বাংলাদেশের তরুণীরা কমবেশি দিনটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানেন। তাঁদের অনেকেই দেশের অনেক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নারীদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ হঠাত্ শুরু হয়নি। ধর্ম ও ঐতিহ্যর নামে এ দেশের নারীদের অপমান, অবমাননা, নির্যাতন, নিষ্পেষণের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। ব্রিটিশ শাসনামলে স্মরণীয়-বরণীয় স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সতীদাহ রোধ, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রতিরোধ, বিধবা বিবাহ আইন পাস ও কার্যকরের প্রচেষ্টা এবং নারী শিক্ষার প্রবর্তন নারীমুক্তির ক্ষেত্রে একেকটি আলোকবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী’—অস্বীকার করে ভারতীয় উপমহাদেশে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রথম নারী, যিনি লিঙ্গ বিভাজন সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নারীসমাজকে বলেন, ‘তোমরা সমস্বরে বল, আমরা মানুষ।’ একুশ শতকের অগ্রবর্তী তরুণীরা আহ্বানটি হৃদয়ঙ্গম করলে এবারের আলোচ্য প্রতিপাদ্য তাঁদের জীবনকে অন্য মাত্রায় উন্নীত করবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র জেন্ডার সহনশীল হয়ে উঠবে।
হ্যাঁ, আমাদের দেশে সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগতে, বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রযুক্তি ব্যবহারে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও পদায়ন যথেষ্টই দৃশ্যমান। পাশাপাশি নারীর মৃত্যুহার, বাল্যবিবাহ, প্রজননজনিত বিভিন্ন সংকট, অপুষ্টি, আত্মহত্যা, অগ্নি-পানি-বিষে অস্বাভাবিক মৃত্যু, নানা রকম যৌন নির্যাতন ও উত্পীড়ন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, নারী ও কন্যাশিশু পাচার, ভ্রূণ হত্যা, নানা পারিবারিক সহিংসতা, অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকা, শিক্ষা-কর্মক্ষেত্র-গণপরিবহনে নিরাপত্তাহীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা—এমন অসংখ্য বৈষম্যও উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান। নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতা, উন্নয়ন রাষ্ট্র ও সংবিধানে কাগজ-কলমে স্বীকৃত। লক্ষণীয় এই যে ৩০ বছরের অধিক সময় আমাদের দেশে সরকারপ্রধান, বিরোধী দলের প্রধান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রধান পদ নারী দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। বুঝতে হবে, এই নারীরা প্রকৃতপক্ষে সেই নারী, যাঁরা পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে নিজেরাই পরিচালিত হয়ে এসেছেন। ক্ষমতার বৃন্ত স্পর্শ করেও পুরুষতন্ত্রকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করতে পারেননি। ব্যবহৃত হয়েছেন। তাঁদের অপশাসন ও যাবতীয় অপকর্ম-অপসংস্কৃতি পর্দার আড়াল থেকে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্দয় মুখোশ উন্মোচন করে। বলা বাহুল্য, ব্যক্তি বা সামগ্রিক পুরুষসমাজ আর পুরুষতন্ত্র এক নয়।
ধনতন্ত্র-পুঁজিবাদের মতো পুরুষতন্ত্র বিশ্বব্যাপী একটি ক্ষমতাব্যবস্থা। দেশে দেশে যার মাত্রাভেদ আছে। সব শ্রম বিভাজনের মধ্যে লিঙ্গ বিভাজনকে প্রধান করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রকে এই ব্যবস্থার অনুগত থাকতে বাধ্য করা হয়। এই তন্ত্রের নিচে চাপা পড়া নিঃশব্দে ক্রন্দনরত নারীকে মুক্তির দিশা দিতে দেশে দেশে যুগে যুগে মানবিক পুরুষদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের শিকড় এত গভীরে যে অনেক সদিচ্ছাসম্পন্ন পুরুষও অবচেতনে অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতার শিকার হয়ে যান। মুক্তির পথটি নারী-পুরুষ সবার জন্যই তাই অনেক পিচ্ছিল হয়ে ওঠে।
১৯৫২ থেকে ১৯৭১, আবার ১৯৭১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বারবার তরুণীরা জাতির সব সংকটে-সংগ্রামে সব বাধা উপেক্ষা করে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে-আন্দোলনে শরিক হন। এই ঐতিহ্য এ দেশের নারীদের দীর্ঘদিনের। নারীশিক্ষার সামান্যতম সুযোগ পেয়েই উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে অগণিত নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরিক হন। অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। শহীদ হন, কারাবন্দি হন, অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হন। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অন্দরের সঙ্গে বাইরের কৃত্রিম বিভাজন তাঁরা অস্বীকার করেন। সেই সময়কালে বিষয়টি মোটেই সহজ ছিল না।
ক্ষমতার ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। স্বাধীন দেশে নারীর মানবিক মর্যাদার স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় শাসকরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। ১৯৭১ আবার নারীদের বহুদূর পর্যন্ত স্বপ্ন দেখায়। মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা বহুবিধ। তদুপরি অসংখ্য নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হন। অথচ স্বাধীন দেশেও নারীদের মানবিক মর্যাদা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ সেই আদি-অন্তহীন পুরুষতন্ত্র। প্রতিদিনই সচেতন নারীসমাজ কোনো না কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়।
আরেকটু পিছিয়ে দেখি, গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আহ্বানে শত-সহস্র নারী ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে অংশ নেন। অথচ বিজয় লাভের নতুন ভোরে ওল্যাম্প দ্য গুজের নেতৃত্বে যে নারীরা শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, দিনশেষে তাঁরাই পুরুষতন্ত্রের ফতোয়ার শিকার হয়ে গিলোটিনে গর্দান দেন।
ইতিহাসের এই পরম্পরা জানা-বোঝা ও উপলব্ধিতে আনা তরুণীদের জন্য তাই অত্যন্ত জরুরি। দেশ ও দশের বৃহত্তর স্বার্থে, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তরুণীরা অবশ্যই রুখে দাঁড়াবেন। কিন্তু অনেক কথার কথায় সমাজ ও রাষ্ট্র দিনশেষে নারীকে অসমান বখরা দিয়েই সন্তুষ্ট রাখতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ। এখন দেশের অকুতোভয় তরুণীদের হিসাব বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে। দেশ আর দেশজ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে এখনকার প্রজন্মকে নতুন বিশ্বব্যবস্থাও বুঝে নিতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী অধিকার-মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার দায়দায়িত্ব রয়ে গেছে। স্বাধীনতা আর সমতা শব্দটিকে ব্যক্তিগত ব্যাবহারিক জীবনের প্রতিটি কোণ থেকে দেখা জরুরি। কারণ সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম বিভিন্ন নামে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দেশের সর্বত্রই অধিকতর নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। নারীর প্রতি আক্রমণ চারপাশ থেকেই বেড়ে চলেছে। নারীর মানবাধিকার আদায়ের প্রশ্নটি তাই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
বুঝতে হবে, কোনো বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহাত্মক অভ্যুত্থান সমাজকে ওপর থেকে পাল্টায়। ক্ষমতার পালাবদল হয়। নারীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। নারীর মানবাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের, এমনকি নারীবাদের প্রগাঢ় তাত্ত্বিকদের অনেকেরই ভেতর ও বাইরে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। একুশ শতকের তরুণীদের তাই নিজেদের মানবিক হিস্যা বুঝে নিতে লিঙ্গবৈষম্য, কন্যাশিশুসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
পুরুষকে অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা বা অস্বীকার করে নারী এই জটিল বাঁধন ছিন্ন করতে পারেন না। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ গঠনে সুসংগঠিত কর্মকৌশল সুসংহত করতে হবে। সমমনা-সহযোদ্ধা পুরুষকে সহযোগী করে তরুণীদের মানবাধিকার ছিনিয়ে আনার প্রত্যয় ঋজু হয়ে উঠুক। সুপ্রাচীন প্রতারক পুরুষতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে এই তরুণীরা দৌড়ে চলুন। পেছনে পড়ে থাকুক ঘেরটোপে ঢাকা একরাশ অনুশাসন আর অন্ধতা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস এই তরুণী নারীদের প্রতি দিবস হয়ে আঘাত হানুক অটল-অনড় পুরুষতন্ত্রকে—‘প্রতিবাদ হোক সহিংসতার, নিশ্চিত হোক মানবাধিকার।’
লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