<p>পেয়ারা চাচা আমার আব্বার ছোট ভাই। তাঁদের দুজনের বয়সের ব্যবধান অনেক। আব্বা যখন ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে চাকরি করছেন, পেয়ারা চাচা তখনও ছোট। স্কুলে পড়েন। দাদার অবর্তমানে বড়ভাই হিসাবে তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব কিছুটা পালন করতে হতো আব্বাকে।</p> <p>ছোটবেলা থেকেই পেয়ারা চাচা ছিলেন খুবই ডানপিটে। লেখাপড়ায় খুবই অমনোযোগী। সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতেন। পড়াশোনার সময় কোথায় তাঁর? পরীক্ষায় তাই তিনি ফেল করতেন বারবার। অবশ্য এনিয়ে তাঁর তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু আব্বার বেশ মাথাব্যথা ছিল এ নিয়ে। </p> <p>পেয়ারা চাচার ফেলের খবর পেলে খুব রাগ করতেন তিনি। ভবিষ্যদ্বাণী করে বলতেন, কিচ্ছু হবে না ওকে দিয়ে, অপদার্থ একটা, বংশের নাম ডুবাবে ইত্যাদি। কিন্তু পেয়ারা চাচা নির্বিকার। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর তেমন কোনো ভাবনা ছিলো না। কষ্টেসৃষ্টে ম্যাট্রিকটা পাস করলেন চাচা। </p> <p>ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন। কিন্তু তারপরই সব পাল্টে দিলো ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ। পেয়ারা চাচাকে নিয়ে আব্বার ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়ে গেল। তিনি নিজেকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়।</p> <p>কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’</p> <p>চাচা হেলাল হাফিজের কবিতা পড়েছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু তিনি তাঁর যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সীমান্ত পার হয়ে চলে গেলেন ভারতে। সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আবার ফিরে এলেন দেশে।</p> <p>আমাদের চাঁদপুর, কচুয়া এলাকায় তিনি অস্ত্রহাতে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিরুদ্ধে। ধ্বংস করেছেন তাদের ঘাঁটি। দেশের মধ্যে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা মিলে। বাঙালি শুধু মরতে নয়, মারতেও জানে একথাটি তাঁরা হাড়ে হাড়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন পাকিস্তানী হানাদারদের। রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন খানসেনাদের।</p> <p>মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ছিলেন সাধারণ মানুষ। অথচ দেশের প্রয়োজনে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যুদ্ধের সময় চাচার খবরাখবর আব্বা পেতেন লোক মারফত। ভাইয়ের সাহসিকতায় তিনি গর্ব অনুভব করতেন। আম্মাকে বলতেন, এই বার বাপের ব্যাটার মতো একটা কাজ করেছে পেয়ারা, বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তবে তাঁর ভয় ছিল এই বুঝি ছোট ভাইয়ের উপর কোনো বিপদ নেমে আসে। কিন্তু না, বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে বিজয়ীর বেশে ফিরলেন পেয়ারা চাচা। দেশ স্বাধীন হলো, শত্রুমুক্ত হলো বাংলাদেশ।</p> <p>চাচা অস্ত্র জমা দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলেন। পড়াশোনাটা শেষ করলেন। আব্বা তাকে বললেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাঁর খুব সহজেই ভালো একটা সরকারি চাকরি হয়ে যাবে এবার। চাচা শুনে হাসলেন, বললেন, মিয়া ভাই, আমিতো চাকরি পাবার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করি নাই, যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য। এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমার আর কিছু লাগবে না, আমি এতেই খুশি।</p> <p>আব্বা কোনোভাবেই তাঁকে রাজি করাতে পারলেন না মুক্তিযোদ্ধা কোটাভিত্তিক চাকরিতে যোগদান করাতে। পরে অবশ্য সংসার চালাতে একটি ছোটখাটো চাকরি তাঁকে করতে হয়েছিলো।</p> <p>দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন পেয়ারা চাচা। কিন্তু নিজের জন্য কিছু করেন নাই। সারাজীবন কষ্টেসৃষ্টে জীবন কাটিয়েছেন। জীবনের শেষে এসে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এই যুদ্ধে তিনি জয়ী হতে পারেননি। মৃত্যুর পর সমাহিত করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে গার্ড অফ অনার জানানো হয়েছিলো। তিনি না চাইলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই সম্মানটুকু তাঁর ঠিকই প্রাপ্য ছিল।</p> <p>লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী গবেষক ও লেখক</p> <p><br />  </p>