প্রাচীন ইরানের জরথুস্ত্র ধর্ম

ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
শেয়ার
প্রাচীন ইরানের জরথুস্ত্র ধর্ম
ছবি : সংগৃহীত

প্রাচীন ইরানের অন্তর্গত আজারবাইজানে জন্মগ্রহণকারী একজন বিখ্যাত ব্যক্তি জরথুস্ত্র ছিলেন এ ধর্মের প্রবর্তক। তাঁর নামানুসারে এ ধর্মের নাম করা হয়। এটি মূলত একটি মাজুসি (অগ্নি পূজারি) ধর্ম। এ ধর্মের প্রবর্তককে জরথুস্ত্র, জরোয়েস্টার ইত্যাদি নামে ডাকা হতো।

এ শব্দগুলোর অর্থ হলো বৃদ্ধ উটওয়ালা। অবশ্য পারসিকরা তার নামের অর্থ করেছে স্বর্ণালি তারকা তথা দেদীপ্যমান নক্ষত্র। জরথুস্ত্রের পিতার নাম ছিল ইউরশাব, যিনি রাজা কোস্তাসাব বিন লাহারসাবের রাজত্বকালে আজারবাইজানে আবির্ভূত হন। তাঁর মাতার নাম ছিল জগদুয়া।
তিনি ছিলেন রাইয়ের অধিবাসিনী। (আল-শাহরাস্তানি, আল মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৬)

ঐতিহাসিক আল-মাসউদি জরথুস্ত্রের কুলজি বর্ণনায় লিখেছেন, তিনি হলেন জারাদাস্ত ইবন আসবিসান। তিনি ছিলেন অগ্নি-উপাসকদের নবী। [আল-মাসউদি, মুরুজুব জাহাব, ১ম খণ্ড, তাহকিক : মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন আব্দুল হামিদ (বৈরুত : দারুল ফিকর, ১৯৭৩ খ্রি.) পৃষ্ঠা-২২৯]

প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্যাবলি থেকে অনুমান করা হয় যে তিনি ৬২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কোনো একসময়ে জন্মগ্রহণ করেন।

জরথুস্ত্র ২০ বছর বয়সে স্বীয় মাতাপিতা ও স্ত্রী হারান। ফলে তিনি সংসার ত্যাগ করে সয়লা নগরীতে ধ্যানমগ্ন হন। অতঃপর ৩০ বছর বয়সে ধর্ম প্রবর্তক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি নিজেকে দৈববাণীপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলে দাবি করেন এবং সমকালীন ইরানের বহুদেববাদের সংস্কার করে নিজ ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষায় পরিপূর্ণ হওয়ায় তাঁর এই নতুন ধর্মমত বিকাশ লাভ করে।
এমনকি সাসানিরা একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। সাসানিরা যেহেতু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল, সেহেতু তারা জরথুস্ত্র ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং এ ধর্মের পুরোহিতদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করে। সাসানিরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সদাচরণ করত না; বরং কখনো কখনো তারা জরথুস্ত্র ধর্মযাজকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য করত এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে জরথুস্ত্র ধর্মকে তাদের ওপর চাপিয়ে দিত। [শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহহারি, ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান, অনুবাদ : এফ কে এম আনোয়ারুল কবির (ঢাকা : ইরানি কালচারাল সেন্টার, ২০০৪ খ্রি.), পৃষ্ঠা-৯৬-৯৭)]

 

