ঈদযাত্রায় দেড় দশক আগেও টিকিট নিয়ে জনভোগান্তির শেষ ছিল না। খুশির ঈদযাত্রায় ট্রেন, বাস কিংবা লঞ্চে বাড়ি ফেরার জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট করতে হতো। ভোগান্তি ছিল আকাশপথে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রেও। তবে সেই ভোগান্তি লাঘব করেছে ই-টিকিট পদ্ধতি।
ঈদযাত্রায় দেড় দশক আগেও টিকিট নিয়ে জনভোগান্তির শেষ ছিল না। খুশির ঈদযাত্রায় ট্রেন, বাস কিংবা লঞ্চে বাড়ি ফেরার জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট করতে হতো। ভোগান্তি ছিল আকাশপথে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রেও। তবে সেই ভোগান্তি লাঘব করেছে ই-টিকিট পদ্ধতি।
এখন গাড়িচালক ঘরে বসেই ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করতে পারছেন। মিলছে ভূমিসংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা। জীবনের আরো আরো জরুরি সেবার জন্য আগের মতো ছুটতে হচ্ছে না অফিসে। দেশের পরিবহন খাতেও অনলাইনে বিভিন্ন সেবা পাওয়াকে সহজ করে দিয়েছে।
আগে টিকিটের জন্য রেলস্টেশন ও বাস কাউন্টারে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হত যাত্রীদের। জনভোগান্তির অন্তহীন সেই অবস্থার লাগাম টেনে ধরতে শুরু করে অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থা। ঘরে, অফিসে বা অন্য কোনো জায়গায় বসে এই টিকিট সংগ্রহ করা সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। এটা স্বীকার করতে হবে, তথ্যই শক্তি। তথ্য না জানলেই বহু বিপদ, বহু ভোগান্তি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।
না জানার কারণে, অভিজ্ঞতার অভাবে মনের মধ্যে ই-টিকেটিং নিয়ে তাই ভয়, বিভ্রান্তি কাজ করে। তৈরি হয় বিব্রতকর অবস্থা। দেখতে দেখতে পবিত্র রমজান মাস শেষের দিকে। সামনেই ঈদযাত্রার মূল স্রোত শুরু হবে সড়ক রেল ও নৌপথে। আকাশযানেও বাড়বে ভিড়। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট সংগ্রহের জন্য রাত জেগে যুদ্ধ এবারও নেই। রাত জেগে টিকিট কেনার বিষয়টি এখন গল্পের মতো। এবার বাড়ি যাওয়ার আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে বাস-ট্রেন-লঞ্চের। আকাশযানের টিকিটও বিক্রি হচ্ছে। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের জন্য গত ১৪ মার্চ থেকে অনলাইনে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। প্রথম দিনই সকাল ৮টা থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ হাজার ৭৭৩টি টিকিটের বিপরীতে ২০ লাখ হিট পড়েছে বলে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৭ মার্চ ভ্রমণের জন্য অগ্রিম টিকিট কাটতে গত ১৭ মার্চ সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ১ কোটি ৫০ লাখ হিট বা টিকিট কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০ মার্চে ৩০ মার্চের টিকিট বিক্রির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ট্রেনে আগাম টিকিট বিক্রির জন্য অনলাইনে যুদ্ধ। রেলে শতভাগ টিকিট এবারও অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ফলে রেলস্টেশনের কাউন্টারে ছিল না আগের ভিড়, ছিল না আগের ভোগান্তি।
একটু পেছন ফিরে দেখা যায়, ২০১২ সালের ২৯ মে সরকারিভাবে চালু হয় অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটার ব্যবস্থা। এক যুগের ব্যবধানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজিটাল টিকিট পদ্ধতি পথ পরিক্রমায় আরো সহজ হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েবসাইট থেকে সর্বোচ্চ ১০ দিন আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কেনা যায়। প্রথমেই দরকার হবে সাইটটিতে নিবন্ধন করা।
