জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতার পালাবদলের পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একাত্তরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্প। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্বিচার গণহত্যার সাক্ষী হিসেবে ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ২০১৮ সালে চালু হওয়া এ প্রকল্পটি জমি অধিগ্রহণসহ নানা কারণে বন্ধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার। তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ইতিহাস রক্ষার খাতিরেই এই বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য।
মন্ত্রণালয় সূত্র ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুরু থেকেই ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতাসহ বেশ কিছু সমস্যার কারণে প্রকল্পটি এগিয়েছে শামুকের গতিতে। গত সাড়ে ছয় বছরে মাত্র ৪৩টি বধ্যভূমির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা।
বর্তমানে প্রকল্পটির অধীনে ৯টি বধ্যভূমির কাজ চলমান রয়েছে, আরো তিনটির কাজ শুরু হবে।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২৮১টির মধ্যে ৫৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রকল্পটির সমাপ্তি টানা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি ক্লোজ (বন্ধ) করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের টার্গেট ছিল (বন্ধের আগে) ৫৭টি বধ্যভূমির কাজ শেষ করা। কিন্তু ৫৫টা করেই বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আগামী জুনের মধ্যেই শেষ করা হবে। শুধু রায়েরবাজার বধ্যভূমির কাজ শেষ করতে ডিসেম্বর লেগে যাবে।’
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব বধ্যভূমি আমরা নিরঙ্কুশ পেয়েছি সেগুলোর কাজ শেষ হবে। আর যেগুলোর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে সেগুলো আমরা বাতিল করেছি। একজন লোক জানে তার জমিতে বধ্যভূমি আছে।
কিন্তু যদি এটা (জমি) দামি জমি হয়, তাহলে তার কাছে এর (বধ্যভূমি) কোনো পবিত্রতা বা ভ্যালু নেই।’
তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আকর এসব বধ্যভূমি আর সংরক্ষণ করা হবে না? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘মানুষের জায়গা অধিগ্রহণ করে সরকার এটা সংরক্ষণ করবে না। স্বেচ্ছায় যদি কেউ জমি দেয় তাহলে আমরা এটা করব।’
২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রায় ৪৪২ কোটি (৪৪২ কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার) টাকার প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বেড়েছে দুই দফায়। কাজের তেমন অগ্রগতি না থাকায় ২০২১ সালে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। ২০২৩ সালের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় আবারও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়।
তবে দুই দফা মেয়াদ বাড়ালেও প্রকল্পটির অগ্রগতির চিত্র হতাশাজনক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৩টি বধ্যভূমির কাজ শেষ হয়েছে। অর্থাৎ অগ্রগতি মাত্র ১৫.৩ শতাংশ। এ ছাড়া আরো ১২টি বধ্যভূমির কাজ শেষ করা হবে।
মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশির ভাগ বধ্যভূমির জায়গাই ব্যক্তি মালিকানাধীন। বধ্যভূমির জন্য ভূমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব পুরোটাই জেলা প্রশাসনের ওপর। মন্ত্রণালয় থেকে জায়গার জন্য চাহিদা দেওয়া হয়। এরপর দাগ ও বিভিন্ন নথি দেখে জায়গা চূড়ান্ত করে দিলে অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই জায়গা চূড়ান্ত হচ্ছে না, অধিগ্রহণও হচ্ছে না।
ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যার পর লোকবল সংকটকে সবচেয়ে বড় কারণ বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র। নেই কোনো স্থায়ী পরিচালক। দীর্ঘদিন ধরেই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের কাজ করছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাহাঙ্গীর আলম। মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজের বাইরে তাঁকে এই দায়িত্বটি পালন করতে হয়।
জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি দেখার জন্য মাঠ পর্যায়ে কোনো লোক নেই। ফলে এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার কিছু কাজ কখনো কখনো ‘অন রিকোয়েস্টে’ প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দিয়ে করানো হয় বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘জমিই তো পাওয়া যায় না। জায়গার সমস্যা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার মধ্যেই আমরা বন্ধ করে দিলাম। কারণ এভাবে এগোনো যায় না।’
গণহত্যার বেদনাবিধুর স্মারক বধ্যভূমি, রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চালানো নৃশংস গণহত্যার বিভিন্ন স্মৃতি ও ক্ষতচিহ্ন আজও অনেকটা অনাদরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেশজুড়ে। ২০১৭ সাল থেকে খুলনায় অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ জেলাভিত্তিক গণহত্যার জরিপকাজ পরিচালনা করছে। জরিপে দেখা গেছে, কেবল ৪২টি জেলায়ই ২১ হাজার ৮৫৬টি গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে ১৮ হাজার ৪৮১টি। বধ্যভূমি শনাক্ত হয়েছে ৮৮৮টি। এ ছাড়া গণকবর এক হাজার ৩১৩টি ও নির্যাতনকেন্দ্র শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ১৭৪টি। ৬৪ জেলার জরিপ শেষে গণহত্যা, গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্রের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন জাদুঘরের গবেষকরা।
এমন বাস্তবতায় সরকারের বধ্যভূমি সংরক্ষণের চিন্তা থেকে সরে আসা এবং এগুলোকে অবহেলা করা ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা অবশ্যই কর্তব্য। আমাদের তো ইতিহাসকে রক্ষা করতে হবে এবং চর্চা করতে হবে। এর জন্য ইতিহাসের স্মৃতিগুলো রাষ্ট্রের সংরক্ষণ করতে হবে। না হলে মানুষ তো সব ভুলেই যাবে। শহীদদের আত্মত্যাগকে ভুললে চলবে না।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের নির্বিচার গণহত্যা, নৃশংসতা ও বেদনার সাক্ষ্য বহন করে। এর স্মারক হচ্ছে বধ্যভূমিগুলো। ফলে পরিকল্পিতভাবে বধ্যভূমি সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। আমি আশা করছি, বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়টি সরকার পুনরায় বিবেচনা করবে।