দেশের সাংস্কৃতির সভ্যতার একটি ঐহিত্যবাহী নিদর্শন কুমিল্লার হোমনার শ্রীমুদ্দি গ্রাম। দেশব্যাপী এক নামে পরিচিত গ্রামটি। বাঁশের বাঁশি তৈরিতে প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস রয়েছে গ্রামটির। দেশে-বিদেশে এখানকার বাঁশির বেশ সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে।
বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে শ্রীমুদ্দি গ্রামের বাঁশি যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
বাংলা নববর্ষের আর মাত্র চার দিন বাকি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে কারিগররা বাঁশি তৈরিতে বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কারিগরদের দাবি, দীর্ঘ বছর ধরে সাংস্কৃতিক বিকাশের এই সরঞ্জাম তৈরি করলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সুদমুক্ত ঋণ কোনটাই পাচ্ছেন না তারা।
সরকারি সহযোগিতা পেলে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাঁশি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে যুগের পুর যুগ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হোমনা উপজেলা সদর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে তিতাস নদীর পাশে শ্রীমদ্দি গ্রাম। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাঁশির কারিগররা ব্যস্ততম সময় পার করছেন। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও অলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে হরেকরকমের বাঁশি।
কেউ বাঁশ কেটে ছিদ্র করছেন, কেউবা ধোয়া-মোছা শেষে রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ আবার সেই বাঁশিতে নকশা করছেন। সবশেষে পাইকারদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বাঁশিগুলো বান্ডেল করা হচ্ছে। বড়দের পাশাপাশি তাদের সন্তানেরাও এই কাজে পিছিয়ে নেই। বাবা-মাকে সহযোগিতা করছেন। এ যেন এক বাঁশির রাজ্য!
কথা হয় বাঁশি তৈরির কারিগর জজ মিয়ার সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বাঁশি তৈরি আমাদের বাপ-দাদার পেশা। ১০-১৫ বছর বয়সে আমি এই শিল্প রপ্ত করেছি। প্রায় ৫০ বছর বয়সে তিনি প্রতিদিন গড়ে একশ থেকে দেড়শ বাঁশি তৈরি করি। ফাল্গুন থেকে বৈশাখী মাস পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যস্ততা তাদের। এ ছাড়াও সারা বছরই গ্রামের মানুষ বাঁশি তৈরি করেন। বিশেষ করে মুখ বাঁশি বা থোতা বাঁশি বেশি তৈরি হয়। এটি ১০-২০ টাকা পর্যন্ত পাইকারি দরে বিক্রি হয়। আঁড় বাঁশির চাহিদাও প্রচুর। এর দাম ২০-৫০ টাকা। এ ছাড়া মোহন বাঁশি, চৌদ্দ বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, বেলুন বাঁশি, পাখি বাঁশি, রিং বাঁশি, হুইসাল বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি তৈরি করা হয়। যা বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে। দুই ইঞ্চি থেকে চার ফুট পর্যন্ত লম্বা আকারের বাঁশের বাঁশির দাম ডিজাইন ও গুণাগুণ ভেদে ১০০ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাঁশির কারিগর সবিতা রানী মজুমদার বলেন, ৩৫ বছর আগে বিয়ে হয়েছে এই গ্রামে। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে বাঁশি তৈরির কাজ করছি। এই কাজ তেমন কষ্টের না। দুই-একবার বার দেখলেই যে কেউ বানাতে পারবে। বিক্রিও সহজ। ঢাকার চকবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা বাড়িতে এসে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিমাসে আমাদের আয় ১০-১৫ হাজার টাকা।
আবুল কাশেম বলেন, প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্য পূর্ব পুরুষদের পেশা এখনো ধরে রেখেছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও এই কাজে মনোযোগী হয়েছে। গর্বের বিষয় হলো, প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের তৈরি বাঁশি ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ২০-২৫টি দেশে যাচ্ছে। এ ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে হোমনার বাঁশির কদর একটু বেশি। তবে শ্রম অনুসারে লাভ কম। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে তিনি সরকারের সহযোগিতা চাই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, ৫%-৬% সুদে ৫০ থেকে এক লাখ পর্যন্ত লোনের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা চাইলে যেকোনো সময় এই ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা হলে আমরা সেখানে এই বাঁশি গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপনের দিয়ে আহ্বান জানাই।