অভিজ্ঞরা জানেন, এই পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নাম্বার দিতে হয়। এরপর স্টেশন, ভ্রমণের তারিখ, ট্রেনের শ্রেণি নির্বাচন করতে হয়। এখানে বিদ্যমান আসনের ভিত্তিতে প্রদর্শিত আসনের তালিকা থেকে এক বা একাধিক আসন বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। দাম পরিশোধের (পেমেন্টের) পদ্ধতিতে রয়েছে ক্রেডিট/ডেবিট বা বিকাশের মতো জনপ্রিয় মোবাইল পেমেন্ট গেটওয়েগুলো। টিকিটের দাম পরিশোধ শেষে প্রাপ্ত ই-টিকিটের প্রিন্ট নিয়ে রেল স্টেশনে যেতে হয়। ওয়েবসাইট ছাড়াও ট্রেনের টিকিট কেনার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব অ্যাপ 'রেল সেবা' আছে অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোন উভয় প্ল্যাটফর্মের জন্য।
তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের আগেই বাংলাদেশ বিমানের আগাম টিকিট পাওয়ার সুবিধা শুরু হয়। সেটি শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যায় টিকেট বুকিংয়ের কাজ। এখানে গন্তব্য, তারিখ, শ্রেণি নির্বাচন ও ই-মেইল আইডি ও মোবাইল নাম্বারসহ যাত্রীর বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়। পরে ডিজিটাল ব্যাংকিং বা মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেমের মধ্যে যে কোনোটির মাধ্যমে পরিশোধ করা যায় টিকিটের মূল্য। অবশেষে ই-টিকিট প্রদান করা হয় যাত্রীদের ই-মেইলে। এছাড়াও আছে বিমান অ্যাপ।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবহণ মাধ্যমগুলোর ই-টিকিট পেতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে সহজ নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। ট্রেনের টিকিটগুলো বিআরআইটিএসের (বাংলাদেশ রেলওয়ে ইন্টিগ্রেটেড টিকেটিং সিস্টেম) সঙ্গে যৌথভাবে ইস্যু করে এ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪ সাল থেকে সহজ বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমানে একক মঞ্চের আওতায় সেবা দেওয়া শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রতিটি পরিবহণ মাধ্যমের জন্য আলাদাভাবে রওনা হওয়ার স্থান, গন্তব্য, ও যাত্রার তারিখ দেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে। এজন্য টিকিট সংগ্রহকারীকে সবসময় ব্যবহার করা হয় এমন ইমেইল ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার সরবরাহ করতে হয়। মোবাইল বা ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে অর্থ প্রদানের পর টিকিটের সফট কপির লিঙ্ক পাওয়া যাবে ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে।এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যাবে স্মার্টফোন থেকেও।
এছাড়াও অনলাইনে টিকিট সেবার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি গোজায়ান ২০১৭ সাল থেকে দেশের ভেতরের ও বাইরের এয়ার ফ্লাইট কেন্দ্রিক টিকিট সেবাদান শুরু করে। যদিও ই-টিকেটের পাশাপাশি এটি হোটেল, ট্যুর, এবং ভিসা সংক্রান্ত সুবিধাও প্রদান করে থাকে। এখান থেকে টিকিট অর্ডার করতে হলে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিতে হবে। এর অধীনে টিকিট প্রাপ্তি সহ ফ্লাইটের যাবতীয় আপডেট পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটে ফ্লাইট সার্চের পাশাপাশি একাধিক ফ্লাইটের মধ্যে তুলনা করারও ফিচার রয়েছে। ব্যাংকিং ও মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেমগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই থাকায় সব শ্রেণির গ্রাহকরাই অকপটেই ব্যবহার করতে পারেন।
