দেশের বাজারে তাজা মাছের জন্য বিখ্যাত রাজশাহী। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে রুই, কাতল, মৃগেল ও কার্প জাতীয় যেসব তাজা মাছ বিক্রি হয়, তার বেশির ভাগই যায় রাজশাহী থেকে। ট্রাকে করে বিশেষ কায়দায় এসব মাছ পুকুর থেকে সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন আড়তে পাঠান রাজশাহীর চাষিরা। এরপর আড়ত থেকে সেই মাছ কিনে খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন।
পুকুরে মাছ চাষ করে এভাবে বাজারজাত করে রাজশাহীর শত শত বেকার যুবক এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন। অনেকে হয়েছেন কোটিপতি। তবে এ বছর অনেক ব্যবসায়ীর মাথায় হাত পড়েছে মাছের অজানা এক ভাইরাসের কারণে। বেশির ভাগ পুকুরে শীতের পরে মাছ ধরার জন্য বা দেখার জন্য জাল ফেললেই মাছ মরতে শুরু করেছে।
আর সেই মরা যেন থামানো যাচ্ছে না।
কৃষকরা জানান, চুন, লবণসহ একের পর এক জীবাণুনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও নানা ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করেও মাছ মরা রোধ করা যাচ্ছে না। সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যেই পুকুরের লাখ লাখ টাকার মাছ মরে যাচ্ছে। সকালে পচা মাছ ভেসে উঠছে।
এতে রাজশাহীর শত শত মাছ চাষির মাথায় হাত পড়েছে। অনেক চাষি বেকায়দায় পড়েছেন। কিন্তু মৎস্য অধিদপ্তর এখনো এসব নিয়ে কোনো কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন মাছ চাষিরা।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের বর্ধনপুর বিলে মাছ চাষ করেন আব্দুল মান্নান। তিনি জানান, এবার শীত মৌসুমের পরে মাসখানেক আগে তাঁর একটি পুকুরে মাছ ধরার জন্য জাল ফেলেন।
দুই ট্রাক মাছ ধরার চার-পাঁচ দিন পর থেকে ওই পুকুরে মাছ মরে সকালে ভাসতে শুরু করে। প্রথম কয়েক দিন পাঁচ-সাতটি করে মাছ মরছিল। কয়েক দিনের মাথায় সেটি প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০টি করে বাড়তে শুরু করে। মাছ মরা রোধে চুন-লবণ, ভিটামিন সি ছিটানোসহ একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ও বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করেও কোনো লাভ হয়নি।
কয়েক দিনের মাথায় পুকুরের অন্তত অর্ধেক মাছ মরে যায়। বাধ্য হয়ে আবারও জাল দিয়ে সব মাছ তুলে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। তবে এর আগে অন্তত তিন লাখ টাকার মাছ তাঁর পুকুর থেকে মরে পচে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি।
দুর্গাপুরের মাড়িয়া বিলে মাছ চাষ করেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনিও দাবি করেন, এবার শীতের পরে তাঁর পুকুরে জাল ফেলার পর থেকে শত শত মাছ মরে গেছে। নানা ধরনের পরিচর্যা করেও মাছ মরা থামাতে পারেননি তিনি। বিভিন্ন ধরনের ওষুধ কিনতেই তাঁর প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর পরও কমপক্ষে চার লাখ টাকার মাছ মরে গেছে। এতে অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এমনিতেই মাছ চাষে খরচ বেড়েছে। এর ওপর হঠাৎ করে এ বছর মাছ মরে যাওয়ায় অনেকটা ক্ষতির মুখে পড়েছি। পুকুরে জাল দেওয়ার পর এবার যেভাবে মাছ মরেছে, এর আগে কখনো এভাবে মাছ মরতে দেখিনি। কী ভাইরাস ধরছে কেউ বলতেও পারছে না। কিন্তু মাছ মরা থামানো যাচ্ছে না। এখনো দু-একটি করে মরছেই।’
গোদাগাড়ীর কমলাপুর বিলের মাছ চাষি মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘এবার শীতের পরে পুকুরে জাল দিয়ে আমার অন্তত দুই লাখ টাকার মাছ গেছে। এভাবে আমাদের বিলে অন্তত ৪০টি পুকুরে মাছ মরেছে। এখনো মরছে। কিন্তু মৎস্য অফিস থেকে কোনো কার্যকর ভূমিকা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
চাষিরা বিভিন্ন কম্পানির মাছের চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের পরামর্শ মতে অথবা নিজেই নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে মাছ মরা রোধে পরিচর্যা করছেন। এর পরও আমাদের বিলেই এখন পর্যন্ত অন্তত অর্ধকোটি টাকার মাছ মরে গেছে অজানা ভাইরাসে। এতে আমাদের যেন মাথায় হাত পড়েছে। অনেক চাষি আর্থিক সংকটের কারণে পুকুরে এখন নতুন করে মাছের পোনাও দিতে পারছেন না।’
মোহনপুরের মাছ চাষি লিটন সরকার বলেন, ‘শীতের পরেই সাধারণত আমরা পুরনো মাছ ধরে নতুন করে পুকুরে মাছ সেট করি। আবার অনেক পুকুরে শুধু মাছ দেখার জন্যও জাল দেই। এবারও তাই করেছি। কিন্তু শীতের পরে এবার জাল দিলেই বেশির ভাগ পুকুরের মাছে ভাইরাস ধরছে। মাছের পেটের নিচে বা শরীরে লাল দাগ দেখা দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো মাছের নাভি ফুলে থাকছে। মাছ মরতে শুরু করলে কোনো কিছুতেই লাভ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে চাষিরা পুরনো মাছ সব বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
রাজশাহীর মাছ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এভাবে জেলার বাগমারা, পবা, তানোর, পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘায়ও শত শত পুকুরের মাছ মরে গেছে অজানা ভাইরাসে।
তবে ভাইরাসে মাছ মরার কোনো খবর রাজশাহীর মৎস্য অধিদপ্তরে নেই বলে জানিয়েছেন সদ্য অবসরে যাওয়া বিভাগীয় উপপরিচালক আব্দুল ওহাব। গত ২৭ মার্চ তিনি অবসরে যান। কিন্তু এখন খরার কারণে পুকুরগুলোতে পানির অভাব দেখা দেওয়ায় অক্সিজেনসংকটের কারণে মাছ মরতে পারে বলে তিনি দাবি করেন। এর জন্য পুকুরে পানিসেচের ব্যবস্থাও করতে বলেন তিনি।