রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিটি কর্মই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। তিনি কিভাবে খেয়েছেন, ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদা ছাড়াও কিছু আমল আছে—যেগুলো সুন্নতে জায়েদা বা নফল। কিন্তু এই সুন্নত জায়েদা কাজগুলোর মধ্যেও এমন কিছু কাজ আছে, যেগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো ছাড়তেন না। তার মধ্যে নিম্নে এই চারটি আমল উম্মুল মুমিনিন হাফসা (রা.) বর্ণিত, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো ত্যাগ করতেন না।
যে চার আমল মহানবী (সা.) কখনো ছাড়তেন না
মুহিব্বুল্লাহ কাফি

এক. আশুরার রোজা। দুই. রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। তিন. প্রতি মাসের তিন দিন তথা আইয়ামে বিজের রোজা, চার. ফজরের ফরজের আগের দুই রাকাত নামাজ।
(নাসায়ি, মিশকাত : ২০৭০)
এক. আশুরার রোজা : মহররম মাসের দশম দিনকে আশুরার দিন বলা হয়।
এ দিনে রোজা রাখারও বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে রাসুল (সা.)-কে সেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতে দেখিনি।
(বুখারি : ২০০৬, মুসলিম : ১১৩২)
আরেক বর্ণনায় উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রথমে আশুরার দিনে সওম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রমজানের সাওম ফরজ করা হলো তখন যার ইচ্ছা (আশুরার) সাওম পালন করত আর যার ইচ্ছা করত না।
(বুখারি, হাদিস : ২০০১)
এর কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল।
(মুসলিম, হাদিস : ১১২৮)
দুই. রমজানের শেষ দশকের
ইতিকাফ : ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।
(বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
তিন. আইয়ামে বিজের রোজা : আবু জার গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, হে আবু জার, যদি তুমি প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করতে চাও, তাহলে (প্রতি চাঁদের) ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে তা পালন করো। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৬১)
রাসুল (সা.) প্রতি চাঁদের এই তিন দিন নিয়মিত রোজা রাখতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বাড়িতে থাকাবস্থায় বা সফরে থাকাবস্থায় কখনোই আইয়ামে বিদের রোজা ছাড়তেন না।
(নাসায়ি, রিয়াজুস সালেহিন : ১২৬৪)
চার. ফজরের আগের দুই রাকাত সুন্নত : উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের পূর্বে চার রাকাত এবং (ফজরের পূর্বে) দুই রাকাত সালাত ছাড়তেন না। (বুখারি : ১১৮১ ও ১১৮২)
অন্য হাদিসে এসেছে, ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। (মুসলিম : ৭২৫)
আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সঠিকভাবে অনুসরণ করে বেশি বেশি সুন্নত ও নফল ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা
- পর্ব, ৭২৭

আয়াতের অর্থ : ‘যদি তোমরা ঘরে কাউকেও না পাও তাহলে তাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়। যদি তোমাদেরকে বলা হয়, ফিরে যাও, তবে তোমরা ফিরে যাবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। আর তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।
আয়াতদ্বয়ে অন্যের ঘরে প্রবেশের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. বসবাস করে এমন ঘরে যদি কেউ না থাকে তবু তাতে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না। আর যে ঘর মানুষের বসবাসের জন্য নয় একান্ত প্রয়োজনে তাতে অনুমতি ছাড়াও প্রবেশ করা যায়।
২. ঘরের দরজা বন্ধ থাকুক বা খোলা তাতে প্রবেশের আগে অনুমতি গ্রহণ করা আবশ্যক।
৩. ঘরের সাবালক বাসিন্দার মতো নাবালক বাসিন্দাও ঘরে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারে।
৪. বিরান ও পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রবেশের জন্য অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন নেই। কেননা এর সঙ্গে মানুষের আব্রু ও ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষার প্রশ্ন জড়িত নয়।
৫. ওমর (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি দরজার ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিল সে ফিসকে (প্রকাশ্য পাপাচার) লিপ্ত হলো।
(তাফসিরে কুরতুবি : ১৫/১৯৮)

