<p>জীব মাত্রই মৃত্যু অনিবার্য। পরকালীন জীবনই মুমিনের পরম আরাধ্য। মায়াভরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে সবাইকে। তবু প্রিয়জনের বিদায় মানুষকে ব্যথিত করে, শোকসন্তপ্ত করে। প্রিয়জন হারানো এই শোকাতুর মানুষের দরকার হয় একটু আশা ও সান্ত্বনার বাণী। প্রিয় নবী (সা.) প্রিয়জন হারানো মানুষদের সেবা, সান্ত্বনা ও খোঁজখবর রাখার শিক্ষা দিয়েছেন।</p> <p> </p> <p><strong>মৃত</strong> <strong>ব্যক্তির</strong> <strong>পরিবারের</strong> <strong>প্রতি</strong> <strong>সান্ত্বনা</strong></p> <p>মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় সাহায্য হলো সান্ত্বনা দেওয়া ও ধৈর্যধারণে তাদের উৎসাহিত করা। কেউ মারা গেলে মহানবী (সা.) তার বাড়ি যেতেন এবং তাদের আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। মৃত ব্যক্তির পরিবারকে শোক ও বিলাপের পরিবর্তে ধৈর্যধারণে উৎসাহিত করতেন। উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারো ওপর বিপদ এলে সে যদি বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহুম্মা আজুরনি ফি মুসিবাতি ওয়াখলিফলি খাইরাম-মিনহা। (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা নিশ্চয়ই তাঁর কাছে ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমাকে আমার বিপদের উত্তম প্রতিফল দান করুন এবং বিপদকে আমার জন্য কল্যাণে পরিবর্তন করে দিন) আল্লাহ তার বিপদকে কল্যাণে পরিবর্তন করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৬৬)</p> <p> </p> <p><strong>সন্তানহারা</strong> <strong>মায়ের</strong> <strong>প্রতি</strong> <strong>বিশেষ</strong> <strong>সান্ত্বনা</strong></p> <p>নারী কোমল হৃদয়ের অধিকারী। আপনজনের মৃত্যুতে তারা বেশি শোকাতুর হয়। বিশেষত যদি মৃত্যুটা সন্তানের হয়। তাই মহানবী (সা.) সন্তানহারা মাকে বিশেষ সান্ত্বনা দিতেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে নারী তিনটি সন্তান আগেই পাঠাবে (মারা যাবে), তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।’ তখন জনৈক নারী বলল, আর দুটি পাঠালে? তিনি বললেন, ‘দুটি পাঠালেও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০১)</p> <p>আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক নারী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে এলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি এর ব্যাপারে আশঙ্কা করছি। ইতিপূর্বে আরো তিনজন মৃত্যুবরণ করেছে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি তো এক কঠিন প্রাচীর দ্বারা জাহান্নাম থেকে নিজেকে রক্ষা করেছ।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৮৭৭)</p> <p> </p> <p><strong>মৃত</strong> <strong>ব্যক্তির</strong> <strong>পরিবারের</strong> <strong>জন্য</strong> <strong>খাবার</strong> <strong>তৈরি</strong></p> <p>মহানবী (সা.) ছিলেন মানুষের ভেতর সবচেয়ে দয়ালু ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী। মানুষের মৃত্যু তার হৃদয়ের মমত্ব আরো বাড়িয়ে দিত। তিনি তার পরিবার-পরিজনের জন্য খাবার তৈরি করতেন, যেন তারা মৃত্যুশোকের কারণে অভুক্ত না থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন জাফর (রা.)-এর মৃত্যুর খবর এলো মহানবী (সা.) বললেন, ‘জাফরের পরিবারের জন্য খাবার তৈরি করো। কেননা তাদের কাছে এমন দুঃসংবাদ এসেছে, যা তাদের ব্যস্ত করে রাখবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩১৩২)</p> <p>জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মৃতের বাড়িতে সমবেত হওয়া ও খাদ্য প্রস্তুত করে পাঠানোকে আমরা বিলাপের (শোক প্রকাশ) অন্তর্ভুক্ত মনে করতাম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬১২)</p> <p> </p> <p><strong>মৃত</strong> <strong>ব্যক্তির</strong> <strong>পরিবারের</strong> <strong>সঙ্গে</strong> <strong>কোমল</strong> <strong>আচরণ</strong></p> <p>আপনজনকে হারালে মানুষ সাধারণত অসংযত আচরণ করে। কিন্তু মহানবী (সা.) এমন সময় তাদের প্রতি কঠোর আচরণ না করে কোমল আচরণ করতেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (উহুদ যুদ্ধে) আমার পিতা আবদুল্লাহ (রা.) শহিদ হলেন। আমি তাঁর মুখমণ্ডল থেকে কাপড় সরিয়ে কাঁদতে লাগলাম। লোকজন আমাকে নিষেধ করতে লাগল। কিন্তু নবী (সা.) আমাকে নিষেধ করেননি। আমার ফুফি ফাতিমা (রা.)ও কাঁদতে লাগলেন। তখন নবী (সা.) বললেন, ‘তুমি কাঁদো বা না-ই কাঁদো (উভয় সমান)। তোমরা তাকে তুলে নেওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তাঁদের ডানা দিয়ে ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৪৪)</p> <p>জাবির ইবনে আতিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) আবদুল্লাহ বিন সাবিত (রা.)