২০১৪ সাল থেকে শেয়ার ট্রিপ নামের প্রতিষ্ঠান দেশে প্রথমবারের মতো একযোগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য অনলাইন টিকিট সেবা প্রদান করছে। যত প্রতিষ্ঠান বাড়ছে ততো সেবা পাওয়ায় সুযোগ বাড়ছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করছে কিনা, সেবাদানে ব্যতয় ঘটছে কিনা সেসব বিষয়ে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা দরকার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সড়ক পরিবহন খাতের বিভিন্ন দিক দেখভাল করে। অনলাইনে বাসের টিকিট বিক্রির বিষয়টি তারা মূল্যায়নের আওতায় আনতে পারে। এভাবে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা এককভাবে বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে পারে সরকার।
সম্পর্কিত খবর
কখনো সময় আসে যদি জাতির সামনে, কিন্তু অথবা দিয়ে কথা না বলে সরাসরি দৃঢ়তায় কথা বলতে হয়, প্রশ্ন করতে হয় পিনপয়েন্টে। তাহলো, কেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চলছে? কে করছে এসব এবং কার ইশারায়? তা এ দেশের জনগণের জানার, বোঝার অধিকার আছে। নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার আছে দেশের সাহসী সৈনিকদের পাশে দাঁড়ানোর, তাদের বুকে জড়িয়ে ধরার। যারা দেশকে রক্ষা করতে এই দুঃসময়ে রাত-দিন পরিশ্রম করছেন।
সম্প্রতি আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে সদ্য জন্মানো জাতীয় নাগরিক কমিটির অন্যতম নেতা আবুল হাসনাতের দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্ট। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ কুশাসন এবং ভয়াবহ রকম লুটপাটের কবল থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে আরেকটি স্তরে নিতে যে কয়েকজন তরুণ ভূমিকা রেখেছেন, হাসনাত সেই সাহসীদের তালিকায়।
সেই সংকটের উত্তরণে নিঃসন্দেহে কাণ্ডারির ভূমিকা রেখেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সাথে তার সতীর্থ কমান্ডাররা। অথচ তাকেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ করতে পিছপা হচ্ছে না আগস্ট অভ্যুত্থানের অনেক কলাকুশলী। তাদের অনেকেই রাজপথে, মাঠে ঘাটে, অনলাইনে নানবিধ নোংরা বাক্য ছড়াতে ব্যস্ত। অথচ তারা ভুলে যাচ্ছে আমাদের সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমেত্বের প্রতীক।
তরুণ নেতা হাসানাত ফেসবুকে কী পোস্ট করেছেন? তিনি লিখেছেন, “১১ই মার্চ, সময় দুপুর ২:৩০। কিছুদিন আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আমিসহ আরো দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ই মার্চ দুপুর ২:৩০-এ। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়- ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা নাকি ভালো। ফলশ্রুতিতে আপনি দেখবেন গত দুই দিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছে। আমাদেরকে আরো বলা হয়, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।
আমাদের এই প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করি এবং জানাই যে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন। এর উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোন ধরনের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং ‘আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক’।
আলোচনার এক পর্যায় বলি, যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা কিভাবে ক্ষমা করে দেবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, “ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া ‘ইনক্লুসিভ’ ইলেকশন হবে না।
উত্তরে বলি, ‘আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ইনক্লুসিভিটি হতে পারে না। আওয়ামী লীগকে ফেরাতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে ফেরাতে হবে। আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা করা হলে যে সংকট তৈরি হবে, তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে।’। পরে মিটিং অসমাপ্ত রেখেই আমাদের চলে আসতে হয়।"