ধর্মীয় বিশ্বাস

জরথুস্ত্র ধর্ম পারস্যে বহু দেবদেবীর অর্চনা ও প্রাণী উৎসর্গের যুগে আবির্ভূত হয়েও প্রাথমিক পর্যায়ে একত্ববাদের কথা বলত। পরবর্তীকালে এতে এক ঈশ্বরের স্বীকৃতি থাকলেও পরিণতিতে তা ছিল এক দ্বৈতবাদী নীতিতে বিশ্বাস। কেউ কেউ এ ধর্মের আকিদা-বিশ্বাস একেশ্বরবাদী বলে উল্লেখ করলেও স্বয়ং জরথুস্ত্র পৃথিবীতে দুজন খোদার কথা বলেছেন। একজন ইয়াজদান, অপরজন আহিরমান। ইয়াজদান কল্যাণের খোদা। তিনি হলেন আলোক দেবতা, সর্বজ্ঞানী, পবিত্র ও একক। তিনি মিথ্যাকে অপছন্দ করেন এবং অপবিত্রকে বিনাশ করেন। আর আহিরমান অমঙ্গল বা অন্ধকারের স্রষ্টা। এ প্রসঙ্গে জরথুস্ত্র আরো বলেন, ইয়াজদান ও আহিরমানের পারস্পরিক ক্রিয়া থেকেই এ জগতের সৃষ্টি হয়েছে। ইয়াজদান সব সময় শুভ ও কল্যাণকর জগৎ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। আর আহিরমান প্রতি মুহূর্তে তার সে প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে পৃথিবীতে নিজের প্রভুত্ব বিস্তার করতে সচেষ্ট।

 

দ্বৈতবাদে বিশ্বাস

প্রাথমিক পর্যায়ে জরথুস্ত্র ধর্মের বিশ্বাস ছিল একেশ্বরবাদ। পরবর্তীকালে তাতে দ্বৈতবাদের উদ্ভব ঘটে। আল-শাহরাস্তানি এ ধর্মকে একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করলেও একেশ্বরবাদ বলতে যা বোঝায় সে দৃষ্টিকোণ থেকে একে কখনো একেশ্বরবাদী ধর্ম বলা যাবে না। কারণ জরথুস্ত্র আহুরামাজদাকে আহিরমানের সৃষ্টিকর্তা ও আহিরমানকে তার দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে করেন।

জরথুস্ত্র ধর্মে আল্লাহর ধারণা সম্পর্কে অনুসৃত বিশ্বাস সাবিঈ ধর্মের মতোই। তাদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তা কেবল কল্যাণ ও মঙ্গলকর কাজ সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে কখনো অমঙ্গলজনক কোনো ক্রিয়াকলাপ প্রকাশিত হয় না। তারা আরো মনে করে যে আহুরামাজদা হলো আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই আদি, তিনিই অন্ত। (ড. আসআদ আস-সাহমারাসি, আল জারাদিস্তাহ, পৃষ্ঠা-৪৯-৫০)

 

পরকালে বিশ্বাস

এ ধর্মের লোকেরা পরকালের প্রতি বিশ্বাসী। তাদের মতে, এ পৃথিবী একদিন শেষ হয়ে যাবে। জরথুস্ত্রের বিশ্বাস অনুযায়ী, এ পৃথিবী ১২ হাজার বছর টিকে থাকবে। শেষ ৯০০০ বছর অতিক্রান্ত হলে জরথুস্ত্ররা আবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হবে। শেষ বিচারের দিনে মানুষ পুনরুত্থিত হবে। পাপীরা স্বল্পকালের জন্য নরকবাসী হবে। অতঃপর সবাই স্বর্গে বসবাস করবে। উল্লেখ্য যে জরথুস্ত্রবাদীরা পরকালে দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, পরকালে মানুষ তার কর্মফল লাভের জন্য দেহ ধারণ করে মহান স্রষ্টার সামনে বিচারের সম্মুখীন হবে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৫)

 

আগুন ও পানির পবিত্রতায় বিশ্বাস

এ ধর্মে আগুন ও পানিকে পবিত্র বস্তু বলে মনে করা হয়। সুতরাং আগুন ও পানিকে অপবিত্র করা জঘন্য অপরাধ। এ জন্য তারা আগুনকে উপাসনার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে শিখা অনির্বাণ মতবাদের প্রতিষ্ঠা করে। ঘরের মধ্যখানে অগ্নি প্রজ্বলিত করে আগুনের সামনে তারা সৃষ্টিকর্তার সমীপে প্রার্থনা নিবেদন করে। এ প্রার্থনা নিবেদনের সময় তারা গোটা শরীর ধৌতকরণের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে একের পর এক ঘরে প্রবেশ করে অগ্নিপূজা করে। তারা অগ্নিপূজায় এমন সতর্কতা অবলম্বন করে যে, যাতে করে কোনোভাবে অগ্নি নাপাক না হয়। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৬)

