২০১৭ সালের কথা। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ও হান্টিংডনের মধ্যকার সড়কের উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির সময় একটি প্রাচীন দেহাবশেষ পাওয়া যায়। শুরুতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ভেবেছিলেন, এটি হয়তো স্থানীয় কোনো সাধারণ মানুষের মরদেহ, যা সময়ের আবর্তনে ফসিলে রূপান্তরিত হয়েছে। ওই দেহাবশেষের বয়স আন্দাজ করা যায়নি তখনো।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেল, ক্যামব্রিজশায়ারে পাওয়া কঙ্কালটি দুই হাজার বছরের পুরনো এবং এটি সারমাশিয়ান নামে এক যাযাবর জাতিগোষ্ঠীর পুরুষের কঙ্কাল। এ তথ্য তখন রীতিমতো দ্বিধায় ফেলে দেয় গবেষকদের। কারণ সারমাশিয়ানরা ছিল পারস্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, যাদের বসবাস ছিল রোমান সাম্রাজ্যের আরেক প্রান্ত বর্তমান রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। অশ্বারোহী ও যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি ছিল তাদের।
আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে এখনকার রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জন্ম নেওয়া এক যুবক কিভাবে দুই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এখনকার ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন, তা এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল গবেষকদের সামনে। আর সে প্রশ্নের উত্তর তারা খুঁজেছেন দক্ষ গোয়েন্দাদের মতো।
সম্প্রতি কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে তাদের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ নিয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য। প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাদের আবিষ্কৃত কঙ্কালটির নাম দিয়েছেন অফোর্ড ক্লুনি ২০৩৬৪৫, যা মূলত ক্যামব্রিজশায়ারের ওই গ্রাম আর নমুনা সংখ্যার মিশেল।
কঙ্কালের জাতিগত পরিচয় জানা গেল যেভাবে
ক্যামব্রিজশায়ারে একটা নালার মতো জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল দেহাবশেষটি। সঙ্গে এমন কিছু ছিল না, যা দিয়ে তার পরিচয় বা আবাস সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়। পুরো কঙ্কালের মধ্যে সবচে সুরক্ষিত অবস্থায় ছিলো তার কানের ভেতরের দিকের হাড়। ওই হাড়েরই একটি ছোট টুকরা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করেছিলেন লন্ডনের ফ্র্যান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের অ্যানসিয়েন্ট জেনোমিক ল্যাবরেটরির ড. মারিনা সিলভা।
ড. সিলভার ল্যাব থেকে পাওয়া বিশ্লেষণই প্রথম জানান দেয়, কঙ্কালের মানুষটি আসলে রোমান সাম্রাজ্যের দূরতম এক প্রান্ত থেকে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো জীবিত মানুষের ডিএনএ টেস্ট করার মতো নয় ব্যাপারটা। কারণ এর ডিএনএ একরকম ভাঙাচোরা অবস্থায় ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমই যেটা চোখে পড়ল, অন্য রোমানো-ব্রিটিশদের চেয়ে জিনগতভাবে অনেক আলাদা এই মানুষটি।’
আগে ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে ধারণা পেতে দালিলিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণপত্রের ওপর নির্ভর করতে হতো, আর সেসবে মোটা দাগে আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের কথাই থাকে। তবে হাল আমলে গবেষণার পদ্ধতিগত উৎকর্ষের কারণে ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই এখন সেসব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বড় বড় ঐতিহাসিক ঘটনার নেপথ্যে থাকা সাধারণ মানুষের অজানা গল্পও বের করে আনা সম্ভব হয় এখন। যেমন হাড়ের ফসিলে লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের পুরনো জেনেটিক কোড বলে দিতে পারে যে কারো নৃতাত্ত্বিক পরিচয়।
