শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকেই আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও সামীম আফজালের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
এই নিয়োগের সিলেকশন কমিটির কার্যবিবরণী ঘেঁটে পাওয়া গেছে নানা অনিয়ম, যা কালের কণ্ঠের কাছে সংরক্ষিত আছে।
সই নেই সদস্যসচিবসহ তিন সদস্যের : নিয়োগ কমিটির কার্যবিবরণীতে সই নেই কমিটির সদস্যসচিব, জনপ্রশাসন, অর্থ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধির। নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ করে কমিটির সদস্যসচিব রেজাউল করিম স্বাক্ষর করেননি। এই কর্মকর্তা পরে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে যান। এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ওই নিয়োগে কোনো নিয়ম-নীতিই মানা হয়নি। এ কারণে আমিসহ চারজন (জনপ্রশাসন, অর্থ বিভাগ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়) প্রতিনিধি কার্যবিবরণীতে সই দিইনি।’
সুপারিশকারীই অনুমোদনকারী : ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজিকে সভাপতি, সচিবকে সদস্যসচিব ও বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের পাঁচজন সদস্য এবং তৎকালীন ডিজির অনুগত ছয় পরিচালক নিয়ে গঠিত হয় নিয়োগ কমিটি।
এই কমিটির সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী। তিনি বর্তমানে কারাবন্দি। গোলাম মওলা নকশেবন্দী ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। বর্তমানে তিনি পলাতক। মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ছিলেন গত ১৫ বছর ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তিনিও পলাতক। সিরাজউদ্দিন আহমেদ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েও পাননি। আওয়ামীপন্থী সচিব আজিজুর রহমান বর্তমানে মৃত। ডিজিসহ এই পাঁচজন নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগের সুপারিশপত্রে সই করেন। আবার বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের সভায় উপস্থিত থেকে তাঁরাই ওই সুপারিশ অনুমোদন করেন।
এ ব্যাপারে নিয়োগের সুপারিশপত্রে স্বাক্ষরকারী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন পরিচালক ডা. খিজির হায়াত খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই নিয়োগটি নিয়ম মেনে করা হয়নি। এ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক ছিল।’
নম্বরপত্র ঘষামাজা ও অভিজ্ঞতার জাল সনদ : এই নিয়োগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের ভাগনি ফাহমিদা বেগম লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বরে পেয়েছেন ৩০। কিন্তু ২৮ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় পান ২৮ নম্বর। তাঁর নম্বরপত্রে ঘষামাজা ছিল। ডিজির ভাতিজা শাহ আলমকে উৎপাদন ব্যবস্থাপক পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এই পদে বয়সসীমা চাওয়া হয় ৩০ বছর। কিন্তু এসএসসির সনদ অনুযায়ী তাঁর বয়স এর চেয়ে বেশি। তাঁর শিক্ষা সনদ ঘষামাজা করা হয়েছে। অভিজ্ঞতার সনদও জাল।
মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর : সিলেকশন কমিটির কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কমপক্ষে আটজনকে মৌখিক পরীক্ষায় ২৮ নম্বরে ২৮ দেওয়া হয়েছে। লিখিত ৬০ নম্বরের পরীক্ষায় তাঁরা ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ পেয়েছেন। মৌখিক পরীক্ষায় ২৮ নম্বরের মধ্যে অন্তত ১২ জনকে ২৭ নম্বরের বেশি দেওয়া হয়েছে, যা অস্বাভাবিক। গবেষণা কর্মকর্তা পদে এস এম ফরিদ হোসেন লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৪৪ নম্বর পেয়েছেন। অথচ তাঁকে মৌখিক পরীক্ষায় ৭.২৫ নম্বর দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে লিখিত পরীক্ষায় ৩৩ নম্বরপ্রাপ্ত সাদিয়া শারমিনকে মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ২১.১৩ নম্বর দিয়ে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