আমার কাছে খুব বিস্ময়কর তার এই অভিযোগ! কেন? এর সারমর্ম দাঁড়ায়, সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাইছে, আওয়ামী লীগকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ দিতে, যার নেতৃত্বে থাকবেনা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্য। আপন রক্ত। এ পর্যন্ত বুঝলাম। গণতান্ত্রিক ধারা মানেই প্রশ্ন করো, উত্তর খোঁজো। তৈরি করো নতুন ন্যারেটিভ অথবা আগের নারেটিভের যৌক্তিক মীমাংসা নির্ণয় করো। সে প্রেক্ষিতেই স্বাভাবিক ধারায় কিন্তু কিছু প্রশ্ন চলে আসে।
ধরা যাক, হাসনাত ও তার দুই বন্ধু এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভেতর একটি আলোচনা হয়েছে। কবে হয়েছে? হাসনাত বলেছে ১১ মার্চ। তাহলে ১০ দিন পর ২১ মার্চ কেন তা প্রকাশ করা হলো না? কী উদ্দেশ্যে এই ১০ দিন তা গোপন রাখা? আবার কী উদ্দেশ্যেই সেটি জনগণের সামনে এনে সামরিক বাহিনীর ঊধ্বতন কর্মকর্তাদের পেশাগত জায়গাটিকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করা? সবটাই বড়ই ধোঁয়াশা। এমন ধরনের ধোঁয়ার মাঝে অনেক বিপদ ওত পেতে থাকে। সে বিপদ হলো, নিজের দেশকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেবার কৌশল। আচ্ছা, এমন একটি ঘটনা, যা কি না কনফিডেনশিয়াল মতো বিনিময়। তাহলে এথিকস রইল কোথায় সেসব প্রকাশ করার? নেতা হতে গেলে হতে হয় ধীরস্থির, প্রজ্ঞাবান এবং নিজের মাঝে সৃষ্টি করতে হয় গভীরতা। কিন্তু এখানে দেখছি সেসব অনুপস্থিত।
যদি প্রশ্ন করা হয়, জনাব হাসনাত, আপনাকে কি কেউ ক্যান্টনমেন্টে ডেকেছিল? নাকি নিজে নিজে সেখানে গিয়েছিলেন? এর সদৃত্তর আপনি দেননি। মিডিয়া এ নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করছিল, খুব সতর্কতায় স্মোক তৈরি করে আপনি এড়াচ্ছিলেন, দেখেছি। সত্যটা কি এই নয়, রেকর্ড আছে যে, আপনাকে কেউ ডাকে নাই। আপনি নিজ থেকে সেখানে গিয়েছিলেন। তাহলে এখন অন্যদিকে মোড় ঘোরানোর চেষ্টা কেন? আবারও প্রশ্ন, উদ্দেশ্যটা কী?
আরো প্রশ্ন আছে। জনাব হাসনাত, আপনার এই প্রকাশিত বক্তব্য কি আপনার রাজনৈতিক দল এনসিপির বক্তব্য? আপনি কি এনসিপির নেতৃবৃন্দের অনুমোদন নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন? লক্ষ করছি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। আরো লক্ষ করছি, যেদিন হাসনাত পোস্ট করল, ঠিক একই দিনে এই সরকারের ক্রীড়া বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভিডিও মেসেজ ছেড়েছেন এই বলে, সেনাবাহিনী প্রধান চাননি প্রফেসর ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করতে। বাহ, বেশ তো! এ কথা তো তাহলে গত আগস্টের। কিন্তু সাত মাস পর এনসিপির নেতা হাসনাতের সাথে এখন বলা কেন?
সব দেখে আর শুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা গোয়েন্দা কাহিনির সামনে। এ দেশের নাগরিকরা যেনো আর বিশুদ্ধ রাজনীতির দেখা পাচ্ছেন না। গত েরাতে, শুক্রবারে, ইউটিউব দেখলাম পিনাকী ভট্টাচারয, ইলিয়াস এবং ড. কনক সারায়োর মিলে গল্প করছে। সেখানে পিনাকী বাবু বলছে, ‘হাসনাতকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন তোমার এই গোপন মিটিংয়ের কথা আমাকে জানাও নাই? হাসনাত বলে, ‘দাদা, আমি রাজনীতি বুঝি না। খেয়াল করিনি বলতে হবে। যখন যা মাথায় আসে বলে ফেলি ‘ হাসনাতের গুরুর মুখে উচ্চারিত এমন সত্য কথা শোনার পর সত্যিই হতভম্ভ আমি। ভাবছি, কী করে একজন তরুণ নেতা এমন দায়িত্বহীন কথা বলতে পারেন, যিনি কি না আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে চান? তাহলে কি প্রশ্ন উঠে আসবে না, তার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি বা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা সেনাবাহিনীর মর্যাদা কতটুকু বজায় থাকবে?