দেশে-বিদেশে
ইফতারের বড় পাঁচ আয়োজন
- ইবাদতের পাশাপাশি বর্তমানে ইফতার হয়ে উঠেছে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষঙ্গ। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মেলবন্ধনকে শক্তিশালী করতে মুসলিম বিশ্বের বহু স্থানে ইফতারের নানা আয়োজন করা হয়। মুসলিম বিশ্বের বড় পাঁচ ইফতার আয়োজন নিয়ে লিখেছেন আবরার আবদুল্লাহ

১. মক্কা ও মদিনায় : পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইফতারের আয়োজন হয় মক্কার মসজিদুল হারামে। তারপরই রয়েছে মসজিদে নববীর স্থান। প্রতিদিন কয়েক লাখ ওমরাহ প্রার্থী এখানে ইফতার আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। গত ১৭ মার্চ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পবিত্র দুই মসজিদের পরিচালনা পর্ষদ জানিয়েছে, ১৭ রমজান পর্যন্ত তারা পবিত্র দুই মসজিদে ১১ মিলিয়ন (এক কোটি ১০ লাখ) ইফতারের প্যাকেট বিতরণ করেছে এবং সমপরিমাণ খেজুরের প্যাকেটও বিতরণ করেছে।
(অ্যারাব নিউজ)
২. শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ : সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম নান্দনিক স্থাপনা আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ। প্রতিদিন হাজার হাজার মুসল্লির ইফতারের ব্যবস্থা থাকে এখানে।
৩. ইসতিকলাল মসজিদ : ইন্দোনেশিয়ার ইসতিকলাল মসজিদে হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহত্ ইফতার আয়োজন।
৪. মিসরে গণ-ইফতার : প্রতিবছর রমজান মাসের ১৫ তারিখ মিসরের রাজধানী কায়রোতে আয়োজন করা হয় একটি গণ-ইফতারের। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়।
৫. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম : বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নিতে পারে যেকোনো মানুষ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ব্যবসায়ী, তাবলিগ জামাত, মুসল্লি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতায় এই গণ-ইফতারের আয়োজন করা হয়। বহু বছর ধরে বায়তুল মোকাররমের এই জনসেবামূলক কার্যক্রমটি চলছে।

রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের গুরুত্ব
মাইমুনা আক্তার

রহমত ও মাগফিরাতের দশক শেষ হওয়ার পর আমাদের মধ্যে হাজির হলো নাজাতের দশক। পবিত্র রমজানের এই দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী রমজানের শেষ দশকে শান্তির বার্তা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। যে রাতকে মহান আল্লাহ লাইলাতুল কদর আখ্যা দিয়েছেন।
(সুরা : কদর, আয়াত : ১-৫)
বিভিন্ন হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, উল্লিখিত আয়াতে মহিমান্বিত যে রাতের কথা বলা হয়েছে, তা এই শেষ দশকেই লুকিয়ে আছে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করো। (বুখারি, হাদিস : ২০১৭)
আমাদের নবীজি (সা.) নিজেও শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন।
শেষ দশকে অধিক ইবাদতের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে দোয়াও করতে হবে।
এ ছাড়া যেহেতু এটি নাজাতের দশক, এই দশকে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য আমরা বেশি বেশি তাওবা করতে পারি। কেননা এই মাস মহান আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ করিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মাস। কোনো ব্যক্তি যদি রমজানে তার গুনাহ ক্ষমা করাতে ব্যর্থ হয়, তবে তার প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হুঁশিয়ারি আছে। তিনি বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলিধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফ করার আগেই তা বিদায় নিল।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

