<p>ঐতিহাসিকদের মতে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে হিন্দের পুত্র ‘বং’-এর মাধ্যমে আমাদের এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। তাঁর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয় বঙ্গ। হিন্দ হচ্ছেন হজরত নূহ (আ.)-এর প্রপৌত্র। আরবিতে ‘আল’ অর্থ বংশধর। বংআল বা বঙ্গাল অর্থ বং-এর বংশধর। এ সূত্রেই পরবর্তী সময় বঙ্গাল অধ্যুষিত জনপদের নাম হয় বঙ্গাল বা বংলা। (কাজী দীন মুহম্মদ, বাংলা সাহিত্যে আমাদের অবদান)</p> <p>কোন অতীতকালে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল তা আজও প্রশ্নাতীতভাবে উদ্ঘাটিত হয়নি। কোনো কোনো গবেষকের মতে এর উত্পত্তি হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে। আর অনেকের মতে সপ্তম শতাব্দীতে। তবে আধুনিক গবেষকরা বলেছেন, বাংলা ভাষার উত্পত্তি উল্লিখিত সময়েরও আগে। তাঁদের মতে, দ্রাবিড়গণ ৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে দক্ষিণ আরব থেকে বাংলালিপি নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং সে সময় থেকেই আরবদের সঙ্গে এ দেশের সংস্কৃতি ও ভাষাগত সম্পর্কের সূচনা হয়। জীবনবিধান ইসলামের আবির্ভাবের পর আরবি ভাষা অত্যন্ত ব্যাপকতা ও সমৃদ্ধি লাভ করে এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বণিক ও সুফি দরবেশদের মাধ্যমে এ এলাকায় আরবি ভাষা ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।</p> <p>কালের প্রবাহে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দের প্রবেশ ঘটেছে। গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষায় প্রায় সোয়া লাখ শব্দ আছে। এর মধ্যে ১০ হাজার আরবি-ফারসি, এক হাজার ইংরেজি ও ৪০০ তুর্কি শব্দ আছে। কারো কারো মতে ৩০ শতাংশ শব্দ হচ্ছে আরবি। বাংলা ভাষা নিজেকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করার জন্য এসব শব্দকে এমনভাবে আত্মস্থ করেছে যে এখন আর তা বিদেশি শব্দ বলে মনে হয় না। নিজেদের প্রয়োজনে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করে থাকি। এই শব্দাবলির মধ্যে কিছু রয়েছে আসল রূপে আবার কিছু আছে পরিবর্তিত রূপে।</p> <p>বংলায় আগত আরবি শব্দগুলো কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। এক. প্রশাসনিক ও আইন-আদালত সম্পর্কীয় শব্দ। যেমন—আরজি, আলামত, উকিল, এজলাস, কসম, কানুন, খারিজ, মৌজা, মহকুমা, রায়, হাজত ইত্যাদি। দুই. ধর্ম সম্পর্কীয় শব্দ। যেমন—আল্লাহ, আখিরাত, ঈদ, ইমান, কিয়ামত কোরআন, কুরবানি, জান্নাত, জাহান্নাম, তওবা ইত্যাদি। তিন. শিক্ষা-সংক্রান্ত শব্দ। যেমন—উস্তাদ, কলম, কিতাব, কুরসি, খাতা, গায়েব, তরজমা, দাখিল, দোয়াত, নগদ, মুন্সি, হাজির ইত্যাদি। চার. সংস্কৃতি ও বিবিধবিষয়ক শব্দ। যেমন—আক্কেল, আদম, আদাব, আতর, অজু, কবর, কিসমত, খাস, তাওফিক, তাসলিম, তাজ্জব, তামাদ্দুন, তালিম, তাহজিব, দুনিয়া, বিদায়, মজলিস, মনজিল, মাকসুদ, মাহফিল, হাশর ইত্যাদি।