হাসনাতের এই পোস্টের পর দেশের রাজপথে আবার অস্থিরতা। এনসিপি জমায়েত করছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ঠেকাতে। সে নাহ য় করল, কিন্তু এই জাতীয় জমায়েত থেকে তারা বিরতিহীনভাবে সেনাবাহিনী প্রধানকে টার্গেট করে অপবাদ ও আঘাত করেই চলেছে। সেনাবাহিনীর মাঝে বিভক্তি তৈরি হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এটা কি কোনো দেশপ্রেমিকের কাম্য হতে পারে? পারে না। কিন্তু তারা তো সকলে মুক্তমনে গঠনমূলকভাবে চিন্তা করছে না।
হাসনাতদের গুরুরা বাস করে উন্নত বিশ্বে। আমেরিকায়, ফ্রান্সে। যেখানে তাদরে জীবন সুখের, আয়েশের। তারা ইউটিউবে এসে দেশের জন্যে কেঁদে বুক ভাসায় এবং দেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র জনতাকে ঠেলে দেয় ভয়াবহ সংঘাতে। এত করে তাদের কি যায় আসে? কিছুই ক্ষতি নাই তাদের। তারা নিজ ও তাদের পরিবার নিয়ে বাস করে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশে, রাজার হালে। মরে তো সব হতভাগা বাংলাদেশের লোকজন। এখন রমজান মাস। হাসনাত এবং তাদের গুরুগণের ক্রোধে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়তে পারে? সে কতা কি তারা ভাবে? মোটেও না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখতে হলেও রাজপথে আন্দোলনের সময় এখন নয়। তাদের এই আন্দোলন এমন তো হতে পারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধ শক্তিতে সুযোগ করে দিতে পারে আমাদের বড় মাপের বিপদ ঘটাতে? বাংলাদেশকে দুর্বল করতে? এমন হলে লাভ কার? এমন নয় তো, সবার অলক্ষে এ লাভ ক্ষমতা থেকে পতিত আওয়ামী লীগের পকেটে ঢুকবে, যে দলের নেতারা লুটপাটের অর্থে বিদেশে আয়েশে আছে? এমন হলে কি লাভ অন্য দেশের, যারা কিনা আমাদের ভালো চায় না? খুব কি খারাপ শোনাবে যদি প্রশ্ন করি, রাজনীতি কম বোঝা হাসনাতের এমন উদ্দেশ্য কি আছে, ঐ সব কালো শক্তিকে সহায়তা করার?
এখানে একটা কথা বলা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমার এ লেখা যদি হাসনাতের চোখে পড়ে, ভাববে নিশ্চয়ই হাজারো সুবিধাবাদির মতো আমিও। কিন্তু বলি, আমিছিলাম জাপানি আর জার্মান দূতাবাসের রাজনৈতিক উপদেষ্টা, সবমিলিয়ে সিকি শতাব্দি। কিন্তু আজও না আছে বাড়ি, না আছে গাড়ি। বয়সটা চৌষট্টি পেরুলো। আপনার মতো আমিও পড়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশির দশকের শুরুর দিক। বিষয় ছিলো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সঙ্ঘের। সেজন্যেই এটুকু বলতে চাই,যা বলছিনিজের সকল রকমসততা নিয়ে দেশ আর জনগণের প্রয়োজনে বলছি। একজন প্রবীন প্রাজ্ঞজন হিসেবে তরুণদেরকে বলছি, ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে, এই বাংলাদেশ সকল দিক থেকে ভেঙে পড়তে পারে। ভূলণ্ঠিত হতে পারেএ দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাশিল্পী।
বড় সঙ্গীন সময়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহর ওভার বাউন্ডারি নয়, ওভার স্টেডিয়াম হওয়ার অবস্থা। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসনাত নামেই যথেষ্ট পরিচয়ের তারকা সমন্বয়ক তিনি। মাঝেমাঝে স্ট্যান্ট বা ক্রেজ তৈরিতে সফলতার দৌড়ে এ ম্যাজিশিয়ান একটা বাজে সময়ে ছক্কা হাঁকাতে গেলেন। তা করতে গিয়ে গোটা সেনাবাহিনীকে নিয়ে বোমা ফাটিয়ে বসলেন।
গুজবের বাজার গরম করে, কনটেন্ট বেপারিদের ব্যবসা জমিয়ে পরিস্থিতিতে কাউর বাধিয়ে এখন কেন এ বোধ? হাসনাতের বোধটা জেগেছে একটু দেরিতে, পানি আচ্ছা মতো ঘোলা করে।
এমন জরুরি আহ্বান ও সতর্কতা বোধ হয় স্পর্শ করেনি হাসনাতসহ তার কোনো কোনো সহযোদ্ধাকে। নইলে কিভাবে- কেন সেই ১১ মার্চের বাসী বিষয় টেনে এনে সেদিন জানালেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে রিফাইন্ড করার আয়োজন চলছে? বৈঠক করে এতে সহায়তা করতে বলা হয়েছে ছাত্র নেতাদের। জবাবে হাসনাত সাহস ও বীরত্বের সাথে কীসব বলেছেন, এর একটা ফিরিস্তি দিলেন ফেসবুক পোস্টে। পুরো বর্ণনাতেই একতরফা থ্রিল-ড্রামা। রাজনীতি ও সমসাময়িক পরিস্থিথির মাঝে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে টোকা দেয়ার ষোলোআনা কাজই তিনি করলেন। পেলেন ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেবল একতরফা-একপক্ষীয় অভিযোগ তুলেই তারা ক্ষ্যান্ত দেননি, মব ডেকে এট্টোসিটি করারও চেষ্টা করেছে। তার বক্তব্যের উল্টো পিঠে কী আছে- সেটাও জনগণের জানা দরকার। হাসনাতদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের আদৌ কিছু ঘটেছে কি না, ঘটলে কী ঘটেছে- তার একটা ব্যাখ্যা আসা দরকার। একপক্ষের বক্তব্য শুনে কোনো উপসংহারে আসা ঠিক নয়। সেনাবাহিনী এবং বাহিনীর প্রধানকে মিন করে কিছু বললে কাভারেজ তো আপনাআপনিই চলে আসে। কিন্তু সেনাবাহিনী তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, না তিনিই গিয়েছিলেন? সাংবাদিকরা বারবার এ প্রশ্ন করেও জবাব পাননি। হাসনাত বলেছেন, তার পোস্টে তা উল্লেখ আছে। তন্ন তন্ন করে বার কয়েক পড়েও তার পোস্টে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রায় একই সময়ে ভাইরাল হয়েছে উপদেষ্টা আসিফের একটি ভিডিও স্ট্যাটাস। