ইতালির সরকার দেশের নাগরিকত্ব আইন আরো কঠোর করেছে। সমালোচকরা বলছেন, অনেকেই শুধু বিশ্বজুড়ে ভ্রমণের সুবিধার্থে পারিবারিক বংশধারা অনুসন্ধান করে ইতালীয় পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, যাদের প্রকৃতপক্ষে দেশটির সঙ্গে তেমন কোনো বাস্তব সংযোগ নেই।
এখন থেকে ইতালীয় বংশোদ্ভূত কমসংখ্যক ব্যক্তি নাগরিকত্ব পাবেন। কারণ নতুন নিয়মে শুধু যাদের মা-বাবা বা দাদা-দাদি ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারাই নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন।
সরকার জানিয়েছে, অভিবাসীদের বংশধারা অনুসন্ধান করে বিপুল পরিমাণ নাগরিকত্ব আবেদন জমা পড়ায় এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ইতালির আগের নাগরিকত্ব আইন কী ছিল?
আগের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ যদি প্রমাণ করতে পারতেন, তার কোনো ইতালীয় পূর্বপুরুষ ১৮৬১ সালের ১৭ মার্চের পর জীবিত ছিলেন (যেদিন ইতালির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়), তাহলে তিনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারতেন।
তবে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি বলেছেন, এই নিয়ম পুরনো এবং আইন পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হলো ‘অপব্যবহারকারী’দের দমন করা, যারা শুধু ভ্রমণসংক্রান্ত বিধি-নিষেধ এড়াতে ইতালির নাগরিকত্ব গ্রহণ করছিলেন।
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স অনুযায়ী, ইতালির পাসপোর্ট বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী পাসপোর্ট, যা ভিসামুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল ভ্রমণের বিশাল সুবিধা দেয়।
এ কারণেই এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং এত দিন তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য ছিল।
রোমে এক সংবাদ সম্মেলনে তাজানি বলেন, ‘ইতালির নাগরিক হওয়া গর্বের বিষয়। এটি কোনো খেলা নয়, যেখানে শুধু পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য কেউ ইতালীয় হতে পারে এবং তারপর মায়ামিতে কেনাকাটা করতে যায়।’
নতুন নিয়ম কী?
শুক্রবার ঘোষিত নতুন ডিক্রি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে।
সেখানে ‘জুস স্যাঙ্গুইনিস’ (রক্তসূত্রের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব) পদ্ধতিতে যোগ্যতার শর্ত কঠোর করা হয়েছে। এখন থেকে শুধু যাদের মা-বাবা বা দাদা-দাদির অন্তত একজন ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাবেন। তবে বর্তমানে যেসব ৬০ হাজার আবেদন পর্যালোচনাধীন রয়েছে, সেগুলো এই আইনের আওতায় আসবে না।
এ ছাড়া দ্বৈত নাগরিকত্বধারীরা যদি ইতালির প্রতি ‘নিষ্ঠার প্রমাণ’ না দেখান, যেমন কর প্রদান, ভোটদান বা পাসপোর্ট নবায়ন না করেন, তাহলে তাদের ইতালীয় নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকি থাকবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো, ইতালির বিদেশি কনস্যুলেটগুলো আর নাগরিকত্ব আবেদন প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে না।
এখন থেকে সব আবেদন অনলাইনে কেন্দ্রীয়ভাবে ইতালির ফেডারেল সরকার পরিচালনা করবে এবং আবেদনকারীদের জন্য ইতালিতে গিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে।
এই পরিবর্তনের প্রভাব কতটা বিস্তৃত?
ইতালির পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মন্ত্রণালয়ের মতে, আগের নিয়ম অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে ছয় থেকে আট কোটি মানুষ ইতালির নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য ছিলেন, যা ইতালির মোট ৫.৯ কোটি জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকায় ইতালীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে আবেদন করছিলেন। কারণ ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইতালির অনেক মানুষ দরিদ্রতা থেকে বাঁচতে এই অঞ্চলে অভিবাসী হয়েছিলেন।
২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইতালির নাগরিকত্বধারী অভিবাসীদের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে, যা ৪৬ লাখ থেকে ৬৪ লাখে পৌঁছেছে। এর একটি বড় অংশ নবনাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে। শুধু আর্জেন্টিনায় ২০২৩ সালে যেখানে ২০ হাজার জন নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন, ২০২৪ সালে সেটি বেড়ে ৩০ হাজার হয়েছে। একই সময়ে ব্রাজিলে ১৪ হাজার থেকে বেড়ে ২০ হাজার জন নাগরিকত্ব পেয়েছেন।
ইতালি কেন এই পরিবর্তন আনল?
