<p style="text-align:justify">চলচ্চিত্র পরিচালক, সহকারী পরিচালক, শিল্পী, ক্যামেরাম্যান, মেকআপম্যান, ভিডিও এডিটরসহ সিনেমা হল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৩০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একসময় সুদিন বিরাজ করলেও বর্তমানে ক্রান্তিকাল পার করছে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক সিনেমা হল। ফলে সরকার হারাচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব।</p> <p style="text-align:justify">১৯৯২ সালে দেশে এক হাজার ২৩৫টি সিনেমা হল থাকলেও কমতে কমতে বর্তমানে এসে ঠেকেছে ৬৫টিতে। সেগুলোরও কোনো কোনোটি বন্ধ থাকছে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটি বিপুল ব্যবসাসফল হওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে দেশে নতুন করে নির্মাণ করা হয়  অন্তত ১৫০টি সিনেমা হল। আবার সিনেমা ফ্লপ করলে কমতে শুরু করে হলের সংখ্যা। তখন হল ভেয়ে নির্মাই করা হয় মার্কেট। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।</p> <p style="text-align:justify">সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে দেশে সিনেমা হল ছিল এক হাজার ২৩৫টি। তবে ১৯৯৪ সালে আকাশ সংস্কৃতি শুরু হলে এর প্রভাব পড়ে চলচ্চিত্রে। তখন থেকে সিনেমা হলে দর্শক কমতে শুরু করে। ব্যবসায়ীরা লোকসান দিতে দিতে একসময় সিনেমা হলের ব্যবসা ছেড়ে দিতে শুরু করেন। এ কারণে বর্তমানে সিনেপ্লেক্স ছাড়া প্রচলিত সিনেমা হলের সংখ্যা ৬৫টিতে নেমেছে। এর মধ্যেও সব কটি চলছে না।</p> <p style="text-align:justify">এর সত্যতা মিলেছে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ও রাজধানীর মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের কথায়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ভালো সিনেমা না থাকার কারণে সিনেমা হল চালাতে পারছি না। আমরা মানসম্মত সিনেমা না হলে চালাই না। মানসম্মত সিনেমা না পাওয়ায় গত ২৮ নভেম্বর থেকে মধুমিতা সিনেমা হল বন্ধ রাখা হয়েছে।’</p> <p style="text-align:justify">এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিনেমা এক দিনে ধ্বংস হয়নি। নানা কারণে এটি ধ্বংসের দিকে এগিয়েছে। আমাদের এখানে স্ক্রিপ্ট রাইটারদের মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ একটি ছবির মূল বিষয় একটি ভালো স্ক্রিপ্ট।’</p> <p style="text-align:justify">তিনি জানান, তাঁদের পরিবার ৩৫টি সিনেমা প্রযোজনা করেছে। তিন বিঘা জমির ওপর মধুমিতা সিনেমা হল বানিয়েছে। চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই তাঁরা এগুলো করেছেন। দেশের অনেক সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট করা হলেও সিনেমাকে ভালোবেসে তাঁরা এখনো সেটি করেননি।</p> <p style="text-align:justify">আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংসের জন্য যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া প্রধান কারণ বলে মনে করি। ‘মিস লংকা’, ‘দূর দেশ’-এর মতো ছবি যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ করা হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে শাকিব খান ছাড়া আর কারো সিনেমা চলছে না। একজন নায়ক এই মাধ্যমকে কত টানবে! আমাদের তো বিকল্প তৈরি হচ্ছে না।’</p> <p style="text-align:justify">প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, চলচ্চিত্রের প্রতি প্রেম না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। যাঁরা একসময় সিনেমা হল তৈরি করেছিলেন তাঁরা চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে করেছিলেন। সেসব হল মালিকদের অনেকে এখন নেই। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম ব্যবসায় লোকসান দেখে হলগুলো ভেঙে মার্কেট নির্মাণ শুরু করে। ফলে দিন দিন হলের সংখ্যা কমছে।</p> <p style="text-align:justify">তিনি আরো জানান, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর ১৯৭৪ সালে চলচ্চিত্রে জড়িয়ে পড়েন। ‘জানোয়ার’ নামের একটি ছবি প্রযোজনার মাধ্যমে প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন কালিদাস। এরপর তিনি নরায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ‘সাথী’ সিনেমা হল নির্মাণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন হলটি চালালেও তাঁর ছেলে এখন আর এই ব্যবসা পছন্দ করছেন না। নাতি-নাতনিরাও হলের পক্ষে না। তিনি মরে গেলে হলটি আর থাকবে কি না এ নিয়ে সন্দিহান তিনি।</p> <p style="text-align:justify">তিনি আরো জানান, একসময় পোস্তগোলা এলাকায় ‘ডায়না’ সিনেমা হল ছিল। এই হলটি ছিল দেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল। সিট ছিল এক হাজার ২০০টি। একই মালিকের ‘যমুনা’ ও ‘মেঘনা’ নামের আরো দুটি সিনেমা হল ছিল। ২০০০ সালের পর হলগুলো আর নেই।</p> <p style="text-align:justify">মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, “আমরা দেখেছি অনেকে খালি পায়ে এফডিসিতে এসে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেছেন। আবার অনেকে গাড়ি নিয়ে ঢুকে খালি পায়ে বেরিয়ে গেছেন। স্টার গ্রুপের মালিক ইফতেখারুল ইসলাম সিনেমাপ্রেমী মানুষ ছিলেন। তিনি উর্দু ও বাংলায় অনেক ছবি প্রযোজনা করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর সন্তানরা আর এই ব্যবসায় আসেননি। একটি সিনেমা বাম্পার হিট হওয়ার পর দেশে নতুন নতুন সিনেমা হল তৈরি হতো। যেমন—‘বাহরাম বাদশা’, ‘অরুন বরুন কিরণমালা’, ‘বেদের  মেয়ে জোসনা’ ইত্যাদি।”</p> <p style="text-align:justify">চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস কালের কণ্ঠকে জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে নামমাত্র প্রমোদ কর দিতে হতো, যা এসডিও অফিস সংগ্রহ করত। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে প্রতি টিকিট থেকে ৬০ শতাংশ ট্যাক্স নিত সরকার।</p> <p style="text-align:justify">১৯৮৩ সালে এসে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলচ্চিত্রের ওপর ক্যাপাসিটি ট্যাক্স আরোপ করেন। ওই সময়ে যেমন চলচ্চিত্রের প্রসার ঘটেছিল ঠিক তেমনি সরকারও ট্যাক্স আদায়ের দিকে নজর দিচ্ছিল। কিন্তু যখনই চলচ্চিত্রের পতন শুরু হয় তখন থেকে সরকারেরও নজর কমে গেছে। বর্তমানে ট্যাক্স নয়, ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট দিতে হয়।</p>