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, কিভাবে ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বাছাই করা হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার কী বলে এ নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন। এ বর্ণনাও একেবারে একতরফা। তার ওপর তিনি একজন উপদেষ্টা। বর্ণনা ঠিক থাকলেও তিনি তা প্রকাশ করতে পারেন না। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য গোপন রাখবেন বলে তিনি শপথবদ্ধ। উল্লেখ্য, মন্ত্রীদের মতো উপদেষ্টারাও পর পর দুটি শপথ নেন। প্রথমটি, নিযুক্তির শপথ। দ্বিতীয়টি, রাষ্ট্রীয় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার শপথ। ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সেই শপথটি ভঙ্গ করলেন।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই- প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দেওয়া এ বক্তব্য ঘিরে একটি উত্তাপ তৈরির আয়োজন চলছিল ক’দিন ধরেই। এর মাঝেই আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে—এমন আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকেও জড়িয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের বক্তব্য। সময়টা বড় স্পর্শকাতর। চলছে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ। জাতীয় সংসদ, গণপরিষদ, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন—কোনটি আগে হবে, তা নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ পুরনো দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ আছে। আর তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির মূল চাওয়া গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য আগে গণপরিষদ নির্বাচন অথবা একই সঙ্গে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোট দেওয়ার বয়স ১৬ বছর এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৩ বছর করার প্রস্তাব করবে তারা। এনসিপির উপলব্ধি গণ-অভ্যুত্থানের পর সংবিধান আর কার্যকর নেই, তাই নতুন করে সংবিধান রচনার দাবি দলটির।
এসব বোধ-দাবি রাজনৈতিক বিষয়। চেতনাগত বিষয়ও। আর রাজনৈতিক বিষয়ের রাজনৈতিক ফয়সালা আসবেই। অপেক্ষা শুধু সময়ের। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি বা নমুনা দৃষ্টে সাবধানতার কিছু বিষয়াদি রয়েছে। স্থানিক- আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখার সময়। যেকোনো পক্ষের হঠকারী যেকোনো পদক্ষেপ মহা সর্বনাশ করে দিতে পারে। সেই বুঝ রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অবশ্যই রয়েছে। তাদের কারোই না বোঝার কথা নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর জনআস্থায় চিড় ধরাতে পারলে কার লাভ হবে? চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী জনগণের পাশে না দাঁড়ালে দেশের কী অবস্থা হতো? গণ-অভ্যুত্থানের পরে এখন কেন সেই বাহিনীটিকে বিরোধে টেনে আনা? সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে অরাজক পরিস্থিতির মুখে দেশকে ঠেলে দেওয়া প্রকারান্তরে আরেক ফ্যাসিজম। ঢালাওভাবে সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে বিষোদগার বিশেষ কারো কারো মধ্যে পুলক জাগাচ্ছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত কথিত রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ বলতে কিছু দৃশ্যমান নেই। শোরগোল পুরোটাই একমুখী-একতরফা-একরোখা। রাজনীতিতে আবার ফিরতে আওয়ামী লীগ নিজে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে- এমন গ্রহনযোগ্য তথ্য নেই। সূত্রও নেই। হাসনাতের মাধ্যমে যেটুকু আলোচনায় এসেছে, সেটি তথ্য না ফাঁদ? –তাও অস্পষ্ট।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