 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্লাবন

জরথুস্ত্রবাদীরা বিশ্বাস করে তারা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহাপ্লাবন দ্বারা আক্রান্ত হবে না, যা নুহ (আ.)-এর যুগে হয়েছিল। কেননা তাদের মধ্যে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল যে তারা জিউমারছের বংশোদ্ভূত। যদি কোনো কারণে তারা এ রকম প্লাবনে আক্রান্ত হয় তাহলে ওই জিউমারছ তাদের প্লাবন থেকে মুক্ত করবে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আছির লিখেছেন, জরথুস্ত্রবাদীদের তথা অগ্নি পূজকদের প্লাবন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তারা বলে, জিউমারছ তথা আদম (আ.)-এর যুগ থেকে চিরদিন তাদের রাজত্ব অপরিবর্তিত থাকবে। যদি এরূপ না হয় তাহলে মানব বংশক্রমে ব্যত্যয় ঘটবে এবং তাদের রাজত্ব বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। তাদের মধ্যে আবার কিছু কিছু লোক ব্যাবিলনে প্লাবনের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। আর পূর্ব দিকে জিউমারছের (আদমের) বিশেষ সন্তানদের আবাস ভূমি হওয়ায় সেখানে কোনো ধরনের প্লাবন আসবে না। এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

(আল কামিল ফিত তারিখ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩)

 

ইমামের আবির্ভাব

জরথুস্ত্রবাদীরা আশীযরীকারের আবির্ভাবে বিশ্বাসী। তাদের ধর্মীয় পরিভাষায় আশীযরীকারের অর্থ হলো, একজন ন্যায়নিষ্ঠাবান ধর্মীয় ইমাম। তারা মনে করে, শেষ জামানায় একজন ইমামের আবির্ভাব ঘটবে, যিনি বিশ্বকে দ্বিন ও ন্যায়নিষ্ঠা দ্বারা সুশোভিত করবেন। তাঁর ২০ বছর রাজত্বকালে বিপর্যয় ও সংকট দেখা দিলে তাঁর অনুবর্তী হিসেবে আরেকজন ইমামের (আশীযরীকারের) আবির্ভাব ঘটবে। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, মন্দ ও মিথ্যাচারিতার মূলোৎপাটন করবেন এবং পরিবর্তিত রীতি-নীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেবেন। রাজন্যবর্গ তাঁর আনুগত্য করবে এবং তাঁর সব কর্মকাণ্ড সহজভাবে পরিচালিত হবে। তিনি দ্বিন ও সত্যকে সাহায্য করবেন। তাঁর জামানায় সব ফিতনা-ফ্যাসাদ ও অরাজকতা অপসৃত হবে। (আল মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৩৯)

 

আহিরমান অমঙ্গলের প্রতীক

জরথুস্ত্রবাদীরা তাদের দ্বৈত বিশ্বাস অনুযায়ী মনে করে, আহিরমান অমঙ্গলের প্রতীক। সে হলো শয়তান। সে সব সময় অমঙ্গল ও মন্দ কাজ নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ জন্যই আহুরামাজদা এবং আহিরমানের মধ্যে চিরন্তন সংঘাত লেগে আছে, যা জরথুস্ত্রবাদীদের বিশ্বাসকে একত্ববাদের পরিবর্তে দ্বিত্ববাদের দিকে ধাবিত করে। মোটকথা তারা দুই খোদায় বিশ্বাসী। একজন হলো আলোর খোদা, অপরজন হলো অন্ধকারের খোদা। সৎ লোকেরা আলোর খোদার অনুসারী এবং অসাধু লোকেরা অন্ধকারের খোদার সমর্থক। এককথায় জরথুস্ত্রবাদীরা আহুরামাজদাকে ভালো কাজের স্রষ্টা এবং আহিরমানকে সব অপকর্মের স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করে। (ড. আসআদ আস-সাহারানি, আল জারাদিস্তাহ, পৃষ্ঠা-৫০)

