পঁচাত্তর বছর বয়সী কোহিনূর বেগম। হাঁটাচলা সেভাবে করতে পারেন না। কিন্তু মনের জোরে মেয়ে মুন্নিসহ অন্যদের সহায়তায় হুইলচেয়ারে করে এসেছেন ছেলে শহীদ মেজর মিজানুর রহমানের সমাধিস্থলে। কবরের পাশে তিনি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন আর ছেলের জন্য মানুষের কাছে দোয়া চাইছেন।
অন্যদিকে শহীদ মেজর মমিনুল ইসলাম সরকারের সমাধিতে এসেছেন বাবা মফিজুল ইসলাম সরকার, মা মমিনুন্নেসা, দুই বোন ও তাঁদের সন্তানরা। তাঁরা বেদনার্ত, অশ্রুসিক্ত।
২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শিকার সব সেনা অফিসারের শোকার্ত স্বজনরা গতকাল মঙ্গলবার সকালে বনানীর সামরিক কবরস্থানে শহীদদের সমাধিস্থলে আসেন। বৃদ্ধা মা-বাবা কেউ কেউ বলছেন, এটাই হয়তো শেষবারের মতো দেখা হবে ছেলের সমাধিস্থল।
সকাল ১০টার দিকে দেখা গেছে, কবরস্থানে ৭ নম্বর ব্লকের ৬৪২ নম্বর কবরটি শহীদ মেজর মিজানুর রহমানের। এর পাশেই বসে আছেন মা কোহিনূরসহ অন্য স্বজনরা। শহীদের বোন মুন্নি বলেন, ‘এই বয়সে মাকে আনতে চাইনি, তার পরও মা বায়না ধরেছেন যেন নিয়ে আসি। সামনের বছর বাঁচেন কি না জানেন না, হয়তো এটাই শেষ দেখা হতে পারে ছেলের কবর।
’ তিনিও কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
শহীদ মমিনুলের বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যে ছেলের কথা মনে না হয়। কত বড় বর্বরতায় এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। বেঁচে থাকতে এর বিচার দেখে যেতে চাই এই দোয়া করি।’
স্বামীর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলেন শহীদ মেজর মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রিতা রহমান জুলি।
পরে বলেন, ‘আমরা খুব বেশি কিছু চাইনি। দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছি শহীদি মর্যাদা এবং বিচারটা সুষ্ঠুভাবে হোক।’
শহীদ কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, ‘এত দিন ধরে আমাদের বাবা আর্মির লিস্টে শহীদ ছিলেন। এই প্রথম বাংলাদেশের এনলিস্টে শহীদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের (শহীদ পরিবার) প্রধানত দুটি দাবি ছিল, একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন, শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত যেন চলমান থাকে, সে ক্ষেত্রে আমরা যেন তার (হাসিনা) বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারি। আমি আশা করব, এই তদন্ত কমিশন যেটা কিনা তদন্ত হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে। প্রকৃত অর্থে যারা দোষী আমরা তাদের যেন এখানে আনতে পারি।’
শহীদ কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহম্মেদের সমাধিস্থলের সামনে দোয়া শেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী ফাতেমা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমার শহীদ স্বামী এবং আমাদের জন্য দোয়া রাখবেন, এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই।’
পিলখানায় হত্যাযজ্ঞে বাধাদানকারী শহীদ বিডিআরের কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান। তিনি বলেন, ‘শহীদ সেনা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে পিলখানায় শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি জাতীয়ভাবে সম্মান দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ের ক্ষত একটু হলেও কমেছে।’
শহীদ কর্নেল এমদাদুল ইসলামের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশকে আমি চিনতাম, অনেকে আমার সরাসরি বন্ধু। আজকে আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে আমাদের প্রথম চাওয়া পূরণ হয়েছে। আমরা শহীদ সেনা দিবস পালন করছি।’
শহীদ কর্নেল মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলামের ছেলে আফিফ আল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছর এই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই চলতে, ফিরতে, খেতে ও ঘুমাতে গেলে বাবার কথা অনেক মনে হয়। কিন্তু বাবা তো আর আসবেন না। যারা এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত, আমরা তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই। জনগণ যেন জানতে পারে ওই দিন আসলে কী হয়েছিল।’ এই শহীদের স্ত্রী শামীমা আক্তার লুনাও প্রায়ই একই কথা ব্যক্ত করেন।
এর আগে সকাল ৯টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর বিজিবি ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার পিলখানায় সেনা সদস্যদের হত্যার ঘটনা ঘটে। সেখানে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মারা যান ৭৪ জন। হত্যার এই ঘটনাকে ‘জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি’ ও ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালনের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শহীদ সেনা পরিবারের। সেটি বিগত সরকার করেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করে।

রাজধানীর বনানী সামরিক কবরস্থানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ সেনা স্মৃতিস্তম্ভে গতকাল ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিন বাহিনীর প্রধান। ছবি : কালের কণ্ঠ