<p>সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন। প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২৫-এ দেখা যায়, প্রথম ৮০০-এর তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৫ সালের সংস্করণে ১১৫টি দেশ ও অঞ্চলের দুই হাজারের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করে তালিকা করা হয়েছে। তবে তালিকার শীর্ষ ৮০০-এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এমনকি পাকিস্তানেরও ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কিন্তু পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবকাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক দুর্বল এবং তাদের দেশের অবস্থা তেমন ভালো নয়। কিভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করা জরুরি। ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা হওয়া অবশ্য যৌক্তিক। এ বিষয়ে সরকারের ভাবা দরকার।</p> <p>২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০০-তে, কিন্তু এখন র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমাদের জন্য হতাশাজনক। কারণ শিক্ষায় ভালোভাবে বা গুণগতভাবে উন্নতি না ঘটলে কোনো উন্নয়ন টেকসই করা সম্ভব নয়। উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে শিক্ষায় উন্নয়ন, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণার ব্যাপক উন্নতি বা মানসম্মত গবেষণা না হলে শিক্ষা উন্নয়নে ভূমিকা কম রাখতে পারে।</p> <p>শিক্ষার মান, শিক্ষায় গবেষণার পরিবেশ, গবেষণায় শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান, ইন্ডাস্ট্রিতে সংযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্ভাবনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান বিবেচনায় নিয়ে টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হয়। একাডেমিক খ্যাতি ৪০, চাকরির বাজারে সুনাম ১০, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ২০, শিক্ষকদের গবেষণা ২০ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাতে ১০ নম্বর ধরা হয়। এসব সূচকে আমরা অনেক পিছিয়ে।</p> <p>আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি মানা হয় না বা নেই। মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষকের পদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ছাড় করে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট হাজার ৪৫১। শিক্ষক ২২৪ জন। অর্থাৎ ৩৮ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পলিসি নিতে হবে, যাতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি এবং কিছু বিদেশি ফ্যাকাল্টি মেম্বার নিয়োগ করা যায়। গবেষণার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের আর্থিক প্রণোদনা এবং প্রমোশনের জন্য গবেষণার মান সংযুক্ত করা উচিত। একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম বাড়াতে হলে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।</p> <p>শিক্ষার ব্যাপক সংস্কার করতে না পারলে কোনো উন্নয়নই টেকসই করা সম্ভব নয়। সে জন্য নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার গুণগত মান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা ও গবেষণার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন এবং গবেষণার গুণগত মানের বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে গবেষণার মান এবং দেশের উন্নয়নে অবদানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সরকার থেকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া জরুরি, যা মৌলিক গবেষণা বাড়াতে সহযোগিতা করবে।</p> <p>আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরা ৫০০ তালিকায় কিভাবে অবস্থান করতে পারে, সে বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তার সময় এসেছে। এ জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। যাঁরা মাস্টার্স করবেন, তাঁদের গবেষণানির্ভর ডিগ্রি দিলে গবেষণার সংখ্যা এবং শিক্ষার মান বাড়বে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক খ্যাতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। দ্রুত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কমিশন গঠন করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষকের গবেষণার মান বাড়ানো যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পদোন্নতি পেতে পিএইচডি ডিগ্রিসহ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা থাকতে হবে—এ ধরনের নিয়ম করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ করে গঠনমূলক রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ নোংরা রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে স্থান না পাওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।</p> <p>এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দ মানে খরচ নয়, বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। তাহলে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়ন সম্ভব। এখন দেখতে পাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ যোগ্যতায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকেন কর্তাব্যক্তিরা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব বন্ধ করা সময়ের দাবি। শিক্ষক নিয়োগে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা ঠিক হবে না। শিক্ষক নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। উপাচার্যদের আরো সতর্ক থাকতে হবে শিক্ষক নিয়োগে এবং স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে।</p> <p>মৌলিক সূচকগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতি ঘটাতে হলে প্রথমে মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। নিয়ম করতে হবে, গবেষণা ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহারে মাস্টার ডিগ্রি দেওয়া হয়। এটি ঠিক নয়। কারণ সবার মাস্টার ডিগ্রির দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সামগ্রিক আর্থিক এবং গবেষণানির্ভর লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে।</p> <p>শিক্ষকদের পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণায় গুরুত্ব না দেওয়া হলে ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বৃদ্ধি করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খুবই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।</p> <p>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ</p> <p> </p>