(লেখকের তুলনামূলক ধর্ম বই থেকে)

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭২৬
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না করে প্রবেশ কোরো না। এটা তোমাদের জন্য শ্রেয়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২৭)

আয়াতে অন্যের ঘরে প্রবেশের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে তিনি মানবজাতিকে ঘর দান করেছেন এবং তাদের আব্রু ও একান্ত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষার বিধান দান করেছেন।

২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, কারো ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে সালাম দেবে, অতঃপর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইবে। এভাবে বলবে, আসসালামু আলাইকুম! আমি কি প্রবেশ করতে পারি?

৩. সুন্নত হলো কারো ঘরে প্রবেশের জন্য তিনবারের বেশি অনুমতি না চাওয়া। একবার অনুমতি চেয়ে সামান্য অপেক্ষা করে দ্বিতীয়বার অনুমতি চাওয়া। তিনবার অনুমতি চেয়ে সাড়া না পেলে চলে যাওয়া।

৪. কেউ যদি শুধু সালাম দেয় এবং আলাদা করে অনুমতি না চায়, তবে তা জায়েজ আছে। তবে সালাম ছেড়ে দিয়ে শুধু অনুমতি চাওয়া উচিত নয়।

৫. কারো ঘরে উঁকি দেওয়া নিষেধ। দরজা আটকানো থাকলে মৃদু টোকা দেওয়া জায়েজ এবং ‘আমি’ বা ‘খুলুন’ ইত্যাদি না বলে নিজের নাম-পরিচয় বলাই নিয়ম।

(তাফসিরে কুরতুবি : ১৫/১৮৮)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

তারাবিতে কোরআনের বার্তা

    পর্ব : ১৯
শেয়ার
তারাবিতে কোরআনের বার্তা

সুরা আশ-শুআরা

এই সুরার সূচনায় এ কথা বলা হয়েছে যে কোরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের হিদায়াত। কোরআনের আগের আরো নবী ও কিতাব এসেছে। তার মধ্যে মুসা (সা.)-এর ঘটনা সবিস্তারে বিবৃত হয়েছে। মুসা (আ.)-এর পর নুহ, হুদ, সালেহ, লুত ও শোয়াইব (আ.) সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

এই সুরার শেষেও কোরআন সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের অপপ্রচারের উত্তর দেওয়া হয়েছে। সুরার শেষের দিকে সত্য পরিত্যাগ করে কল্পনার ময়দানে বিচরণকারী কবিদের সমালোচনা করা হয়েছে।

 

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. মানুষের সত্যবিমুখতা মুমিনের মর্মবেদনার কারণ। (আয়াত : ২)

২. দ্বিনি কাজে আল্লাহ মুমিনের সঙ্গী হন তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্যের সঙ্গে।

(আয়াত : ১৫)

৩. কোনো ভালো কাজ অপর মন্দ কাজের বৈধতা দেয় না। (আয়াত : ২২)

৪. জীবন-মৃত্যু ও সুস্থতা আল্লাহর হাতে। (আয়াত : ৮০-৮১)

৫. মুমিন আল্লাহর কাজে জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা চাইবে। (আয়াত : ৮৩)

৬. বাকপটুতাও আল্লাহর অনুগ্রহ।

(আয়াত : ৮৪-৮৫)

৭. বিপথগামী মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। (আয়াত : ৮৬)

৮. অন্তরের বিশুদ্ধতা পরকালের পাথেয় ও মুক্তির উপায়। (আয়াত : ৮৮-৮৯)

৯. মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া মুমিনের কাজ নয়। (আয়াত : ১১৪-১১৫)

১০. দ্বিন প্রত্যাখ্যানের শাস্তি ধ্বংস।

(আয়াত : ১৩৯)

