ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা দিতে সময় চাওয়া হলে আবারও শুরু হয় নির্যাতন। পরে সফিপুর বাজারে তাঁর ৪ শতাংশ জমি হারুনের নামে লিখে দিতে ২১ মে তাঁকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হারুনের ক্যাশিয়ার মুচি জসিম রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে যান।</p> <p style="text-align:justify">জমিটি মেয়ের নামে হওয়ায় তাঁর সঙ্গে মেয়েকেও নিয়ে যাওয়া হয়। পরে এসপি হারুনের লোক ইলিয়াসের নামে ওই জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। হারুন বদলি হলে তাঁর দোসর মুচি জসিম ক্রসফায়ারে নিহত হন। এরপর টাকা ও জমি ফেরত চেয়ে এবং নির্যাতনের বিচার চেয়ে গাজীপুরের পুলিশ সুপার সামছুন্নাহার বরাবর একটি অভিযোগ করা হয়, বর্তমানে যা তদন্তাধীন।</p> <p style="text-align:justify">আরেক ভুক্তভোগী সফিপুর বাজারের ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন বলেন, ‘এসপি হারুন তাঁর ডিবি বাহিনী দিয়ে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে চার দিন অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পরে এক কোটি টাকা দিলে মুক্তি দেওয়া হবে বলে জানায়। আমার এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছয় লাখ টাকা নগদ এবং ছয় লাখ টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করি।</p> <p style="text-align:justify">আমার ভাইয়ের কাছ থেকে এসব টাকা নেয় হারুনের ক্যাশিয়ার মুচি জসিম। এসপি হারুনের ভয়ে এত দিন কিছু বলতে পারিনি। আমার মতো কালিয়াকৈরের অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হতো কোটি কোটি টাকা। আমি হারুনের বিচার চাই। ফেরত চাই আমার টাকা।’</p> <p style="text-align:justify">ভুক্তভোগী আলেয়া বেগম বলেন, ‘এসপি হারুনের নির্দেশে তাঁর দোসর মুচি জসিম ও ডিবি পুলিশ বাড়ি থেকে আমাকে তুলে নেয় গাজীপুরে ডিবি কার্যালয়ে। সেখানে আমার কাছে এক কোটি টাকা দাবি করে তারা। ৫০ লাখ টাকা না দিলে আমাকে মামলায় ফাঁসানো হবে বলে জানায়। পরে আমি রাজি না হলে আমার ওপর চালায় নির্যাতন।</p> <p style="text-align:justify">এরপর একটি এনজিও থেকে ১০ লাখ টাকা উঠিয়ে মুচি জসিমের কাছে দিই। সেই টাকার কিস্তি দুই বছরে পরিশোধ করিনি। আমার নামে দেওয়া হয় পাঁচটি মিথ্যা মামলা। পরে হারুনের নির্দেশে মুচি জসিম হরিণহাটি এলাকায় আমার একটি বাড়ি জোর করে লিখে নিয়ে বেদখল করে। ওই বাড়িটির বর্তমান মূল্য দুই কোটি টাকার ওপরে।’ </p> <p style="text-align:justify">ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হারুন ও তাঁর দোসরদের শাস্তি এবং জোর করে নেওয়া টাকা ও জমি ফেরতের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা দ্রুত হারুনকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানায়। </p>