স্টোর অফিসার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত জামাল হোসাইন লিখিত পরীক্ষায় ৩০ নম্বর পেয়েছেন। তাঁকে মৌখিক পরীক্ষায় ২৫.৬৬ নম্বর দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই পদে লিখিত পরীক্ষায় ৪৪.৫০ নম্বরপ্রাপ্ত আরিফ এলাহী শিশিরকে মৌখিকে ১০ নম্বর দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হোমায়রা আখতার লিখিত পরীক্ষায় ৪১.৫০ নম্বর পেয়েছেন। তাঁকে মৌখিকে দেওয়া হয়েছে ২৩.১৪ নম্বর। অথচ ওই পদে লিখিত পরীক্ষায় ৪৮ নম্বরপ্রাপ্ত আবদুল মতিনকে মৌখিকে ৯ নম্বর দেওয়া হয়েছে।
আত্মীয়-স্বজনের ছড়াছড়ি : নিয়োগ কমিটির কোনো সদস্যের আত্মীয় পরীক্ষায় অংশ নিলে তা ঘোষণা দেওয়ার বিধান রয়েছে। মোকতাদির চৌধুরী নিয়োগ কমিটির সদস্য হয়ে আপন ভাতিজা সুজন আহমেদ চৌধুরী, আত্মীয় ফারুক আহমেদ ও তহমিনা ইয়াসমিনকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেন।
ডিজি সামীম আফজাল তাঁর ভাগনি ফাহমিদা বেগম ও ভাতিজা শাহ আলমকে নিয়োগ দেন। নিয়োগ কমিটির সদস্য তাহের হোসেন তাঁর স্ত্রীর বোনের মেয়ে শাহিনা আক্তারকে প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেন।
এ ছাড়া ডিজির ছেলের গৃহশিক্ষক আতিয়ার রহমানকে প্রগ্রাম অফিসার পদে, ডিজির সম্বন্ধীর ভাগনে মোস্তাফিজুর রহমানকে সহকারী পরিচালক পদে, তৎকালীন উপপরিচালক (পার্সো) এ বি এম শফিকুল ইসলামের আত্মীয় হোমায়রা বেগমকে পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে, তৎকালীন উপপরিচালক এ কে এম মফিজুর রহমানের ভাতিজা আশেকুর রহমানকে সহকারী পরিচালক পদে, তৎকালীন উপপরিচালক রাশিদা আক্তারের দেবর মশিউর রহমানকে সহকারী পরিচালক পদে, সহকারী পরিচালক আজাদ আলীর ভাতিজি সৈয়দা সাবিহা ইসলামকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ : এই নিয়োগটি ছিল পুরোপুরি দলীয়। নিয়োগ পাওয়া সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা। মশিউর রহমান ভূঁইয়া, তহমিনা ইয়াসমিন ও মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। রিজাউল করিম, সাখাওয়াত হোসেন, সাহাবুদ্দিন ও মহিউদ্দিন পাটোয়ারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা, মোস্তাফিজুর রহমান কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা এবং মশিউর রহমান (সমাজবিজ্ঞান প্রশিক্ষক) হাজী দানেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রসেনার কেন্দ্রীয় নেতা মনিরুজ্জামান, জাকের হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও জামাল উদ্দিনকে দলীয় পরিচয় ও সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্যানেল থেকে নিয়োগের কোনো বিধান না থাকলেও সহকারী পরিচালক মশিউর রহমান, জাকের হোসাইন, আশেকুর রহমান, ফারুক আহমেদ ও সৈয়দ সাবিহা ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগে মেধাক্রম অনুসরণ করা হয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্বাধিক নিয়োগ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে কমপক্ষে আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন সহকারী পরিচালক সুজন আহমেদ চৌধুরী, ফারুক আহমেদ, মনিরুজ্জামান, আশেকুর রহমান, সৈয়দ সাবিহা ইসলাম, তহমিনা ইয়াসমিন (মৌলভীবাজার জেলা কোটায় নিয়োগকৃত), ফাহমিদা বেগম (কক্সবাজার জেলা কোটায় নিয়োগকৃত) ও উৎপাদন ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগকৃত শাহ আলম।
এ ছাড়া সহকারী পরিচালক চাঁদপুরের আবদুল্লাহ আল মামুনকে গাজীপুর জেলা কোটায় চাকরি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি এম এ বারী বলেন, ‘এই নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। মৌখিক পরীক্ষায় পেনসিল দিয়ে নম্বর দেওয়া হয়, নম্বরপত্র ঘষামাজা করা হয়। অনেকের শিক্ষা সনদ ও অভিজ্ঞতার সনদ জাল। অনেককে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে এই নিয়োগ বাতিল করা উচিত।’