১১. সমকামিতা জঘন্যতম পাপ, যা সমাজ ও সভ্যতার জন্য ধ্বংস ডেকে আনে।

(আয়াত : ১৬৬)

১২. মাপে কম দিয়ো না এবং ত্রুটিপূর্ণ দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার কোরো না।

(আয়াত : ১৮১-১৮২)

১৩. নিজ পরিবারকে দ্বিনের ব্যাপারে সতর্ক করা আবশ্যক। (আয়াত : ২১৪)

১৪. মুমিনদের প্রতি বিনয়ী হও।

(আয়াত : ২১৫)

 

সুরা নামল

এই সুরায় অন্যান্য মাক্কি সুরার মতো ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মুসা, দাউদ, সুলায়মান, সালেহ ও লুত (আ.)-এর জীবনের আশ্চর্য ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। নবীরা কিভাবে নিজ নিজ উম্মত থেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, সে বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। দাউদ ও সুলায়মান (আ.)-এর ওপর মহান আল্লাহ কত কত নিয়ামত দিয়েছেন, তার একটি বিবরণ রয়েছে এখানে। নবুয়ত ও রাজত্ব কিভাবে একসঙ্গে চলতে পারে, তার একটি চিত্র এই সুরায় তুলে ধরা হয়েছে। সুলায়মান (আ.)-এর অধীনে কিভাবে মানুষ, জিন ও পাখি কাজ করেছে, তার খণ্ডচিত্র এই সুরায় তুলে ধরা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে রানি বিলকিসের কথাও। কোরআন নাজিলের উদ্দেশ্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে সুরা শেষ হয়েছে।

 

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. অবিশ্বাসীরাই পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয়। (আয়াত : ৪)

২. মন্দ কাজের প্রতিবিধানে ভালো কাজ করো। (আয়াত : ১১)

৩. আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যাখ্যান কোরো না। (সুরা : নামল, আয়াত : ১৪)

৪. জ্ঞান শ্রেষ্ঠত্ব লাভের উপায়।

(আয়াত : ১৫)

৫. চিঠিপত্রের শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখা মুসলমানের নিয়ম। (আয়াত : ২৯-৩০)

৬. জাতীয় সংকটে পরামর্শ কোরো।

(আয়াত : ৩২)

৭. নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিই কোনো জাতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।

(আয়াত : ৩৩)

৮. যুদ্ধ মুসলমানের কাম্য নয়। কেননা তা জনজীবন বিপর্যস্ত করে। (আয়াত : ৩৪)

৯. যুদ্ধের সময় বীরত্ব প্রদর্শন কোরো। (আয়াত : ৩৭)

১০. নবী-রাসুলদের প্রতি সালাম পাঠ কোরো। (আয়াত : ৫৯)

১১. অন্তরের গোপন কথাও আল্লাহ জানেন। (আয়াত : ৭৪)

১২. নেক আমল কিয়ামতের ভয় দূর করবে। (আয়াত : ৮৯)

১৩. আল্লাহর অনুগত হও। (আয়াত : ৯১)

গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান

 

 

মন্তব্য

যেসব আমলে অন্তরে আল্লাহপ্রেম জাগে

মাইমুনা আক্তার
মাইমুনা আক্তার
শেয়ার
যেসব আমলে অন্তরে আল্লাহপ্রেম জাগে

বান্দার সৌভাগ্যের মূল ভিত্তি হলো, আল্লাহর ভালোবাসা। যার অন্তরে মহান আল্লাহর ভালোবাসা আছে, তার আত্মা প্রশান্ত হয়। তার অন্তরে হিদায়াতের আলো প্রজ্বলিত হয়। তার দুনিয়া ও আখিরাত সাফল্যমণ্ডিত হয়।

তাই তো নবীজি (সা.) মহান আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধির দোয়া করতেন। তিনি দোয়া করতেন—‘হে আল্লাহ! আমি আপনার ভালোবাসা, আপনার প্রেমিকদের ভালোবাসা এবং সেই আমলের ভালোবাসা চাই, যা আমাকে আপনার মহব্বতের নিকটবর্তী করবে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩২৩৫)

