চলতি মৌসুমে একের পর এক ধাক্কায় বিপর্যস্ত সিলেটের পর্যটন খাত। তিন দফায় বন্যার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও কারফিউয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ খাত। এতে চলতি মৌসুমে পর্যটন খাতের ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এমন চলতে থাকলে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মূলত করোনার পর থেকে এই খাতে শনির দশা চলছে। এরপর বাইশের বন্যাসহ লাগাতার আঘাত সিলেটের পর্যটনকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে না দাবি তাঁদের।
সিলেটের বেশির ভাগ পর্যটনকেন্দ্র জলকেন্দ্রিক। প্রকৃতিকন্যা জাফলং কিংবা সাদা পাথর, রাতারগুল, পান্থুমাই, মায়াবি ঝরনা, লালাখালের মতো জনপ্রিয় কেন্দ্রগুলো জলকেন্দ্রিক।
তাই বর্ষা মৌসুম সিলেটের পর্যটনের উত্কৃষ্ট সময়। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই পাঁচ মাস পর্যটনের ভরা মৌসুম। অথচ চলতি মৌসুমের শুরুতেই পর্যটনে বড় ধাক্কা দেয় বন্যা। বন্যার কারণে ঈদের বড় ব্যবসাও হাত ছাড়া হয়। তিন দফা বন্যার পর সব কিছু গুছিয়ে ওঠার আগেই দেশের সহিংস পরিস্থিতি ও কারফিউ মিলে বিরাট বিপর্যয়ে এ খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত ১০ জুলাইয়ের পর সিলেটের বেশির ভাগ হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টে কোনো বুকিং পড়েনি। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নেমেছে সুনসান নীরবতা।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সিলেটের সাদা পাথর সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে রাজ্যের নিস্তব্ধতা। নৌকাঘাটের শত শত দোকানের হাতে গোনা কয়েকটি খোলা।
বাকিগুলো বন্ধ পড়ে আছে। রেস্টুরেন্টগুলো খোলা থাকলেও ভেতরে খাঁ খাঁ শূন্যতা। পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা অফুরন্ত অলস সময় কাটানোর চেষ্টা করছেন আড্ডায় আর মোবাইল গেইমসে।
সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সময়টায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতি সপ্তাহে লাখের অধিক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসে। মাসে সে সংখ্যা চার থেকে পাঁচ লাখ ছাড়ায়। দুই ঈদে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় জমে। কিন্তু এবার দফায় দফায় বন্যা আর দেশের সহিংস পরিস্থিতি সাদা পাথরকে পর্যটকশূন্য করে দিয়েছে। ফলে বিপর্যয়ে পড়েছেন তাঁরা। সেখানকার হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কসমেটিকস ব্যবসায়ীরা কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
সাদা পাথর পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সফাত উল্লাহ বলেন, ‘পর্যটন এলাকার শতাধিক কসমেটিকসের দোকান, ১০টি রেস্তোরাঁ, কয়েকটি হোটেল, রিসোর্ট, শতাধিক ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শত শত নৌকা রয়েছে। পর্যটকদের ওপরই মূলত তাঁদের ব্যবসা, জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। শুধু ঈদ মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কিন্তু বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত এক মাসে আমাদের ৯০ শতাংশ ব্যবসা কমে গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
একই পরিস্থিতি অন্যসব পর্যটনকেন্দ্রের। জাফলং গ্রিন রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবলু বখত বলেন, ‘ঈদের দিন থেকে এখন পর্যন্ত রুম বুকিংয়ের অবস্থা চরম খারাপ। বন্যার কারণে ঈদে ব্যবসা হয়নি। এতে ব্যবসায় বড় ধাক্কা খেয়েছি। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর কয়েক দিন পর্যটক এলেও চলমান সহিংস পরিস্থিতির কারণে আবার বিপর্যয়। এভাবে পুরো মৌসুম গেলে আমাদের জন্য টিকে থাকা কঠিন হবে।’
হোটেল, মোটেল ও রেস্ট হাউস অনার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া লিপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত রমজানের পর থেকেই ব্যবসায় বিপর্যয়। তখন অধিক তাপমাত্রার কারণে হিট স্ট্রোকের ভয়ে অনেকে মুভ করেননি।’
হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার দুটি হোটেলে প্রতিদিন ব্যয় আড়াই লাখ টাকা। অথচ আয় শূন্য টাকা। সিলেটে শত শত হোটেল-মোটেল আছে। তাহলে হিসাব করেন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ।’
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন বলেন, ‘চলতি মৌসুমে পর্যটন খাতে সিলেট জেলার ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে।’