ঢাকা, রবিবার ০৯ মার্চ ২০২৫
২৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৮ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, রবিবার ০৯ মার্চ ২০২৫
২৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৮ রমজান ১৪৪৬

শক্তির প্রতিযোগিতায় বলি হচ্ছে ইউক্রেন

  • ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
শক্তির প্রতিযোগিতায় বলি হচ্ছে ইউক্রেন

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে থামবে বা আদৌ থামবে কি না, সেটি নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেই সঙ্গে নতুন করে শঙ্কা জেগেছে এটি কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে কি না। এরই মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বলে কেউ কেউ সতর্ক করেছেন। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ইউক্রেনের সাবেক সামরিক কমান্ডার ভ্যালরি জালুঝনি। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের সম্মুখসারিতে যুদ্ধ করা, চীনের তরফ থেকে অস্ত্রের সরবরাহ এবং ইরানের শাহেদ ড্রোনের ব্যবহারএসব বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি ন্যাটো তথা পশ্চিমা বিশ্বকে ইউক্রেনের প্রতি আরো ঝুঁকে পড়াকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

রাশিয়ার অবস্থানের পাল্টা অবস্থান হিসেবে সম্প্রতি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সহযোগিতা বাড়ানোর ভাবনা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি দি আর্মি টেকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম বা এটিসিএমএস ব্যবহারের জন্য জো বাইডেনের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার ভূখণ্ড লক্ষ্য করে এটির ব্যবহার রাশিয়াকে নতুন করে আগ্রাসী হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ভাবাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন তার এক বার্তায় জানান দিয়েছেন যে এটিকে তিনি নেহাত ইউক্রেনের হামলা হিসেবে দেখছেন না, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন হিসেবে দেখছেন। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার তরফ থেকে পাল্টা পদক্ষেপ কেবল ইউক্রেনের ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকবে না বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন তিনি। 

শক্তির প্রতিযোগিতায় বলি হচ্ছে ইউক্রেনযে কারণ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এই যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল, অর্থাৎ ন্যাটোর পূর্বমুখী বিস্তার এবং তা ঠেকানোর লক্ষ্যে যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে এটি এখন এসে ঠেকেছে শক্তিধর দেশগুলোর শক্তিমত্তা প্রমাণের প্রতিযোগিতায়।

এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যেতে পারে, পশ্চিমা দেশগুলো এমন এক সময়ে এসে ইউক্রেনকে তাদের তৈরি কৌশলগত অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, যখন ইউক্রেনের সেনারা প্রায় পৌনে তিন বছর ধরে যুদ্ধ করে অনেকটাই ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত, উপরন্তু রাশিয়ার শক্তির কাছে প্রতিনিয়ত অসহায় আত্মসমর্থন করছে। রুশ শক্তি বাস্তবিক অর্থেই পশ্চিমা সম্মিলিত শক্তির তুলনায় দুর্বল কি না, এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়া কার্যকর অর্থেই পিছু হটবে কি না, এমন অসংখ্য প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েও ব্যাপক প্রশ্ন থেকে যায়। বস্তুতপক্ষে সব কিছুকে ছাপিয়ে এই মুহূর্তে যে দিকটি স্পষ্টভাবে সামনে উঠে এসেছে, তা হচ্ছে ইউক্রেনকে উপলক্ষ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সম্মিলিত শক্তি রাশিয়াকে দুর্বল করতে চেয়েছে, এর মধ্য দিয়ে মার্কিন কর্তৃত্ববাদকে নির্বিঘ্ন করতে চেয়েছে, চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থানের লাগাম টানতে চেয়েছে, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো পশ্চিমাবিরোধী শক্তিগুলোকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছেএ রকম আরো অনেক কিছু।

ইউক্রেনকে রক্ষা করাই যদি মূল উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে পশ্চিমা শক্তিগুলো এই সময়ে এসে তাদের অস্ত্রের ব্যবহারে ইউক্রেনকে অনুমোদন দিত না, বরং তা আরো আগেই দিতে পারত, যা দিয়ে ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের প্রতিরোধকে আরো শক্তিশালী করতে পারত, যুদ্ধে নিজেদের মনোবলকে আরো বৃদ্ধি করতে পারত।

