মার্কিন প্রশাসক ট্রাম্প বাংলাদেশি পোশাকে রপ্তানি শুল্ক ৩৭ শতাংশ করার পর একের পর এক দুঃসংবাদ আসতে শুরু করেছে দেশে তৈরি পোশাক খাতে। এরই মধ্যে ঢাকার সাভারের এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রডাক্টস নামের প্রতিষ্ঠান চলতি সপ্তাহে তিন লাখ মার্কিন ডলারের চামড়ার ব্যাগ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে জাহাজীকরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
কিন্তু রবিবার সকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বার্তা পাঠিয়ে পণ্য জাহাজীকরণ না করার নির্দেশনা দেন। একই অবস্থা চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকার গার্মেন্টস ড্রেস কিং লিমিটেডের।
তাদেরও সাড়ে ছয় লাখ মার্কিন ডলারের বাচ্চাদের কাপড় জাহাজীকরণ না করার কথা জানিয়েছে ক্রেতারা। ক্রয়াদেশ স্থগিতের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে দেশের তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের মতোই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলার মূল্যমানের দ্রব্য রপ্তানি করেছিল দেশটি। এর মধ্যে তৈরি পোশাকের অর্থমূল্য ছিল প্রায় ৭৩৪ কোটি ডলার। গত আগস্টে বাংলাদেশে ব্যাপক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রাথমিকভাবে অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়ে তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন। কয়েক মাসে অনেকটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও নতুন মার্কিন শুল্কের আঘাতে আবারও যেন খড়্গ নেমে আসে পোশাকশিল্পের ওপর। আগে থেকেই বাংলাদেশের তুলাজাত পণ্য মার্কিন মুলুকে আমদানিতে ১৬ শতাংশ শুল্কের বোঝা ছিল, সেটাকে এক লাফে ৩৭ শতাংশ করেছেন ট্রাম্প।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) নেতারা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর মার্কিন ক্রেতারা এখন জাহাজীকরণ হয়েছে এমন পণ্যের ক্ষেত্রেও মূল্যছাড় দাবি করছে। তারা আগামী জুনের ক্রয়াদেশও স্থগিত করেছে। জুলাই থেকে পণ্য পাঠাতে হবে না তা জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ক্রেতা। উইকিটেক্স বিডি নামে একটি বায়িং হাউসের তিন লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ ৬ এপ্রিল স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকার গার্মেন্টস ড্রেস কিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুর শক্কুর কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, আমরা কিছু ফ্যাব্রিকস আনছি, আর কিছু আনার পথে। যেগুলো আনছি সেগুলো কাটিং (তৈরি করা শুরু হয়েছে) এ চলে গেছি। উৎপাদন হতে সময়ও আর বেশি দিন লাগত না। এর মধ্যে গত পরশু (৫ এপ্রিল) বায়ার মেইল করেছে, যে ট্যারিফ, তাতে তাদের খরচ বেশি হয়ে যাবে। তাই কিছু ছাড় দিতে হবে। আমরা উত্তর দিছি, যেগুলো এরই মধ্যে উৎপাদনে চলে গেছে, সেগুলোতে ছাড় দেওয়া সম্ভব না। বাকিগুলো আপনারা নিতে না চাইলে আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দেব। ছাড় দিয়ে পোশাক উৎপাদন করতে হলে অনেক বেশি লোকসান দিতে হবে। তাই ছাড় দিয়ে উৎপাদন করব না—এমন সিদ্ধান্ত বায়ারকে জানিয়ে দিয়েছি।
তিনি বলেন, গত বছর আমার প্রতিষ্ঠানে ৫৬ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ পেয়েছিলাম। এবার বায়ার যে ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে সেটা সাড়ে ছয় লাখ ডলারের। স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশে বাচ্চাদের কাপড় ছিল।
এদিকে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টায় মার্কিন ক্রেতাদের উদ্দেশে চিঠি লিখেছেন পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন। তিনি বলেছেন, শুল্কনীতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। কিন্তু উৎপাদকদের ওপর সরাসরি সব বোঝা চাপিয়ে দিলে ভোগান্তির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ এই সংকট সমাধানের যুক্তিসংগত একটি উপায় খুঁজছে। এ সময় আমাদের সমর্থন দিতে সবাইকে অনুরোধ করছি।
মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েল গ্রুপ। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এবং ওয়েল গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা আতঙ্কে আছি। হাতে থাকা রপ্তানি আদেশ এবং শিপমেন্ট হওয়া পণ্যে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তি অনুযায়ী মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দাবি করছে। ছাড় দিয়ে পোশাক রপ্তানি করতে হলে আমরা বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ব। তিনি বলেন, বেশ কিছু কারখানার মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পরবর্তী বার্তা না দেওয়া পর্যন্ত এরই মধ্যে দেওয়া রপ্তানি আদেশের কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে। নির্দিষ্ট করে ক্রেতারা কাঁচামাল আমদানি, পণ্য উৎপাদন ও শিপমেন্ট আপাতত স্থগিত রাখতে বলেছেন।