<p>‘ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।</p> <p>বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহী নমোহস্তুতে\...’</p> <p>সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে কিন্তু সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন (অন্ত্যর্থে)+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী।</p> <p>সরস্বতী শুক্লবর্ণ। শুক্লবর্ণ মানে সাদা রং। সত্ত্বগুণের প্রতীকও হলো সাদা। গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের ছয় শ্লোকে আছে—‘তত্র সত্ত্বং নির্মলত্বাৎ’ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অতি পবিত্র গুণ, স্বচ্ছতার প্রতীক, নির্মলতার প্রতীক। আবার ওই অধ্যায়েরই ১৭ শ্লোকে আছে, ‘সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং’ অর্থাৎ সত্ত্বগুণে জ্ঞানলাভ হয়। তাই জ্ঞানময়ী সর্বশুক্লা দেবী সরস্বতী জ্ঞানে গুণান্বিত বলে তার গায়ের রং শুক্লবর্ণ অর্থাৎ দোষহীনা ও পবিত্রতার মূর্তি। আর জ্ঞানদান করেন বলে তিনি জ্ঞানদায়িনী। ‘নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/৩৮) অর্থাৎ ‘জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নেই।’</p> <p>পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগদেবীরূপে প্রসিদ্ধা। পরবর্তীকালে বৈদিক দেবী সরস্বতীর অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি কেবল বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই সুপ্রতিষ্ঠাতা হয়েছেন। বৈদিক সরস্বতী বাগাধিষ্ঠাত্রী বা বাগদেবীরূপেও বর্ণিতা হয়েছেন। ঋগ্বেদে সরস্বতীর সঙ্গে বিদ্যাধিষ্ঠাতৃত্বের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগদেবী।</p> <p>বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভাণ্ডার তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু আর মহেশ্বরের। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে সরস্বতী তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাৎ জ্ঞানের দেবীতে পরিণত হলেন।</p> <p><img alt="" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/02.February/05-02-2022/121/99.gif" style="float:left; height:253px; margin:12px; width:450px" />সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুৎ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রাহ্মণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগে নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতী তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর জ্ঞানগুলো অনত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী।</p> <p>আধুনিককালের সরস্বতীর বাহন হলো হাঁস। ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহনটি পাখি বিশেষ নয়। বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যের সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছেন হংস বা সূর্য অত্যন্ত সংগত কারণেই। তবে সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল, যা জানা যায় বৈদিক সাক্ষ্য থেকে। পরবর্তীকালে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ ও কার্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর, সিংহ ও ময়ূর ছেড়ে দিয়ে সরস্বতী দেবী ব্রহ্মার শক্তি ব্রাহ্মাণী হিসেবে বাহনটিকে চিরস্থায়ী মর্যাদা দিলেন।’</p> <p>সরস্বতী পূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়ে থাকে। তবে এ পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। যথা—অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শীষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা পূজার পূর্বে কুল খায় না। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ। যথাবিহিত পূজার পর লক্ষ্মী, নারায়ণ, লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম), পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এদিন ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে অঞ্জলি দেয়।</p> <p>লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম,</p> <p>দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ</p>
