<p>ব্রিটিশ শাসকদের রেখে যাওয়া শোষণ আর নিপীড়নের চিহ্ন আজও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বাংলার মানুষের প্রতি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বর্বর অত্যাচারের মাত্রা তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার বাস্তব চিত্র তাদের স্থাপনা। ব্রিটিশ ইতিহাসের এমনই এক সাক্ষী ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খালিশপুর নীলকুঠি। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অভিশপ্ত এই নীলকুঠিটি। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি সংস্কারের অভাবে বর্তমানে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে।</p> <p>জানা যায়, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যে এদেশে ইংরেজ শাসনের পত্তন হয়। ভাগ্য বদলের জন্য শত শত ব্রিটিশ সাহেব এদেশে চলে আসে। তাদের একটা বড় অংশ নীলের ব্যবসায়ের নামে। সেসময় ব্রিটিশ সাহেবরা ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খালিশপুর গ্রামের কপোতাক্ষ নদের পাড়ে একটি কুঠি স্থাপন করে।</p> <p>১৪ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করে কুঠি বাড়িটি। দালানটি আঠারো শতকে নির্মিত হয়েছিল অনেকেরই এমনটিই ধারণা তাঁদের। এ কুঠি বাড়িটি নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার কৃষকদের নীল চাষে উৎসাহী করা। ব্রিটিশ সাহেব মিস্টার ডেভরেল এ কুঠি থেকে এই অঞ্চলের নীল চাষ পরিচালনা করতো। এই কুঠির কয়েকটি কক্ষে চাষীদের নির্যাতন করা হতো।</p> <p>পরবর্তীতে ব্রিটিশরা উপ-মহাদেশে থেকে বিতাড়িত হলে ও কুঠিবাড়িটি সিও স্থানীয়রা জানায়, কুঠির নিচ তলায় ছিল নীল চাষের খাজনা আদায় ও চাষীদের নির্যাতন কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় খাজনা আদায়কারীরা রাত যাপন করতেন। এখানে ১৮১০-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা নীল চাষ করতো। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তৎকালীন নীলকুঠির মালিক জমিদারও জায়গাটি ছেড়ে চলে যায়।</p> <p>সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদের পাড়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভবনটি। ভবনের দক্ষিণ দিকে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। ১২ কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল ভবন এটি। নিচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলার কক্ষগুলো আয়তনে বড়। চুন, সুরকি ও ইট দিয়ে তৈরি করা ভবনটি। বিশ্রাম ও গোসল করার জন্য নির্মিত পাকা সিঁড়ি কপোতাক্ষ নদের তীর পর্যন্ত নামানো হয়েছে।</p> <p>জানা গেছে, ঝিনাইদহ-যশোর অঞ্চলে ৬৭টি নীলকুঠি ছিল। অধিকাংশ কুঠিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। কোনো কোনোটির আবার স্মৃতিচিহ্ন নেই। নীলের ব্যবসায় মন্দা ও চারিদিকে নীল বিদ্রোহ শুরু হলে ব্রিটিশ সাহেবরা এদেশ থেকে তাঁদের সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে থাকে। খালিশপুর নীলকুঠির কুঠিয়াল সাহেব কুঠি ও অন্যান্য সম্পত্তি মেদিনীপুরের এক জমিদারের কাছে বিক্রি করে বিলেতে চলে যায়। জমিদার সেখানে কাচারি স্থাপন করে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওই জমিদারও এই দেশ ত্যাগ করে চলে যান। তৎকালীন সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করলে কুঠি ও জমি সরকার মালিকানায় চলে আসে।</p> <p>ঝিনেদার ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের পর থেকে নীল ব্যবসায়ে ভাটা দেখা দেয়। ব্রিটিশ সাহেবরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে থাকে। তখন এ দেশের জমিদাররা কুঠিগুলো কিনে তাদের কাচারি স্থাপন করতে থাকে। খালিশপুর কুঠি নীল চাষের শেষ দিকে স্থাপন করা হয়েছিল। সাহেবদের কাছ থেকে কুঠিটি কিনে নেন পাবনার এক জমিদার। তিনি তার জমিদারি কাজের জন্য কাচারি স্থাপন করেন। <br /> ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওই জমিদার দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরে একজন নায়েব ভববনটি দেখাশোনা করতেন। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে নায়েবও এ কুঠি ছেড়ে চলে যায়। ১৪ একর জমির ওপর স্থাপিত নীলকুঠিটি সরকারে খাস খতিয়ানে নেওয়া হয়। মহাকুমার সিও অফিস হিসেবে ১৯৫৬-৫৭ ও ১৯৮৩-৮৪ সালে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ভবনটিতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কাজকর্ম করা হয়েছিল। এরপর থেকে দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ভবনটি।</p> <p>এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয়দের মাধ্যমে আমি ওই নীলকুঠির গল্প শুনেছি। পর্যটন মন্ত্রণালয়কে আমাদের পক্ষ লিখিতভাবে জানানো হবে ঐতিহ্যবাহী নীলকুঠিকে সংস্কার করার জন্য।’</p>