কারণ আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসে তখন আসমানের অধিবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা যদি কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরাইল (আ.)-কে ডাক দেন এবং বলেন, নিশ্চয়ই আমি অমুক লোককে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাস।

তিনি বলেন, তখন জিবরাইল (আ.) তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীতে ঘোষণা দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুক লোককে ভালোবাসেন, সুতরাং আপনারাও তাকে ভালোবাসুন। তখন আকাশবাসীরা তাকে ভালোবাসে। তিনি বলেন, এরপর দুনিয়াতে তাকে নন্দিত, সমাদৃত করা হয়।
(মুসলিম, হাদিস : ৬৫৯৮)

এই হাদিসটি দেখলে পবিত্র কোরআনের সেই আয়াতটি মনে পড়ে যায়, যেখানে আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সত্ কাজ করে, পরম করুণাময় অবশ্যই তাদের জন্য (বান্দাদের হৃদয়ে) ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন। (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৯৬)

বর্তমান যুগে চারদিকে ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছে, মানুষের মধ্যে গাফিলতি জেঁকে বসেছে, দুনিয়াবি আকর্ষণে মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া এবং তাঁর মহব্বত অর্জনের উপায় অনুসন্ধান করা।

নিম্নে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের কিছু উপায় তুলে ধরা হলো

কোরআন তিলাওয়াত : পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত এবং তা নিয়ে গবেষণা মানুষকে কল্যাণের দিকে ধাবিত করে। তাই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা যেতে পারে।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, এটি একটি কল্যাণময় কিতাব, তোমার কাছে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা এর আয়াতগুলোর প্রতি চিন্তা-ভাবনা করে, আর জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ২৯)

ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নফল আমল করা : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ...আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিই যে আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে...। (বুখারি, হাদিস : ৬৫০২)

নিজের ইচ্ছার চেয়ে আল্লাহর ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেওয়া : নবীজি (সা.) বলেছেন, তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যায়, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে(১) আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তার কাছে সর্বাধিক প্রিয় হওয়া, (২) কাউকে কেবল আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, (৩) কুফরে ফিরে যাওয়া এতটাই অপছন্দ করা, যেমনআগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপছন্দ করে। (বুখারি, হাদিস : ১৬)

আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে জানা : আল্লাহর গুণবাচক নাম সম্পর্কে জানা এবং সেগুলোর অর্থ ও গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করা। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। (সুরা : ফাতির, আয়াত : ২৮)

আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের কথা স্মরণ করা : কারণ আমাদের যা কিছু আছে, সব তাঁরই দেওয়া, ভালোবাসার উপযুক্ত একমাত্র তিনিই। ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের কাছে যে কোনো নিয়ামত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে।

(সুরা : নাহল, আয়াত : ৫৩)

আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য গ্রহণ করা : রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষ তার বন্ধুর ধ্যান-ধারণার অনুসরণ করে থাকে, তাই তোমাদের প্রত্যেককে দেখা উচিত কাকে সে বন্ধু বানাচ্ছে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৮)

 

 

মন্তব্য
রমজান ঐতিহ্য

ইতালিতে রমজান মাসে ধর্মীয় কার্যক্রম

আলেমা হাবিবা আক্তার
আলেমা হাবিবা আক্তার
শেয়ার
ইতালিতে রমজান মাসে ধর্মীয় কার্যক্রম

দক্ষিণ ইউরোপে অবস্থিত ভূমধ্যসাগরীয় দেশ ইতালিতে ইসলাম নবাগত কোনো ধর্ম নয়, বরং ইতালির ভাগ্যোন্নায়নের অনেক কিছু হয়েছে মুসলিমদের নেতৃত্বে। ইসলামের সোনালি যুগে ইতালির সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ মুসলিম শাসনাধীন ছিল। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত মুসলিম কবি ও দার্শনিক ইবনে হামাদিস সিসিলি। ইতালির সমাজ আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, বিশেষত পশ্চিম ইতালির যেসব দ্বীপ আরব রাষ্ট্রগুলোর নিকটবর্তী, সেখানে আরব রীতি-নীতি ও জীবনাচরণের ছাপ পাওয়া যায়।