আসলে এখানে অনেক ধরনের হিসাব কাজ করেছে। যুদ্ধ সব সময়ই ব্যয়বহুল, বিশেষ করে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রাজনৈতিক মেরুকরণের ওপরও এর একটি বড় প্রভাব রয়েছে। এই ব্যয় এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলো মাথায় রেখে তারা এটিকে যতটুকু সম্ভব স্বল্প বিনিয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। এতে ইউক্রেনের কতটুকু ক্ষতি হলো না হলো, কত মানুষ মারা পড়লএসব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে গিয়ে তারা দিনশেষে এই যুদ্ধ থেকে রাশিয়া পিছু টান দেবে এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল।

তাদের সময়টি ভালো যাচ্ছিল না অনেক দিন ধরেই।

এটি তারা বুঝতে পারলেও যুদ্ধটিকে আরো ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর একটি কারণ মধ্যপ্রাচ্যেও তারা ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে প্রক্সি দিচ্ছে, দ্বিতীয় আরেকটি কারণ এ ক্ষেত্রে মার্কিন জনসমর্থন নিয়ে অনিশ্চয়তা। সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ভরাডুবি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অনেকটাই দায়মুক্ত করেছে, যার কারণে আগামী জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের আগে তিনি তার দিক থেকে আরো আগ্রাসী হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পুতিনকে খ্যাপাতে চাইছেন, যেন তিনি পশ্চিমা স্থাপনার ওপর হামলা করেন এবং এই যুদ্ধটি আরো কঠিন হয়ে ওঠে। রাশিয়ার সঙ্গে চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের সখ্য নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে যে ধরনের মনোভাব প্রকাশ করা হচ্ছে, একই ধরনের চিত্র তো এই যুদ্ধের প্রথম থেকেই দৃশ্যমান, যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে সব ধরনের মদদ দিয়ে গেছে। সুতরাং এটিকে যদি এখন তৃতীয় বিশ্বেযুদ্ধ শুরুর দিকে ইঙ্গিত করা হয়, তাহলে এর দায় কেবল রাশিয়ার নয়, পশ্চিমারাও সমানভাবে দায়ী।

এখন এই বিষয়টি আলোচনায় সামনে চলে এসেছে যে ইউক্রেনের হাতে শুরু থেকেই যদি এই আধুনিক অস্ত্রগুলো দেওয়া হতো এবং এগুলো দিয়ে তাদের রাশিয়ার ভূমিতে হামলা চালানোর অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে কি রাশিয়া যে এত দিন ধরে ইউক্রেনের ভূমিতে একের পর এক দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে, সেটি হতো কি না। এখানে এই যুক্তি উপস্থাপন করা হতে পারে যে এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার পক্ষ থেকে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের হুমকি থেকে যেতে পারত। তাহলে এখন যে এগুলো ব্যবহারে ইউক্রেনকে সম্মতি দেওয়া হলো, সে ক্ষেত্রেও তো এই পরমাণু ব্যবহারের হুমকি আরো বেড়ে গেল! এ রকম যদি কিছু সত্যি ঘটে যায়, তাহলে এর দায় কে নেবে? এখানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল কি হয়নি, এটি মুখ্য নয়, বরং এই যুদ্ধ ঘিরে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের আশঙ্কা আগেও ছিল, এখনো রয়ে গেছে। এটি যদি বাস্তবেই ঘটে, তাহলে এর রেশ কেবল আর ইউক্রেন ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বিস্তৃত হতে পারে বহুলাংশে।

পশ্চিমারা যদি তাদের সামরিক জোট ন্যাটোকে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, সে ক্ষেত্রে রাশিয়াও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। মার্কিন ও ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার পর রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের নতুন মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সফল হামলা চালিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। প্রেসিডেন্ট পুতিন সতর্ক করে বলেছেন যে পশ্চিমারা এই যুদ্ধকে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, সে ক্ষেত্রে তার দেশ থেমে থাকবে না। এদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনের হামলার পর রাশিয়া আরো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তারা নতুন করে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় আরো কিছু এলাকা দখলে নিয়েছে। এসব কিছুই স্পষ্ট বার্তা দেয় যে রাশিয়া যে অঞ্চলগুলো এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে, যুদ্ধবিরতি বা যুদ্ধ বন্ধ আলোচনা যদি শুরুও হয়, তাহলে তারা কোনোভাবেই এই দখল ছাড়তে চাইবে না, বরং ইউক্রেনের কিছু ভূমি রাশিয়ার কাছে অর্পণ করার শর্তে এটিকে সফল করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে এই যুদ্ধের ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছেএটি সবার জানা। তিনি তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যেমন সফল হতে চাইবেন, পুতিনের সঙ্গেও সুসম্পর্কের অবনতি চাইবেন না। তাহলে ক্ষতি কার হলো বা হবে? নিশ্চিতভাবেই ইউক্রেনের। 

