নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় গ্রামীণ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রত্যন্ত গ্রামে খনার মেলা শুরু হয়েছে। রবিবার (১৩ এপ্রিল) ভোরে উপজেলা গড়াডোবা ইউনিয়নে আঙ্গারোয়া গ্রামে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ এ মেলার উদ্বোধন করেন। ১৩ এপ্রিল সূর্যোদয় থেকে পরদিন ১৪ এপ্রিল সূর্যোদয় পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টাব্যাপী দিন-রাত চলবে এই আয়োজন।
মঙ্গল ঘর নামের একটি সংগঠনসহ স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মিডিয়া কমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান কুল এক্সপোজার এ মেলার আয়োজন করেছে।
বাংলা ১৪৩১-কে বিদায় জানাতে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা কবি সাহিত্যিকের উর্বর ভূমি ও ময়মনসিংহে গীতিকার ঐতিহ্যবাহী উপজেলা কেন্দুয়ার গড়াডোবা ইউনিয়নের আঙ্গারোয়া গ্রামে এই আয়োজন করা হয়েছে।
খনার ওপর বিশেষ আলোচনাপর্বে 'জল ভালা ভাসা, মানুষ ভালা চাষা' প্রতিপাদ্যের আলোকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন লেখক গবেষক পাবেল পার্থ, প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সংগঠক দেলোয়ার জাহান, কবি আহমেদ নকিব, লেখক সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠক বাকী বিল্লাহ, শিল্পী ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠক বিথী ঘোষ, কবি আসমা বিথী, সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠক আবুল কালাম আজাদ, লোক সাহিত্য গবেষক বাবু রাখাল বিশ্বাস, চর্চা সাহিত্য আড্ডার সমন্বয়ক রহমান জীবন, মঙ্গলঘর পরিসরের প্রধান সংগঠক বদনূর চৌধুরী লিপন প্রমুখ।
মেলায় উপস্থিত থেকে প্রখ্যাত বাউলশিল্পী সুনীল কর্মকার, প্রবীণ কৃষক বাউল মিয়া হোসেন, বাউল শিল্পী শেফালী গায়েন, শিল্পী কফিল আহমেদসহ অনেকে গান পরিবেশন করবেন।
এ ছাড়াও কৃষ্ণকলি ও তার দল, সংগঠন সমগীত, ব্যান্ড সহজিয়া, মুসা কলি মুকুল, নূপুর সুলতানা, মঙ্গলঘরের শিল্পী কৃষক দুদু কাঞ্চনসহ আরো অনেকেই গান পরিবেশন করবেন।
আয়োজনে বয়াতি পালা গান, জারি গান, কেচ্ছা গান, লাঙ্গল, কোপিবাতি, বিন্দা, মাটির পাত্র, বাঁশের তৈরী বিভিন্ন তৈজসপত্রসহ গ্রামের ঐতিহ্যের সকল কিছু এখানে তুলে ধরা হয়। তবে মেলা বলতে সাধারণত নানা পণ্যের পসরা বোঝালেও এই মেলা সেই মধ্যে মেলা নয়। এখানে কথা-গানের ভরপুর আয়োজন চলে। আর সেই কথায় বা গানে গানে গ্রামীণ চিরায়ত চিত্র ফুটে উঠেছে।
বয়াতিরা নিজেদের ভাষায় পালা গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন এই গ্রামীণ সংস্কৃতি। খনার মেলার মূল প্রতিপাদ্যই ছিল 'জল ভালা ভাসা, মানুষ ভালা চাষা'। অর্থাৎ কৃষি উপজীব্যকে সামনে তুলে আনতেই এমন আয়োজন।
আর এই আয়োজনে গ্রামে বেড়াতে আসা বিভিন্ন বয়সের শ্রেণি-পেশার মানুষও উপস্থিত থেকে ঈদ এবং বৈশাখের ছুটির আনন্দ উপভোগ করেছে। শুধু গ্রামের মানুষই নয় জেলা ছাড়াও ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন অনেকেই।
বিভিন্ন শিল্পীরাও পরিবেশন করেছেন স্থানীয় বাউল সাধকদের গান। এ ছাড়াও স্থানীয় বয়াতিরা পালা গান, জারি গান, কেচ্ছা গান পরিবেশন করে। সবাই মিলে গ্রামীণ খাবার খেয়েছেন মাটির পাত্রে। পুরনো আসবাবপত্র তুলে ধরা হয় নতুন প্রজন্মকে চিনিয়ে দিতে।
খনার মেলায় ময়মনসিংহ থেকে আসা রুবিনা আক্তার বলেন, এই যে গ্রামে এই সময়ে আনন্দ করছে মানুষ, এটাই তো হারিয়ে গিয়েছিল। এটি আবারো জাগ্রত হলে আবার গ্রামে ফিরবে মানুষ।
এই খনার মেলায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত শিল্পকলা ও নাট্যকলা শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, শুনেছি গত বছরও এ আয়োজন হয়েছিল। খনাকে নিয়ে আয়োজন এটা দ্বিতীয়বারের মতো। আমরা চাই প্রতিবছর আয়োজনটি বড় পরিসরে হোক এবং গ্রামের ঐতিহ্য ধরে রাখুক।
মেলা উদযাপন কমিটির উদ্দোক্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত বছর থেকে আঙ্গারোয়া গ্রামে তারা এ মেলা শুরু করেছে। মেলার আয়োজন করতে পেরে তাদের এক দরনের নতুন অনুভূতি ও আত্মতৃপ্তির সৃষ্টি হয়। মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কবি ও সংস্কৃতিকর্মী ছাড়াও নানা শ্রেণির মানুষজন আসে।
প্রধান আয়োজক গড়াডোবা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বদনূর চৌধুরী লিপন জানান, মঙ্গল ঘর নামে তাদের একটি মাত্র কক্ষ রয়েছে যেখানে প্রতিদিন আড্ডা হয়। এ সকল আড্ডায় ভালো ভালো চিন্তা বেরিয়ে আসে। আর সেখান থেকেই এই খনার মেলার আয়োজন। এ বছর দ্বিতীয়বারে মতো এমন আয়োজনে স্থানীয় গ্রামের মানুষ আনন্দ নিচ্ছে এটাই অনেক বড়। বিশেষ করে খনার বচন এখন আর শোনাই যায় না। এগুলো নতুন প্রজন্ম শুনবে এবং ধারণ করবে। খনার বচনের সাথে প্রকৃতির সকল কিছু মিশে আছে।