বর্তমানে স্থানীয় ও অভিবাসী মিলে ইতালিতে প্রায় ১৫ লাখ মুসলিম বসবাস করে। জনসংখ্যার ২.৩ শতাংশ মুসলিম। ইতালিতে ছোট-বড় ৪৫০টি মসজিদ আছে।

ইতালি গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রাণকেন্দ্র ভ্যাটিকানের দেশ হলেও সেখানে মুসলমানের আগমন হয়েছিল খুব সহজেই।

সেটা সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে হোক, যেমন সিসিলিতে অথবা ইসলাম প্রচারকদের মাধ্যমে হোক, যেমন দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে। বর্তমানে ইতালিতে ইসলাম প্রচারে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইতালি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইসলাম প্রচারে তাদের অভাবনীয় সাফল্যের কারণেই তারা কয়েকবার চরমপন্থীদের হামলার শিকার হয়েছে। তারা ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে ইসলাম প্রচার করে যাচ্ছে।
যেসব ইতালীয় ইসলামের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক অভিযোগ উত্থাপন করে, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যুক্তির সঙ্গে তা খণ্ডন করে। পাল্টা আক্রমণের পরিবর্তে তারা চরমপন্থীদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরে। এ ছাড়া ইসলামী শিক্ষার বিস্তারে ইতালিতে কয়েকটি ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কাজ করে যাচ্ছে।

ইতালিতে মুসলিম সোসাইটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ইসলাম সম্পর্কে ইতালির শাসক ও রাজনীতিকদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব। ফলে তারা ইসলাম বিষয়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেল করার অনুমতি দেয় না।

ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তাই একটি অনলাইন টিভি চ্যানেলের অনুমতি লাভের চেষ্টা করছে। তবে রমজানে কোথাও কোথাও প্রশাসন কিছুটা নমনীয়তা দেখায়। ফলে মুসলিমরা ইফতার তাঁবু করার অনুমতি পায়। কোনো জায়গায় তাঁবু করে তারাবির নামাজ আদায়ের অনুমতিও পাওয়া যায়।

রমজান মাসকে ইতালির মুসলিম ধর্মচর্চা ও ইবাদতের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। এ সময় তারা মুসলিম দেশে তৈরি পণ্য ও খাবার গ্রহণ করে। শহরের মুসলিম হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ইফতার ও সাহরি খায়। রমজান মাসে ইতালির মুসলিমদের আরবীয় খাবারগুলো বিশেষভাবে জনপ্রিয়। রমজান মাসে আরব দেশগুলো থেকে প্রচুর ইফতারসামগ্রী ইতালিতে যায়। যার উল্লেখযোগ্য অংশ যায় উপহার হিসেবে। ইতালির মুসলিম কমিউনিটিগুলো রমজানে ইসলামী বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করে। সেখানে সাধারণত আরব আলেমদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়।

রমজান মাসে ইতালির মুসলিম অধিবাসীরা এবং বিভিন্ন দেশের মুসলিম অভিবাসীরা পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ লাভ করে। সাধারণত তারা সবাই সপরিবারে মসজিদে ইফতারি করে। ইফতার অনুষ্ঠানে অভিবাসীরা নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে। মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করে ঘরে ফেরে। রমজান মাসে ইতালীয় মুসলিমরা দুই হাত খুলে দান করে। তারা অনুন্নত ও দুর্দশাগ্রস্ত মুসলিম অঞ্চলের জন্য দান করতে বেশি পছন্দ করে। ফিলিস্তিন ও আফ্রিকার দরিদ্র্য অঞ্চলের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করে তারা।

 

সূত্র : অ্যারাব নিউজ ও ইসলাম ওয়েব ডটনেট

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