<p> দেশে ইন্সার্জেন্সি অপারেশনের ইতিহাসে বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা একটি গুরুত্ববহ নাম। মূলত এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম ইন্সারজেন্টদের উৎখাত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সাল থেকে বিভিন্ন অপারেশন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এজন্য সেসময় থেকেই সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন আছে। অপারেশন উত্তরণের পূর্ব পর্যন্ত সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল ঝুঁ্কিপূর্ণ এবং আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করা। এজন্য সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে। এমনই একজন হলেন বীর উত্তম লে. মুশফিক।</p> <p> ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির তরুণ অফিসার ছিলেন লে. মুশফিক। ১৯৮৯ সাল। ১, ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত। প্রায় প্রতিদিনই শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। কিন্তু, তা সত্ত্বেও দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে দুঃসাহসী সেনা সদস্যরা নিয়মিত অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেইসব অপারেশন ছিল দুঃসাহসিক বীরত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।</p> <p> ৮ সেপ্টেম্তর ১৯৮৯, রাত তখন আড়াইটা। লে. মুশফিকের রেডিয়াম হাতঘড়িটা সময় জানান দিচ্ছে। ঠিক চার ঘন্টা আগে লক্ষ্মীছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে ১৭ জন রেইডার্স নিয়ে চেলাছড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলেন তিনি। ক্যাম্প থেকে আসতে আসতে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে।</p> <p> পাহাড়ি পথ দুর্গম, বিপদসঙ্কুল।</p> <p> কিন্তু, দুঃসাহসী জোয়ানরা স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যস্থলে। লক্ষ্য যেন হাতছাড়া না হয়, সেজন্য সিন্দুকছড়ি ক্যাম্প থেকেও সেকেন্ড লে. সাইদ আর একটি দল নিয়ে উল্টাছড়ি গ্রামের পাশে পজিশন নেন। শত্রুর সাথে সংঘর্ষ এখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। নিজস্ব সোর্সের সহায়তায় পাহাড়ের পাদদেশে, আর চূড়ায় দুটি জুম ঘর শনাক্ত করলেন লে. মুশফিক। সোর্সের ভাষ্যমতে এ দুটি ঘরেই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অবস্থান করার কথা। দুটো উপদলকে পাহাড়ের পাদদেশে পজিশন নিতে বলে নিজে ৫ জনসহ চলে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়। জুম ঘর থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে লে. মুশফিক শুয়ে আছেন তার দলসহ। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে দেখা হয়ে গেল দুই পক্ষের ছায়া অবস্থান। মুহূর্তের মধ্যে রণক্ষেত্র হয়ে গেল সেই পাহাড়চূড়া। আর, শত্রুর প্রথম বুলেটটাই নিজের বুকে নিলেন লে. মুশফিক। গোলাগুলি শেষ করে সবাই লে. মুশফিকের চারপাশে প্রতিরোধমূলক অবস্থান (ডিফেন্স) নিলেন। উদ্ধার হল শান্তিবাহিনীর ইউনিফর্ম পরা তিনটি মৃতদেহ, দুটি রাইফেল, একটি এসএমজি। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে লে. সাইদ ততক্ষণে লে. মুশফিকের কাছে পৌঁছে যান। মুশফিকের মুখ দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন সময় খুব কম।</p> <p> আঁধার কেটে গিয়ে দিবালোক যখন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে, মুমূর্ষু মুশফিকের চারপাশে তখন নিকষ আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে মা, তারপর বাবার মুখ ভেসে উঠল; তার ওপর আঁধার মেঘ ফুঁড়ে তিনটা চেনা মুখ উঁকি দেয়; হাতছানি দিয়ে ডাকে হাবিলদার হারুন, ল্যান্সনায়েক সুনীল আর ডিএমটি নাজমুল হুদা। এর ঠিক ৯ দিন আগে বাঘাইহাট থেকে ১০ নম্বর ক্যাম্পে যাবার পথে শান্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে এরা তিনজন প্রাণ হারিয়েছিলেন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়া রানারকে সান্ত্বনা দিতে মুশফিক বলে উঠেন, 'তোমার তো সংসার আছে, পরিবার আছে, তুমি মারা গেলে তাদের কী হবে? আমি মরলে এদেশের কারো কোনো ক্ষতি হবে না।'</p> <p> ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। লে. সাইদ ছুটলেন হেলিপ্যাড বানাতে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই হেলিকপ্টার ছুটে এল। হলুদ উইন্ডশকসটা পতপত করে উড়ছে, দূর দিগন্তে পাখা জাপটিয়ে উড়ে আসা হেলিকপ্টারটা ক্রমশ বড় দেখাচ্ছে।</p> <p> কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মুশফিক ততক্ষণে হারুন, সুনীল আর নাজমুল হুদাদের সাথে মেঘেদের দেশে।</p> <p> সাতক্ষীরার ছেলে মুশফিক দূরের দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের অচেনা এক সবুজ পাহাড়ে তাঁর রানারের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। অসহায় রানার থেমে থেমে আক্ষেপে বলে উঠছে, 'গুলিটা আমার গায়ে ক্যান লাগল না স্যার...?'</p> <p> ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, দেশমাতৃকার জন্যে এভাবেই নিজের জীবন বিসর্জন দেন লে. মুশফিক। ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে 'বীর উত্তম' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম 'বীর উত্তম' উপাধি পেলেন সময়ের এক দুরন্ত সাহসী সেনা কর্মকর্তা শহীদ লে. মুশফিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা এবং শান্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এভাবেই প্রাণ দিয়ে গেছেন আমাদের বীর সেনানীরা। তাঁরা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তাঁদের বীরত্বগাথা বুকে লালন করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই হোক আমাদের ব্রত।</p> <p> [তথ্যসূত্র : সদরদপ্তর, ২৪ পদাতিক ডিভিশন, চট্টগ্রাম সেনানিবাস, চট্টগ্রাম।]</p>