বংশপরম্পরায় নাগরিকত্ব পাওয়ার নিয়মের সমালোচকরা বলছেন, এতে এমন লোকজন নাগরিকত্ব পাচ্ছিলেন যাদের ইতালির সঙ্গে বাস্তবিক কোনো সম্পর্ক নেই।
তাজানি বলেছেন, ‘যাদের পূর্বপুরুষ শতাব্দী আগে ইতালি ছেড়েছেন এবং যাদের ইতালির সংস্কৃতি বা ভাষার সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই, তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়া উচিত নয়।’
তিনি আরো জানান, কিছু প্রতিষ্ঠান বিপুল অর্থের বিনিময়ে মানুষের পূর্বপুরুষের ইতালীয় পরিচয় খুঁজে দিচ্ছিল, যাতে তারা নাগরিকত্ব পেতে পারেন। একই সঙ্গে বলেন, ‘আমরা কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি, যেন কেউ ইতালীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানাতে না পারে।’
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ভ্যালেন্টিনো লারসিনিস বলেন, পুরনো ব্যবস্থা ইউরোপীয় শ্রমবাজারে প্রবেশ সহজ করত এবং এর অপব্যবহার হতো। তার মতে, পাসপোর্টের ক্ষেত্রে কিছু সীমা নির্ধারণের ধারণাটি যুক্তিসংগত।
এ ছাড়া নাগরিকত্ব আবেদনের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইতালির কনস্যুলেট ও পৌরসভাগুলো অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়েছিল। এটি সামলাতেই কেবল কেন্দ্রীয় সরকারকে আবেদনপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
আরেকটি বড় সমালোচনা হলো, বংশপরম্পরায় নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ হলেও ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী অভিবাসী শিশুদের জন্য নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন। বর্তমানে ইতালিতে বসবাসরত আইনসিদ্ধ অভিবাসীদের সন্তানরা ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর এবং শৈশব থেকে ইতালিতে থাকার প্রমাণ দিলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।
লারসিনিস বলেন, ‘ইতালির অভিবাসী শিশুদের নাগরিকত্ব পাওয়ার জটিলতা বহিরাগতদের পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে বিতর্কের চেয়েও বড় সমস্যা।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইতালিতে নাগরিকত্ব সহজ করার জন্য আসন্ন ৮-৯ জুন ভোট হবে। এই প্রস্তাবের আওতায় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ইতালিতে বসবাসের আবশ্যক সময়সীমা ১০ বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছর করার বিষয়টি বিবেচনায় আনা হবে। আর একবার ইতালির নাগরিকত্ব পাওয়া গেলে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সন্তানদের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
অন্য দেশগুলো কী করছে?
ইতালি ও ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ বংশপরম্পরায় নাগরিকত্ব প্রদান করে থাকে। তবে প্রতিটি দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বিভিন্ন শর্ত থাকে। হাঙ্গেরিতে বংশোদ্ভূতরা নাগরিকত্ব পেতে পারেন, তবে তাদের ভাষাগত দক্ষতা প্রমাণ করতে হয়। পোল্যান্ডে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে হয়। পর্তুগালের ক্ষেত্রে সেফার্দি ইহুদিরা তাদের ঐতিহাসিক পূর্বপুরুষের সংযোগ প্রমাণ করলে পাসপোর্ট পেতে পারেন।
এদিকে অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করছে বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বন্ধের ঘোষণা দেন। যদিও এটি ১৯ ফেব্রুয়ারি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, তবে এক ফেডারেল বিচারক এটি অসাংবিধানিক বলে আটকে দিয়েছেন।
বিশ্ব জনসংখ্যা পর্যালোচনাবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের হিসাবে অন্তত ৩৩টি দেশে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের নিয়ম রয়েছে, যার বেশির ভাগই মেক্সিকোসহ উত্তর ও লাতিন আমেরিকায়।