অফোর্ড ক্লুনিকে নিয়ে করা গবেষণাটিতে তো রীতিমতো গোয়েন্দা গল্পের আঁচ পাওয়া যায়, যেন এটি একটি ফরেনসিক তদন্তপ্রক্রিয়া। একজন সাধারণ মানুষ, যিনি ১২৬ থেকে ২২৮ সালের মধ্যকার কোনো সময়ে তার ২৫ বছরের জীবন কাটিয়েছেন। রোমানদের অধিকৃত ব্রিটেনের ক্যামব্রিজশায়ারে নালার মত কোনো এক জলাধারে যার কবর হয়েছিল। তার জীবন সম্পর্কে দুই হাজার বছর পরে এসে জানা যাচ্ছে এই গবেষণার বদৌলতে।
পিতৃভূমি থেকে এতটা দূরে যে এসেছিলেন, তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া গেল
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা আরেকটি গবেষণা কৌশল ব্যবহার করেন। তারা ফসিল হয়ে যাওয়া মানুষটির দাঁত পরীক্ষা করেন, যাতে ওই ব্যক্তির গ্রহণ করা খাদ্যবস্তুর রাসায়নিক ছাপ পাওয়া যায়।
বিশ্লেষণে উঠে আসে, পাঁচ বছর বয়স থেকে পরবর্তী সময়ে তার খাদ্যাভ্যাস কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। গাছের কাণ্ডের চক্রাকার দাগ থেকে যেমন সেটি কী ধরনের পরিবেশ, আবহাওয়া আর সময়ের মধ্য দিয়ে এসেছে তা জানা যায়। একইভাবে মানুষের দাঁতের প্রতিটি স্তরেও সেটি কী ধরনের উপাদানের সংস্পর্শে এসেছে তার প্রভাব থেকে যায়। তার ফলে জানা যায় ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাসের ধরন।
ছয় বছর বয়স পর্যন্ত জোয়ার ও বাজরার মতো শস্যই ছিল অফোর্ডের প্রধান খাদ্য। তখনকার দিনে সারমাশিয়ান অধ্যুষিত অঞ্চলে এই ধরনের শস্য প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক জ্যানেট মন্টগোমারি বলেন, ‘কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার খাদ্য তালিকায় এসবের বদলে গমের আধিক্য দেখা দিয়েছিল, যা মূলত পশ্চিম ইউরোপের ফসল।’
অধ্যাপক জ্যানেট আরো বলেন, ‘এ থেকে আমরা জানতে পারি, তার গোষ্ঠীর মধ্যে হয়তো তিনিই প্রথম ব্রিটেনে এসেছিলেন। পরিণত বয়সে পশ্চিমের অভিবাসী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খাদ্য তালিকা থেকে আগের শস্যগুলো বাদ পড়ে গিয়েছিল।’
আর ঐতিহাসিক নানা তথ্য-প্রমাণে জানা যায়, ওই সময়ে রোমান সেনাবাহিনীতে কর্মরত সারমাশিয়ানদের একটি দলকে ব্রিটেনে মোতায়েন করা হয়েছিল। এমন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, অফোর্ড কোনো অশ্বারোহীর ছলে হতে পারেন। কিংবা দাসও হয়ে থাকতে পারেন।
খননকাজে নেতৃত্ব দেয়া মিউজিয়াম অব লন্ডনের আর্কিওলজি বিভাগের ড. অ্যালেক্স স্মিথের মতে, ডিএনএর সূত্রে এমন একটা ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এটাই প্রথম বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স।’
ড. স্মিথ বলছিলেন, ‘ডিএনএ প্রাপ্তি ও রাসায়নিক বিশ্লেষণের কৌশলের সুবাদে আমরা এখন অন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারছি। জানতে পারছি রোমান শাসনামলে সমাজের গঠন, বিন্যাস ও বিবর্তনের ব্যাপারে। বোঝা যাচ্ছে, শুধু শহরগুলোতেই নয়, সে সময়ের গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপক যাতায়াত ও স্থানান্তর ঘটত মানুষের।’
ক্রিক ইনস্টিটিউটের অ্যানসিয়েন্ট জেনোমিক ল্যাবরেটরির প্রধান ড. পন্টাস স্কগল্যান্ড বিবিসি নিউজকে বলেন, ‘নতুন প্রযুক্তি ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ায় রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছে।’
ড. স্কগলান্ডের ভাষ্য, ‘প্রাচীন ডিএনএর হালনাগাদ বিশ্লেষণ প্রস্তর আর ব্রোঞ্জ যুগ সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা বাড়িয়েছে। আর এখন, উন্নত কলাকৌশলের কারণে রোমান ও পরবর্তী সময়টাও ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে ধরা দিচ্ছে আমাদের কাছে।’