বাঙালির নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ মৃৎশিল্প। বৈশাখ এলে কদর বেড়ে যায় এ মৃৎশিল্পের। সারা বছর তৈজসপত্র তৈরি করে কোনো রকম জীবিকা চালালেও বৈশাখের মেলার অপেক্ষায় থাকে এ শিল্পের কারিগররা। সারা দেশের অধিকাংশ মেলায় তৈজসপত্র চাহিদা মেটায় বিজয়পুরের মৃৎশিল্প।
বিজয়পুর কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার একটি গ্রাম। সারা দেশে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প নামে চিনলেও মূলত এই উপজেলা ৭টি গ্রামে মৃৎশিল্প তৈরি হয়। গ্রামগুলো হলো, উত্তর বিজয়পুর, দক্ষিণ বিজয়পুর, নোয়াপাড়া, গাঙকুল, টেগুরিয়াপাড়া, দুর্গাপুর ও বরোপাড়া। বৈশাখ উপলক্ষে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রামের মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।
মৃৎশিল্পের কারিগররা বলছেন, প্রায় ৬৪ বছর ধরে কুমিল্লার ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প। ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল কুমার ও পাল বংশের ১৫ জনের আমানতের মোট ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা মূলধন দিয়ে যাত্রা শুরু করে বিজয়পুর মৃৎশিল্প। পরে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের পরামর্শে ওই ১৫ জন নিয়ে ‘বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি’ নামে একটি সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে। এই সমিতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে গ্রামের বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান করা।
গতকাল শনিবার (১২ এপ্রিল) দুপুরে গাঙকুল গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বৈশাখী মেলার তৈজসপত্রের চাহিদা মেটাতে গ্রামের নারী-পুরুষ মিলেমিশে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, রবিঠাকুর, কাজী নজরুল, গণেশসহ বিভিন্নজনের প্রতিকৃতি। পুতুল, হাতি, ঘোড়া, নৌকা, টিয়া, সিংহ, দোয়েল, কচ্ছপ, মাছ, হাঁস, প্লেট, মগ, গ্লাস, চায়ের কাপ তৈরি হচ্ছে সমানতালে। গ্রামের এক অংশ নারী তা আবার রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ আবার ফুলদানীতে রঙ তুলিতে আঁকছেন।
গাঙকুল গ্রামের রেখা রানী পাল ও শিখা রানী পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এই গ্রামের মাটির বানানো জিনিসপত্র দেশের বাহিরেও নেওয়া হয়।
বৈশাখের মেলা উপলক্ষে সারা দেশ থেকে বিক্রেতরা এখানে তৈজসপত্রের মালামাল নিয়ে যান। আমরা সবাই অপেক্ষা থাকি বাংলা নতুন বছরের জন্য। এত চাপ থাকে যে অনেক সময় বিক্রেতাদের অর্ডার ফিরিয়ে দেই।
বিজয়পুরের শংকর মৃৎশিল্পের মালিক শংকর পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্যান্য বৈশাখের তুলনায় এবার বিক্রি ভালো হচ্ছে। বৈশাখ উপলক্ষে আগেই ডিজাইন দেওয়া থাকে। ওই ডিজাইন বানানোর পর দোকানে নিয়ে আসি। আমার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন আইটেমের মাল মেলায় নিয়ে যান।
মাটির তৈজসপত্র কিনতে আসা সদর দক্ষিণ উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. পারুল আক্তার মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি সব সময় মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করি। এটি ব্যবহার করতে ভালো লাগে। কুমিল্লা ঐতিহ্য হচ্ছে মাটি, এই মাটিই হচ্ছে খাঁটি। আমার ঘরের অধিকাংশ আসবাবপত্র মাটির তৈরি। এমনকি পানির জগও মাটির তৈরি কারণ মাটির তৈরি জিনিসপত্রে পানি রাখলে পানি ঠাণ্ডা থাকে। আমার দেখায় অনেকেই মাটির জিনিস ব্যবহার করছে। আগের সময় দেখেছি দাদা নানারা মাটির প্লেটে খেতেন এখন আবার সে ঐতিহ্য ফিরে আসছে।
‘বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি’ চন্দন পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘরের আসবাবপত্র বানিয়ে অন্তত ৫০টি পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে। মাঝখানে আমার গ্যাস থাকায় আমরা সিরামিকের পণ্য তৈরি করছিলাম। ২০১৬ সালে আমাদের গ্যাস বন্ধ করে দেওয়ার পর এখন আর সিরামিকের কিছু বানানো হয় না।
তিনি আরো বলেন, বিগত সময়ে বৈশাখী মেলায় না হওয়ায় আমরা লোকসান দিয়েছি। কারণ মেলা উপলক্ষে যে মাল বানানো হয় এই মাল অন্য সময়ে কম চলে। আগে গ্যাস থাকায় অনেক মাল বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এখন রপ্তানি কমে গেছে। এই কারখানায় মাসে ৫ লক্ষ টাকা খরচ আছে কিন্তু আমরা খুব বেশি লাভবান হচ্ছি না । সমিতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান। বর্তমানে কারখানায় ৫০ জন কাজ করছে গ্যাস থাকলে আরো ৫০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেত।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অরুন চন্দ্র পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৬১ সাল থেকে বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথমে গ্রামের ঘরে ঘরে হাতে এই শিল্পের কাজ করা হলেও এখন সময়ের পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে তৈজসপত্র বানানো হয়। এই তৈজসপত্রের মালামাল পুড়াতে আমাদের অনেক ব্যয় হয়। লাকড়ি ও খরের দাম দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে এখন পোষায় না। গ্যাসের ব্যবস্থা করা হলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আরো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হত। এখন এ কারখানায় ৫০ জন কাজ করে তখন ১০০ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হত।
কুমিল্লার গাঙকুল গ্রামে বৈশাখী মেলা উপলক্ষে মাটির তৈজসপত্রে রঙ তুলিতে আঁকছেন নারীরা। ছবি : কালের কণ্ঠ