ঈদে বেতন-বোনাস, ছুটি ও বিভিন্ন দাবিতে শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলমান উত্তাপ এখনো কাটেনি। বরং প্রতিদিনই আন্দোলন, বিক্ষোভ, কর্মবিরতিতে সোচ্চার আছেন কর্মীরা। সরকারের ত্রিপক্ষীয় কমিটির (মালিক-শ্রমিক এবং সরকারের) বৈঠকে সমন্বিত উদ্যোগের ফলে মজুরি ও বোনাস নিয়ে সংকট কিছুটা প্রশমন হলেও এখনো কয়েকটি কারখানা ঝুঁকিতে রয়েছে। এই নিয়ে গতকাল শনিবার কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষও ছিল।
এদিকে গতকাল তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন দিয়েছে ৯৮ শতাংশ কারখানা। তবে মার্চ মাসের বেতন দিয়েছে ২ শতাংশেরও কম বা মাত্র ৩০টি কারখানা। তবে ঈদের ছুটির আগে বেশির ভাগ কারখানাই মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করবে।
কোনো কোনো কারখানা পূর্ণ এবং অর্ধেক মজুরি পরিশোধ করেছে।
সারা দেশে বিজিএমইএয়ের সক্রিয় সদস্য কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ১০৭টি। এর মধ্যে গতকাল শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা অনুসারে চারটি কারখানা বন্ধ রয়েছে। ২৯টি কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় হাজিরা দিয়ে চলে যান।
শ্রমিক নেতা শ্রম সংগঠন ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশের সভাপতি তৌহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ছুটি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
মালিকরা ১০ দিন এবং শ্রমিকদের দাবি ১২ দিনের। তবে মালিকরা ২০ রোজার মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে বোনাস এবং মার্চের মজুরি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ৮০ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছেন। বাকি ২০ শতাংশও ২৫-২৬ মার্চের মধ্যে পরিশোধ করবেন বলে আশা করছি। এ ছাড়া ছুটি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ভুল বার্তা পৌঁছানো হয়েছে বলে তিনি জানান। এ জন্য উভয় পক্ষকে আন্তরিকভাবে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
জানতে চাইলে গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান শামীম কালের কণ্ঠকে বলেন, গতকাল ছিল তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ঈদ বোনাস ও মজুরি প্রধানের শেষ দিন। তবে গতকাল বন্ধের দিন হওয়ায় আজ বোনাস মজুরির প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। তবে আমাদের ধারণা এরই মধ্যে ৬০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মজুরি হয়েছে ৮০ শতাংশ আর মার্চের বেতন খুব একটা পাননি শ্রমিকরা।
বিজিএমইএর সাবেক জ্যেষ্ঠ সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০ রোজার মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন ও বোনাস ৮০ শতাংশের বেশি কারখানার মালিকরা পরিশোধ করেছেন। বাকিগুলো নিয়েও সংকটের আশঙ্কা করছেন না তিনি। তবে কিছুসংখ্যক কারখানা এখনো ঝুঁকিতে আছে। সরকার-মালিক উভয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিজিএমইএ প্রশাসক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এরই মধ্যে ৯৮ শতাংশ কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের ফেব্রুয়ারি মাসের মজুরি পরিশোধ করেছেন। বোনাসও প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি। তবে কিছু কারখানা ঝুঁকিতে আছে। সেটা একেবারে একক সংখ্যার ঘরে। আশা করছি, এসব কারখানাও তাদের শ্রমিকদের সময়মতো বোনাস ও মজুরি পরিশোধ করতে পারবে। তবে এবারের ঈদে মালিকদের তারল্যসংকট কাটাতে সরকারের দেওয়া বকেয়া নগদ প্রণোদনা সহায়ক হয়েছে।
এদিকে গতকাল বকেয়া বেতনের দাবিতে চট্টগ্রাম নগরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জেএমএস গার্মেন্টস লিমিটেড নামের একটি পোশাক তৈরি কারখানার শ্রমিকরা। নগরের ফ্রিপোর্ট এলাকায় বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। পরে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সমঝোতার পর দুপুর ১টার দিকে সড়ক থেকে সরে গেলে যান চলাচল শুরু হয়। কারখানাটি চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) অবস্থিত।
আন্দোলনকারী নুরুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পাইনি। এ ছাড়াও ঈদ বোনাস বাকি রয়েছে। সকালে কারখানায় এসে দেখি বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে ৪৫ দিনের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের বেতনের টাকা না দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করায় সড়ক অবরোধ করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা যায়, গার্মেন্টস খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেওয়াকে ঘিরে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার সাভারের গলফ ক্লাবে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাইন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঈনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে এনএসআইয়ের পক্ষ থেকে মোট ৯৮টি গার্মেন্টস কারখানার তালিকা দেওয়া হয়। এ সময় বলা হয়, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়া এলাকার এসব কারখানায় ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। যাতে বেতন-বোনাস নিয়ে এসব কারখানায় কোনো সংকট না হয়, তার জন্য আগে থেকে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে সুপারিশও করা হয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক শ্রমিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ৯৮টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করলেও বৈঠকে শিল্প পুলিশসহ আরো কিছু সংস্থার পক্ষ থেকে শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার কথা বলা হয়। তবে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রতিনিধি বৈঠকে ৩৮ থেকে ৪০টির মতো গার্মেন্টস কারখানায় ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সংকট হতে পারে বলে জানান।
এর আগে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) সভা হয়েছিল গত ১২ মার্চ শ্রম ভবনে। সে সভায় ২০ রোজার মধ্যে শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, চলতি মাসের ১৫ দিনের বেতনও দেওয়ার কথা বলা হয়, যা মেনে নিয়েছিল মালিকপক্ষও।