সামাজিক বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত সকল মানুষের কল্যাণের জন্য অর্থ সমর্পণ বা সম্পত্তি অর্জন। সামাজিক বিনিয়োগ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন একটা সাড়া শব্দ শুনতে পাই না। সামাজিক বিনিয়োগের ধারণা, প্রচলন, চর্চা আমাদের সমাজে নানা ভাবে ছিল। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে একটা করে কুড়াল, খন্তা, শাবল, বড় কোদাল, হাতুড়ি থাকতো।
বাড়ির পুকুর, ঘাটলা, পায়খানা, উপসানালয়, ধর্মীয় স্থান, উঠোন সবাই মিলেমিশে ব্যবহার করতো।একে অপরের বিপদে আপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিলেও স্বার্থের কারণে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হতো এবং দ্রুত মিটমাট হয়ে যেত। গ্রামীণ সমাজে মিলেমিশে এজমালী জায়গা জমি পথঘাট ব্যবহারের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখতো।
সামাজিক নানা রকমের পরিবর্তনের কারণে মানুষের মধ্যে এজমালী সম্পত্তি ব্যবহারের মন মানসিকতা নেই বললেই চলে। গ্রামের বাড়িতেও মানুষ শহরের আদলে বাড়ির উঠোনে দেয়াল তুলে উঠোন ব্যবহার অনুপোযোগী করে রেখেছে। পুকুর ঘাটে কিংবা কাচারী বাড়িতে এখন আর জমজমাট আড্ডা হয়না বললেই চলে। যে যার মতো করে জীবন যাপন করছে।
পড়শীর সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা মনে করে মন খারাপ করার লোকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। সামাজিক মালিকানার বদলে ব্যক্তি মালিকানার দাপট মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। আবার পুরোটাই সামাজিক মালিকানায় বহাল করতে চাইলে সমাজ উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়তে পারে।ফলে ব্যক্তিগত মালিকানার সাথে সামাজিক মালিকানার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
প্রবীণের সুরক্ষায় সামাজিক বিনিয়োগ কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে সে বিষয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা রাখতে চাই। বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি প্রবীণের সিংহ ভাগই গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামের প্রবীণদের বড় অংশ দরিদ্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেঁচে থাকতে ছেলে মেয়েদের সহযোগিতা লাগে।অল্প কিছু সংখ্যক প্রবীণ আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসীর দয়া করুণার উপর ভর করে জীবন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালান।
শহরে বসবাসকারী অনেকেরই গ্রামের বাড়িতে ঘর বাড়ি রয়েছে। সেখানে কেউ বসবাস করে না।বাড়ি ঘর কেয়ার টেকারের তত্ত্বাবধানে থাকে। এসব বাড়ি ঘর প্রবীণ কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা যায় ।
বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ গুলো সামাজিক ভাবে মোকাবিলা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যদিও বার্ধক্য প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত অর্জন।
প্রাথমিকভাবে বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ গুলো ব্যক্তি কেই মোকাবিলা করতে হয়। নানা কারণে ব্যক্তির পক্ষে একা বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যেক গ্রামে, ওয়ার্ডে, ইউনিয়নে প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সারাদেশে সহযোগি সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে দুই শতাধিক প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
নানা রকমের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও গ্রামের সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র প্রবীণের অধিকার, বিনোদন, চিকিৎসা, সেবা, ফিজিওথেরাপি, সালিশ মিমাংসা, তহবিল সংগ্রহ, দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্রকে সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।গ্রাম, মহল্লা, পাড়া ভিত্তিক প্রবীণদের সংঘবদ্ধ হয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণে প্রবীণ কল্যাণে গড়ে উঠা প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র গুলোকে স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে সাজাতে হবে স্বাস্থ্য সেবার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার, সাকার মেশিন,মেডিক্যাল বেড,পালস্ অক্সিমিটার, থার্মোমিটার, ব্লাড প্রেসার মেশিন, গ্লুকোমিটার, ফিজিওথেরাপি সামগ্রীসহ জীবন রক্ষা কারী ওষুধ পত্র। একই ব্যবস্থা সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে রাখা যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারের সাথে স্থানীয় প্রবীণদের মধ্যে একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র এলাকায় বসবাসরত সকল প্রবীণের নাম ঠিকানা, ফোন নাম্বার, নিকট জনের ফোন নাম্বার সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতি মাসের মিটিং চলাকালীন সময়ে যে সব প্রবীণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রয়োজন মনে করলে শারীরিক ভাবে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানোর দরকার হলে সেরকম ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দু্ঃস্থ প্রবীণদের তালিকা করে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব প্রবীণ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দরকার হলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা নিতে হবে।
প্রত্যেক এলাকা থেকে ১০/১২ জন তরুণ তরুণীকে স্বাস্থ্য সেবা কর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ করিয়ে আনতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবা কর্মীরা অসুস্থ প্রবীণদের সেবা যত্ন, হাসপাতালে ভর্তি করানো, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো,রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো, দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম সহজ উপায়ে সম্পাদনে সহযোগিতা করবে বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে। যেসব প্রবীণ সেবা মূল্য দিতে পারবেনা তাদের সেবা মূল্য কমিউনিটি থেকে দেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এলাকার আর্থিক ভাবে সামর্থ্যবান মানুষরা টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে সরকার এবং জনগণের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে তহবিল গঠন করবে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই তারা শারীরিক ভাবে প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্রে সেবা দিবে। প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র যত বেশি শক্তিশালী হবে তত বেশি প্রবীণরা শান্তি ও স্বস্তি বোধ করবে। যেসব প্রবীণ শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম তাদেরকে স্বল্প সুদে কিংবা বিনা সুদে আয় বৃদ্ধি মূলক কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে হবে। যেসব ছেলে মেয়েরা দাদা দাদি, নানা নানি, বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়িকে ভরণপোষণ এবং সেবা যত্ন করে তাদেরকে ৫%সরল সুদে ঋণ দেবার কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে প্রবীণরা সুরক্ষা পাবেন।
শিশুর মানসিক বিকাশ সামাজিকীকরণ, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক পরিবেশ এবং শিক্ষামূলক সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পরিবার শিশুর প্রথম শিক্ষাগার, যেখানে সে ভালোবাসা, স্নেহ ও নিরাপত্তা অনুভব করে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত ভাব বিনিময় শিশুর ভাষাগত দক্ষতা, আবেগগত ভারসাম্য এবং চিন্তাশক্তির বিকাশে সহায়তা করে।
একটি সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ শিশুর মানসিক বিকাশের ভিত্তি তৈরি করে।
পরিবেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে পরিবেশগত শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও চিত্রকলার মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিশুর সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং আনন্দদায়ক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে।
একটি উদার ও সংবেদনশীল সমাজ শিশুদের আত্ম-উন্নয়ন, নেতৃত্বের দক্ষতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ গঠনে সহায়তা করে। এটি তাদের মানসিক বিকাশকে সুসংহত করে এবং সমাজে কার্যকরভাবে মেলামেশার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
সর্বোপরি, একটি সুষ্ঠু পরিবেশ ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি শিশুর মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণের জন্য অপরিহার্য। সুস্থ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের জন্য শিশুদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন, যাতে তারা নৈতিকতা, মানবিকতা ও সৃজনশীলতাকে ধারণ করে ভবিষ্যতের পথচলা নিশ্চিত করতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণে সুস্থ সমাজ ও পরিবেশ এর গুরুত্ব অপরিসীম
লেখক ও গবেষক