প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আসা-যাওয়া কমেছে। আগের মতো সরকারি দপ্তরগুলোতে বদলির তদবিরসহ নানা কারণে তাঁদের আর তেমন চোখে পড়ে না। সমন্বয় করা ছাত্র প্রতিনিধি যাঁরা উপদেষ্টাদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস), ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ (পিও) প্রিভিলেজ স্টাফ হিসেবে চাকরি করছেন, তাঁরাই শুধু এখন মন্ত্রণালয়গুলোতে কাজ করছেন। আগের মতো সচিবালয়ে সমন্বয়ক/ছাত্র প্রতিনিধিদের দলবেঁধে আর ঘুরতেও দেখা যায় না।
অধিদপ্তরগুলোতেও প্রায় অভিন্ন চিত্র।
গত ৭ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক’ পরিচয়ের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই বলে জানিয়েছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর আগের জায়গায় নেই। সেখান থেকে একটি ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়টা এখন আর এক্সিস্ট (অস্তিত্ব) করে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, এই পরিচয় ব্যবহার করে কেউ যদি অপকর্ম করে, তাহলে তারা যেন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন।’
নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের পরই রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্ত হয়নি, এ বিষয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
উমামা ফাতেমা লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি বিলুপ্ত করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশীদার ছাত্রদের সবাই নতুন রাজনৈতিক দল বা নতুন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হয়নি। অংশীদারদের আলোচনা ছাড়া প্ল্যাটফর্ম বিলুপ্ত হবে না। তাই বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ রইল।’
এর পরই মূলত সারা দেশের সরকারি দপ্তরগুলোতে সমন্বয়কদের আনাগোনা কমতে শুরু করে। তবে যেসব সমন্বয়ক ছাত্র প্রতিনিধি শুরুতেই উপদেষ্টাদের প্রিভিলেজ স্টাফ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মাহফুজুল আলম ভূঁইয়া ও খন্দকার মো. আরিফ বিল্লাহ। ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের এপিএস মো. আশিকুল ইসলাম ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) শরিফুল ইসলাম রিয়াদ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের প্রিভিলেজ স্টাফ হিসেবে কাজ করছেন ডা. মাহমুদ হাসান ও মুহাম্মদ তুহিন ফারাবী। তুহিন ফারাবী বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ডেরও ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আছেন। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের প্রিভিলেজ স্টাফ হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন ছাত্র প্রতিনিধি আতিক মোরশেদ। নিয়োগটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে দপ্তর সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ছাড়া আরো দু-একটি মন্ত্রণালয়ে ছাত্র প্রতিনিধিরা উপদেষ্টাদের প্রিভিলেজ স্টাফ হিসেবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা ও উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিওন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকেই প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখতে সচিবালয়সহ সরকারি দপ্তরে গেছেন—এটা সত্য। তাঁদের মধ্যে সবাই সমন্বয়ক নন, অনেককে আমরা চিনিও না। আমাদের সমন্বয়কদের কেউ বদলি বা তদবির বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে এক ধরনের সুযোগসন্ধানী লোক আছেন, যাঁরা সব সময় তদবির বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজি করেন। তাঁদের কোনো দল নেই। তাঁরা অতীতে যেমন আওয়ামী লীগ-বিএনপির নামে এসব কাজ করেছেন, এখন তাঁরা ‘সমন্বয়ক’ পদ ব্যবহার করে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের দলের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের বিতর্কিত করতে একটি চক্র এমন গর্হিত কাজ করে থাকতে পারে।’
সচিবালয়ের আশপাশের একাধিক অধিদপ্তরে ছিল ‘সমন্বয়ক’ নামের তদবিরবাজের দৌরাত্ম্য। কর্মকর্তাদের বদলির নামেও তাঁরা সরকারি দপ্তরগুলোতে ব্যস্ত থাকতেন। ডরে-ভয়ে দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তা বাধ্য হয়ে তাঁদের কথামত কাজও করতেন। অসাধু কিছু কর্মকর্তা সমন্বয়ক নামের এসব তদবিরবাজদের ব্যবহার করতেন নিজেদের কাজেও। তবে নাহিদ ইসলামের ওই বক্তব্যের পর অনেকটাই আনাগোনা কমে গেছে কথিত সমন্বয়কদের।
খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) জামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, ‘গত কয়েক মাস ধরে সমন্বয়ক বা ছাত্র প্রতিনিধির নামে অনেকেই খাদ্য কর্মকর্তাদের বদলি করার জন্য চাপ দিতেন। এমনকি চাল-গম কেনাকাটার বিষয়েও তাঁদের অনেকে হস্তক্ষেপ করতেন। কিন্তু ইদানীং কাউকে দেখছি না। তাঁদের আনাগোনা কমে গেছে।’
এর আগে গত ৭ মার্চ সকালে রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটের অভিযোগে ১৪ সমন্বয়ককে আটক করে যৌথ বাহিনী।