-এর শুশ্রূষার জন্য গিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকেও তাঁর কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে বললেন, ‘হে আবু রাবি! আমাদের সম্মুখে তোমার ওপর আল্লাহর হুকুম (মৃত্যু) বিজয়ী হতে যাচ্ছে।’ এ কথা শুনে কিছু মহিলা উচ্চৈঃস্বরে কান্না শুরু করলে ইবনে আতিক (রা.) তাদের শান্ত করাতে লাগলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাদের ছেড়ে দাও। যখন মৃত্যু হয়ে যাবে তখন কোনোই ক্রন্দনকারিণী ক্রন্দন করবে না।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৮৪৬)</p> <p> </p> <p><strong>মৃত</strong> <strong>ব্যক্তির</strong> <strong>প্রশংসার</strong> <strong>মাধ্যমে</strong> <strong>সান্ত্বনা</strong> <strong>দান</strong></p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কখনো মৃত ব্যক্তির সম্মান ও পরকালীন মর্যাদা ঘোষণার মাধ্যমে তার পরিবার-পরিজনকে সান্ত্বনা দিতেন। আবদুল্লাহ বিন সাবিত (রা.) -এর মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তাঁর মেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জানাল তার বাবা শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর নিয়ত অনুযায়ী তাঁকে শাহাদাতের সওয়াব দিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা! তোমরা শাহাদাত কাকে মনে করো? তারা বলল, আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও আরো সাত প্রকারের শাহাদাত আছে—এক. প্লেগ রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ, ২. পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, ৩. পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি শহীদ, ৪. প্রাচীর বা ঘর চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, ৫. অভ্যন্তরীণ বিষফোড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, ৬. অগ্নিদাহে মৃত ব্যক্তি শহীদ, ৭. প্রসবকালে মৃত নারী শহীদ।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৮৪৬)</p> <p> </p> <p><strong>মৃত</strong> <strong>ব্যক্তির</strong> <strong>ঋণ</strong> <strong>পরিশোধ</strong></p> <p>ঋণ বান্দার অধিকার। কোনো ব্যক্তির ওপর যদি ঋণ থাকে, তবে ঋণদাতা ক্ষমা না করলে ক্ষমা হবে না। তাই মহানবী (সা.) চাইতেন মুসলিমরা যেন ঋণমুক্ত হয়ে মারা যায়। যদি কারো ওপর ঋণ থেকে যেত, তবে তিনি কখনো নিজে তা পরিশোধের দায়িত্ব নিতেন আবার কখনো অন্যরাও মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণ করত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ঋণগ্রস্ত কোনো মৃত ব্যক্তিকে (জানাজার জন্য) আনা হলে, তিনি জিজ্ঞেস করতেন, সে কি ঋণ পরিশোধ করার মতো অতিরিক্ত কিছু রেখে গেছে? যদি বলা হতো যে সে ঋণ পরিশোধ করার মতো সম্পদ রেখে গেছে, তাহলে তিনি তার জানাজা পড়াতেন। অন্যথায় তিনি মুসলিমদের বলতেন, তোমরা তোমাদের সাথির জানাজা পড়ো। তারপর আল্লাহ যখন তাঁকে অনেক বিজয় দান করলেন তখন তিনি বললেন, আমি মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠতর। কাজেই মুমিনদের কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে, তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমারই। আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে যাবে, তা তার ওয়ারিশরা পাবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৭১)</p> <p> </p> <p><strong>মৃত</strong> <strong>ব্যক্তির</strong> <strong>জন্য</strong> <strong>দোয়া</strong> <strong>করে</strong> <strong>সান্ত্বনা</strong> <strong>দান</strong></p> <p>মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আপনজনরা তার পরকালীন মুক্তি নিয়ে চিন্তিত থাকে। তাই কেউ তার জন্য দোয়া করলে তাদের হৃদয় প্রশান্ত হয় এবং মৃত ব্যক্তিও তা দ্বারা উপকৃত হয়। মহানবী (সা.) মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতেন এবং অন্যদেরও দোয়া করতে বলতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়বে, নিষ্ঠার সঙ্গে দোয়া করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩২০১)</p> <p>অপর বর্ণনায় এসেছে, নবী (সা.) মৃতের দাফন শেষ করে সেখানে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং সে যেন প্রতিষ্ঠিত থাকে সে জন্য দোয়া করো। কেননা তাকে এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩২২১)</p> <p>করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অনেক স্বজনহারা পরিবার নির্মমতার শিকার হচ্ছে, যা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। তাদের এই দুর্দিনে তাদের পাশে থাকা এবং সান্ত্বনা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিন। আমিন।</p>