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2016/print-2016/February/26.2.2016/15-3-1.jpg" style="float:left; height:364px; margin:12px; width:316px" />এ জাতীয় শব্দ ছাড়াও কিছু সংগতিসম্পন্ন যুগ্ন শব্দও লক্ষ করা যায়। এগুলোকে অনেকে ‘উপসর্গ’ মনে করেন। যেমন—আম (সাধারণ অর্থে) : আমদরবার, আমমুখতার। খাস (বিশেষ অর্থে) : যেমন—খাসদখল, খাসমহল ইত্যাদি। গর (অভাব বা ‘অ’ অর্থে) : যেমন—গরমৌসুম, গররাজি, গরহাজির ইত্যাদি।</p> <p>আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কোরআনের শব্দমালার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলা ভাষায় ব্যবহূত হয়। আরবি থেকে আগত বাংলা শব্দ ও বাংলায় সেগুলোর প্রায়োগিক রূপ  দেখলেই বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন—</p> <p>১. আকল শব্দের অর্থ বুদ্ধি, জ্ঞান। শব্দটি বাংলায় অভিন্ন অর্থে দুটি বানানে লেখা হয়; ‘অ’ যোগে এবং ‘আ’ দিয়ে। যেমন—‘সুগন্ধি সৃজিল প্রভু স্বর্গ আকলিতে।’—সৈয়দ আলাওল। অবশ্য ‘আ’ যোগে লিখলেই তা উচ্চারণগতভাবে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত শব্দের অধিক নিকটবর্তী হয়। পবিত্র কোরআনেও শব্দটি একই অর্থে ব্যবহূত হয়েছে চল্লিশেরও বেশি জায়গায়।</p> <p>২. ‘আকসার’ শব্দটির ব্যবহার বাংলা ভাষায় বিরল হলেও এটির প্রচলন একেবারেই যে নেই তা কিন্তু নয়। শব্দটি অধিকাংশ, সর্বদা, সচরাচর, হরহামেশা, প্রায়ই অর্থে ব্যবহূত হয়। শব্দটি ‘আ’ এবং ‘স’-এ আকারযোগেও ব্যবহূত হয়। অকসর, আকসার যাই বলি শব্দটির ব্যবহার বাংলা ভাষায় বেশ লক্ষ করা যায়। যেমন—‘এখন তো আকসার হচ্ছে’।—মনোজ বসু। ‘বন্ধুবান্ধবদের ভেতর আকসারই দু-একজন বিলেতে।’—সৈয়দ মুজতবা আলী। এই শব্দটি পবিত্র কোরআনে সত্তরবারেরও বেশি ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>৩. ‘ওয়াক্ত’ শব্দের অর্থ সময়কাল, সুযোগ, উপযুক্ত সময়, নির্দিষ্ট সময়—বিশেষত নামাজের সময়। শব্দটি ‘ওক্ত’ বানানেও অভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হয়। যেমন—‘এই তরে ভাই ওক্ত খুশির।’—কাজী নজরুল ইসলাম। ‘কমবকিত ওক্ত গেল তক্ত যাবে ফাঁকে।’—হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পঞ্চ ওক্ত তুমি সবে নামাজ গুজারি।’—সৈয়দ সুলতান। শব্দটি পবিত্র কোরআনে হুবহু ব্যবহূত হয়েছে। যেমন দেখুন, আল্লাহ বললেন, ‘তোমাকে অবকাশ দেওয়া হলো। অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’ (সুরা হুজরাত : ৩৭-৩৮)</p> <p>৪. ‘অছিঅত’, ‘অছিয়ত’, ‘অসিয়ত’ ভিন্ন বানানে গঠিত শব্দত্রয়ের অভিন্ন অর্থ হলো—অন্তিম উপদেশ বা নির্দেশ। যেমন—‘বহু দরকারি অসিয়ত করিলেন।’—হাবিবুল্লা বাহার। শব্দটি ‘উইল’ অর্থেও ব্যবহূত হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর আগে ইচ্ছাপত্রমূলে কাউকে সম্পত্তি অর্পণ করলে তাকে উইল বলে। দাতার মৃত্যুর পর উইল কার্যকর হয়। পবিত্র কোরআনে অছিয়ত শব্দটি বিভিন্নভাবে অন্তত ৯ স্থানে ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>৫. ‘আবু’ শব্দটির উৎসমূল আরবি হলেও পিতা অর্থে শব্দটির ব্যবহার বাংলা ভাষায়ও রয়েছে। বিশেষ করে সন্তান বা শিষ্যকে স্নেহ করে ‘আবু’ বলে ডাকা হয় দেশের অনেক অঞ্চলেই। আরবি ‘আবুন’ শব্দের বহুবচন ‘আবাউন’। শব্দটি পবিত্র কোরআনে অন্তত ১৭ বার ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>৬. ‘আপা’ ও ‘আফওয়াই’ ভিন্ন বানানের শব্দ দুটি জনশ্রুতি, গুজব ইত্যাদি অর্থে ব্যবহূত হয়। যেমন—‘আপা কথা’। ‘শহর বাজারে মিলের ওড়িল আফওয়াই।’