পর্ব : ২০
তারাবিতে কোরআনের বার্তা
সুরা কাসাস

এই সুরায় ফেরাউনের শক্তিমত্তা, ঔদ্ধত্য ও রাজত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সে বনি ইসরাঈলে নারীদের দাসী বানিয়ে পুরুষদের হত্যা করত। সেই দিনগুলোতে মুসা (আ.)-এর জন্ম হয়। ফেরাউনের বাহিনীর ভয়ে মুসা (আ.)-এর মা তাঁকে সাগরে ভাসিয়ে দেন।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. বিভক্তি জাতিসত্তা দুর্বল করে দেয় এবং অন্য জাতিকে কর্তৃত্ব স্থাপনের সুযোগ করে দেয়। (আয়াত : ৪)
২. আল্লাহ চাইলে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকেও শাসকের মর্যাদা দেন। (আয়াত : ৫-৬)
৩. সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত।
৪. সন্তানকে মা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া নিন্দনীয়। (আয়াত : ১৩)
৫. বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানেও পরিপক্বতা আসে। (আয়াত : ১৪)
৬. অপরাধকারীকে সাহায্য করাও অপরাধ। (আয়াত : ১৭)
৭. চলাফেরার শালীনতা নারী জীবনের সৌন্দর্য। (আয়াত : ২৫)
৮. শ্রমিক হবে শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য।
৯. যোগ্য লোকের সহযোগিতা গ্রহণ করো। (আয়াত : ৩৪)
১০. জয় ও পরাজয় আল্লাহ নির্ধারণ করেন। (আয়াত : ৩৫)
১১. মুমিন সত্য গ্রহণে দেরি করে না।
(আয়াত : ৫৩)
১২. ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ প্রতিদান। (আয়াত : ৫৪)
১৩. অর্থহীন কাজ পরিহার করো।
(আয়াত : ৫৫)
১৪. পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করো।
(আয়াত : ৭৭)
১৫. পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না।
(আয়াত : ৭৭)
সুরা আনকাবুত
আলোচ্য সুরা আনকাবুতে যুগে যুগে কিভাবে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়, তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দুর্বল-সবল ও বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এই সুরায় ঈমানদারদের পার্থিব জীবনে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সবর ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বলা হয়েছে। কোরআনের অলৌকিকতা উল্লেখ করে মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত সপ্রমাণ করা হয়েছে। নির্যাতিত ঈমানদারদের হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হারাম শরিফকে নিরাপদ নগরী ঘোষণা করা হয়েছে। এবং সবশেষে এই চিরন্তন রীতি উল্লেখ করা হয়েছে যে যারাই পরিশ্রম করবে, অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাবে, তারা সফলতা পাবে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. পরকালীন মুক্তির জন্য ঈমানের ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। (আয়াত : ২)
২. পাপীদের বাড়বাড়ন্তে হতাশার কিছু নেই। কেননা পাপীরা আল্লাহর আয়ত্তের বাইরে নয়। (আয়াত : ৪)
৩. মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।
(আয়াত : ৮)
৪. দ্বিন পালনের কষ্টকে শাস্তি মনে কোরো না। (আয়াত : ১০)
৫. মুনাফিকের পরিচয় গোপন থাকে না। (আয়াত : ১১)
৬. আল্লাহভীতি মুমিনের জীবনে উত্তম পাথেয়। (আয়াত : ১৬)
৭. পৃথিবীতে ভ্রমণ কোরো। কেননা তা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। (আয়াত : ২০)
৮. সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নির্দেশ অপরিহার্য। (আয়াত : ২২)
৯. আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। (আয়াত : ২৩)
১০. বিপর্যয়কারীদের ব্যাপারে আল্লাহর সাহায্য চাও। (আয়াত : ৩০)
১১. আল্লাহ ছাড়া সব শক্তিই ক্ষণস্থায়ী। (আয়াত : ৪১)
১২. নামাজ মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। (আয়াত : ৪৫)
১৩. আল্লাহর স্মরণ সবচেয়ে বড় এবং তা ইবাদতের প্রাণ। (আয়াত : ৪৫)
১৪. বিতর্কে শিষ্টাচার রক্ষা করো।
(আয়াত : ৪৬)
১৫. প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। (আয়াত : ৫৭)
১৬. জীবিক আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত।
(আয়াত : ৬২)
গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান