আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, প্রবৃদ্ধি অর্জন ও রিজার্ভ বাড়ানোর যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে পর্যালোচনায় বলেছে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
সংস্থাটি বলেছে, বাজার চাহিদা নিয়ন্ত্রণে সুদহার এত দেরিতে বাড়ানো হয়েছে যে এর আগেই চাহিদা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে। আর সরবরাহব্যবস্থায় ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়ান। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
বরং কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সঠিক সময়ে যদি যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে ২০২৫ সাল শেষে দেশের অর্থনীতি উন্নতির বদলে আরো খারাপ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বাড়ানোর সময় নয়। নিকট ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা প্রধান কাজ। পাশাপাশি দরিদ্রদের স্বস্তি দিতে আরো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম আয়োজিত বাজেট পর্যালোচনায় এমন মতামত দেওয়া হয়। শুরুতে বাজেটের ওপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা। পরে বক্তব্য দেন নির্বাহী পরিচালক।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বক্তারা।
অনুষ্ঠানে গবেষণা সংস্থাটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটের আকার আরো ছোট করার পাশাপাশি দরিদ্রদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে। তারা জানিয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেট পাস হলে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে। বাজেটের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নেতিবাচক।
অর্থনীতিতে এক বছর আগের তুলনায় উদ্বেগের মাত্রা এখন আরো বেড়েছে। যদি আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির ফান্ডামেন্টালগুলো ঠিক করতে না পারি, তাহলে কী অর্থনীতি আরেক বছর পর আরো খারাপ হবে। এখনই যদি মৌলিক দিকগুলো নিয়ে কাজ না করা হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ বাড়বে।’
তিনি বলেন, টানা ১৫ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে বাংলাদেশ। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ফিরছে না। সময়মতো সংস্কার না হওয়ায় অর্থনীতির ভিত্তিগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এ জন্য বৈশ্বিক ধাক্কার ধকল সইতে পারছে না। এ বাস্তবতায় অর্থনীতি সঠিক পথে ফেরাতে ব্যাংক ও রাজস্ব খাতে দ্রুত সংস্কার শুরু করতে হবে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় রয়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো উচিত ছিল। রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে করের আওতা না বাড়িয়ে গতানুগতিকভাবে কেবল প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ওপর করের বোঝা আরো বাড়বে।
তিনি বলেন, ‘অতি ধনীদের করের আওতায় আনা না গেলে এবং ন্যায্যভাবে কর আদায় করতে না পারলে কর ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা আসবে না। কালো টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ সাংবিধানিক চেতনাবিরোধী। এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’
সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সায়েমা হক মূল বক্তব্যে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। মোটা দাগে বলতে গেলে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের ক্ষয় এখন বড় বিষয়। সে জন্য বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে, কিছু পণ্যের উৎস কর কমানো হয়েছে ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হয়েছে। এটা ভালো দিক। এর সুফল কিছু জনগণ পাবে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এটি অর্জন করতে হলে বাজেট ছোট করার পাশাপাশি আরো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাজেটে সে ধরনের কিছু নেই।
সায়েমা হক বলেন, করহার বাড়ানোর দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়েছে, করের আওতা বাড়ানোর দিকে সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি, যা মধ্যবিত্তকে স্বস্তি দেওয়ার বদলে অস্বস্তি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো এমনিতে তারল্য সংকটে আছে, ঘাটতি মোকাবেলায় ব্যাংকঋণ নেওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিলে (ছাপিয়ে) মূল্যস্ফীতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আর্থিক খাত নিয়ে সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে; কিন্তু খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংক খাত সংস্কারে কোনো পদক্ষেপ বাজেটে দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া উচিত নয়। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যেতে পারে।
দুর্নীতি তদন্তে সংসদীয় কিমিটি হোক : সানেম
সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিদের অবসরে যাওয়ার পরে দুর্নীতির যে চিত্র উঠে আসছে, এসব ব্যাপারে সংসদ থেকেই তদন্ত কমিটি করা প্রয়োজন। বর্তমানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে বড় পরিসরে শক্তিশালী সংসদীয় কমিটি করা দরকার। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা অনুমোদন না করার জন্য সংসদ সদস্যদের আহবান জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যদিও তদন্ত করছে। আরো অনেক কমিটিও আছে। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগগুলো কার্যকর হচ্ছে না। এ জন্য দুর্নীতিবিরোধী উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংসদীয় কমিটি করা দরকার। তারা দুর্নীতি প্রতিরোধে নেওয়া উদ্যোগগুলো মনিটরিং করবে এবং সংসদের কাছে জবাববদিহি থাকবে।
অনুষ্ঠানে সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ইশরাত হোসাইন, আফিয়া মোবাশ্বিরা তিয়াশা, নাফিসা জামানসহ অন্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।