—ফকির গরীবুল্লাহ। শব্দটি আরবি ‘আফওয়াহ’ শব্দ থেকে আগত। এটি মূলত ‘ফুহুন’ ও ‘ফামুন’ শব্দদ্বয়ের বহুবচন। শব্দটির অর্থ মুখ।—আলমুনজিদ। গুজব ছড়ানোর প্রথম এবং সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো মানুষের মুখ। লোকমুখেই গুজব রটে। তাই বোধহয় ‘আফওয়াই’ মানে গুজব। শব্দটি পবিত্র  কোরআনে অন্তত ১২ স্থানে ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>৭. ‘আফলাক’ শব্দটি বাংলায় আকাশমণ্ডল অর্থে ব্যবহূত হয়। যেমন—‘বাদশায় প্রণয়গর্বে ভিন্ন করি শির তুলে নীল আফলাক।’—আশরাফ। আরবি ভাষা থেকে আগত এই শব্দটি ওই ভাষার ‘ফালাক’ শব্দের বহুবচন। আরবিতে ‘ফালাক’ শব্দটি আকাশ, কক্ষপথ ও নক্ষত্র অর্থ প্রদান করে। পবিত্র কোরআনে শব্দটি অন্তত দুই জায়গায় এসেছে। দুই স্থানেই শব্দটি কক্ষপথ অর্থে ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>৮. ‘আনসার’ শব্দটি হিজরতের পর মুহাজিরদের সাহায্যকারী মদিনাবাসী সাহাবায়ে কেরামের উপাধি। এ ছাড়া আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীবিশেষের নামও ‘আনসার’। শব্দটি মূলত আরবি ‘নাসির’ শব্দের বহুবচন। নাসির অর্থ সাহায্যকারী। আনসার শব্দটি পবিত্র কোরআনে অন্তত পাঁচ স্থানে ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>৯. ‘আকামত’ শব্দটি যথাক্রমে প্রতিষ্ঠা ও উদ্বোধন অর্থ নির্দেশ করে। যেমন—‘বিপুল সমারোহের সহিত নতুন মসজিদের আকামত পর্ব শেষ হইল।’—কাজী নজরুল ইসলাম। শব্দটি আরবি ‘ইকামাহ’ থেকে আগত, যার অর্থ প্রতিষ্ঠা, নির্মাণ, স্থাপন ইত্যাদি। শব্দটি পবিত্র কোরআনে এর কাছাকাছি অর্থে ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>১০. আউলিয়া, আওলিয়া, শব্দ সিদ্ধ তাপস, দরবেশ, আল্লাহওয়ালা, বুজুর্গ বা আল্লাহর বন্ধু অর্থ প্রদান করে। যেমন—‘কে কে যে ছিলে তুমি জানি নাক কেহ দেবতা কি আওলিয়া।’—কাজী নজরুল ইসলাম। শব্দটি মূলত আরবি ‘অলী’ শব্দের বহুবচন। আরবিতে আউলিয়া অর্থ ‘বন্ধুবর্গ’ হলেও বাংলায় তা দরবেশ অর্থে ব্যবহূত হয়। পবিত্র কোরআনে শব্দটি অন্তত ৩৫ বার ব্যবহূত হয়েছে।</p> <p>পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার সময় যদি আমরা চিনতে পারি যে এই শব্দটি আমাদের মাতৃভাষায়ও ব্যবহূত হয়েছে, তাহলে সহজেই ধর্মীয় ও মাতৃভাষার মধ্যে এক অভূতপূর্ব সেতুবন্ধ আবিষ্কার করতে পারব আমরা। এটি হবে আমাদের জন্য পরম আনন্দ ও আবেগ-অনুভূতির বিষয়। তখন মাতৃভাষা ও ধর্মগ্রন্থের ওপর শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যাবে।</p> <p>লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব</p> <p>নরাইবাগ ইসলামিয়া মাদ্রাসা, ডেমরা, ঢাকা</p>