<p>মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ১৯৯২ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তির পর বেশ কয়েক বছর ভালোই চলছিল এ শ্রমবাজার। কিন্তু কয়েক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়।</p> <p>পরে ১৯৯৬ সালে আবার সে দেশের শ্রমবাজার চালু হয়। এরপর আবার ২০০০ সালে নিজেদের চাহিদা বিবেচনায় সে দেশের সরকার বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়।</p> <p>বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ‘আনস্টেবল মার্কেট’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “এটা টোটাল আনস্টেবল মার্কেট। ৯২ সালে খোলার পরে হঠাৎ করে কোনো নোটিশ ছাড়াই বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার ৯৬ সালে খুলে। ছয় – সাত মাস কাজ করার পর আবার বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে পর্যায়ক্রমে চার - পাঁচবার বন্ধ হয় ওই বাজার।”</p> <p>এরপর ২০০৬ সালে আবার কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি ধরা পড়ার পর ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়।</p> <p>এরপর দুই দেশের মধ্যে আলোচনার পর ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আবার নতুন চুক্তি হয়। ওই বছরের নভেম্বর মাসে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘জিটুজি’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে আবার বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়া যাওয়া শুরু করে।</p> <p>কিন্তু কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে সেটি বন্ধ করে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সাথে মালয়েশিয়ার সরকার কর্মী প্রেরণ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্বারক সই করে। তবে তারপরও কর্মী নিয়োগ বন্ধ ছিল। কারণ মালয়েশিয়ার তরফ থেকে শুধুমাত্র ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। বাংলাদেশের সরকারও বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে।</p> <p>এরপর থেকে ছয় মাস যাবত দুই দেশের সরকারের মধ্যে শুধু চিঠি চালাচালি হয় এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক বারবার মালয়েশিয়ার তরফ থেকে পিছিয়ে দেয়া হয়। ওই বছরের জুন মাসের দুই তারিখ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানানের উপস্থিতিতে ঢাকায় দুই দেশের একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বিষয়টির এক ধরনের সুরাহা হয়।</p> <p>বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জানান, ‘ওই চুক্তিতে একটা টেকনিক্যাল ক্লজ দুই সরকার জুড়ে দিলো সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের সরকার যতগুলো বৈধ এজেন্সির লাইসেন্স আছে তালিকা পাঠাবে মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে। তারা সেখান থেকে পিক করবে তারা কতজনকে দেবে।’</p> <p>সে সময় এই চুক্তির বিরোধিতা করা হয়েছিল কিন্তু অভিবাসনের ধারা কমে যাওয়ায় সরকার জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টিকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছিল বলে জানান মি. চৌধুরী।</p> <p>আলী হায়দার চৌধুরী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার সেসময় ১৫৬১ বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠায়। সেখান থেকে মালয়েশিয়ান সরকার তাদের কেবিনেটে ১০১ জন এজেন্সির নাম এপ্রুভ করেছে। এর মধ্যে একটা সরকারের এজেন্সি যেটা বোয়েসেল। বাকিগুলো বেসরকারি।’</p> <p>তার দাবি ‘এই চুক্তির ফলে মালয়েশিয়া যাদের অনুমোদন করে এদের মধ্যে একেবারেই নতুন কিছু এজেন্সি যাদের পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অনেক কিছু ছিল না। কোনো না কোনোভাবে তারা এনলিস্টেড হয়ে গেছে। তারা লোক পাঠানোও শুরু করে দেয়।’</p> <p>পরে ২০২২ সালের অগাস্টে আবার শ্রমবাজার চালু হয়। পরে শুধু ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক গিয়েছে তিন লাখ ৫১ হাজারের বেশি।</p> <p>আর শ্রমিকদের কাজ না পাওয়া, নির্যাতন থেকে শুরু করে শ্রমিক নিখোঁজ হওয়ার মতো অভিযোগগুলোও প্রকট হয়েছে ২০২৩ সালেই। ওই বছর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবনমানের দুর্দশার চিত্র উঠে আসে মালয়েশিয়ার মূলধারার গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনগুলোতেও। একপর্যায়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় থেকেও বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।</p> <p>এ বছরের মে মাসে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জাতিসংঘের কনটেম্পোরারি স্লেভারি বিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার তমোয়া ওবোকাতা বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা যে অবস্থায় আছেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে। দেশটিতে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে দুই দেশেরই একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র জড়িত।</p> <p>ওবোকাতা বলেন, ‘এখানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার ভেতরে একটি শক্তিশালী অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। যারা চাকরি এবং ভালো বেতনের কথা বলে শ্রমিকদের মালয়েশিয়ার নিয়ে প্রতারণা করছে। তারা পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে শ্রমিকদের কাছ থেকে। ফলে শ্রমিকরা ঋণের চক্রে আটকে যাচ্ছে।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়া নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজ না পাওয়ায় শ্রমিকরা অবৈধ হয়ে পড়ে। এই অবৈধ শ্রমিকদের যারা চাকরি দেয়, তারাও এদের শোষণের সুযোগ হাতছাড়া করে না। ফলে সমস্যাটা এখানে বেশ গভীর।’</p> <p>তার মতে, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া- দুই দেশের সরকারকেই শ্রমিক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সংশোধন করতে হবে যেন শ্রমিকরা নির্যাতিত না হয়।</p> <p>এ বছরের ৩০শে মের পর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার। বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী অবশ্য জানান, শুধু বাংলাদেশ নয় সবদেশ থেকেই কর্মী নেয়া বন্ধ করেছে মালয়েশিয়া। তারা তাদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে কর্মী নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।<br />  </p>