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলের প্রায় ২০ শতাংশ এখন রাশিয়ার দখলে। তারা এই শীতকে যুদ্ধের মোক্ষম হাতিয়ার বানাতে চাইছে। লক্ষ্যবস্তু করছে দেশটির জ্বালানি ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের বিরুদ্ধে ন্যাটো বা পশ্চিমা জোট কার্যকরভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা করতে এখনো প্রস্তুত নয়। তাহলে কি ইউক্রেনকে আরো বিপদে ফেলে দেওয়া হলো না? এই যুদ্ধের কী নিয়তি অপেক্ষা করছে, সেটি স্পষ্ট করে বলা না গেলেও এটিকে বন্ধ করতে হলে রাশিয়ার ওপর জোর প্রয়োগ করার যে সুযোগ নেই, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। গোটা পশ্চিমা জোট এবং ন্যাটো এক হলেও এটি বন্ধ করতে হলে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করতেই হবে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও বাংলাদেশের অগ্রবর্তী তরুণীসমাজ

    দেবাহুতি চক্রবর্তী
শেয়ার
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও বাংলাদেশের অগ্রবর্তী তরুণীসমাজ

বরাবরের মতোই দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের  প্রতিপাদ্যের অনুরূপ বাংলাদেশে এবারকার ঘোষিত প্রতিপাদ্য—‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন। এর প্রতিটি শব্দ দেশের অগ্রবর্তী তরুণীরা ভালোই বোঝেন, যদিও সঠিক মর্মার্থ উপলব্ধি অনেক বেশি মেধা, নিষ্ঠা, চর্চানির্ভর বিষয়।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিছক করপোরেট সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপিত নমুনা অনুসরণের দিবস নয়।

এর পেছনে রয়েছে কয়েক শ বছরের নারী আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস। যেকোনো রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রধান নির্ণায়ক সে দেশের নারীর প্রকৃত অবস্থান। প্রকৃতিতে সবাই মানবসন্তান হিসেবে জন্মায়। সমাজ, রাষ্ট্র একজন কন্যাশিশুকে নারীতে রূপান্তর করে।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষের ইতিহাসে নারী উপেক্ষিত, পুরুষশাসিত সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নিষ্পেষিত, শোষিত। এই পুরুষতন্ত্রই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের জৈবিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গের মধ্যে অনতিক্রম্য বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে।

এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীর বিক্ষোভ-বিদ্রোহ দীর্ঘদিনের। এই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতাকলের নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ, কাজের অমানবিক পরিবেশ পরিবর্তন ইত্যাদি দাবিতে পথে নামেন।

পুলিশের নির্যাতন ও গুলিতে তাঁদের অনেকেই আহত ও নিহত হন। এই ঘটনার অর্ধশত বছর পেরিয়ে জার্মান সমাজতান্ত্রিক-কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বপরিস্থিতিতে জাতিসংঘে ১৯৪৮ সালে মানবজাতির সব সন্তানের জন্য মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ৮ মার্চকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্য দেশ দিবসটি যার যার মতো করে পালন করে।

বাংলাদেশের তরুণীরা কমবেশি দিনটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানেন। তাঁদের অনেকেই দেশের অনেক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নারীদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ হঠাত্ শুরু হয়নি। ধর্ম ও ঐতিহ্যর নামে এ দেশের নারীদের অপমান, অবমাননা, নির্যাতন, নিষ্পেষণের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। ব্রিটিশ শাসনামলে স্মরণীয়-বরণীয় স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সতীদাহ রোধ, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রতিরোধ, বিধবা বিবাহ আইন পাস ও কার্যকরের প্রচেষ্টা এবং নারী শিক্ষার প্রবর্তন নারীমুক্তির ক্ষেত্রে একেকটি আলোকবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী’—অস্বীকার করে ভারতীয় উপমহাদেশে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রথম নারী, যিনি লিঙ্গ বিভাজন সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নারীসমাজকে বলেন, তোমরা সমস্বরে বল, আমরা মানুষ। একুশ শতকের অগ্রবর্তী তরুণীরা আহ্বানটি হৃদয়ঙ্গম করলে এবারের আলোচ্য প্রতিপাদ্য তাঁদের জীবনকে অন্য মাত্রায় উন্নীত করবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র জেন্ডার সহনশীল হয়ে উঠবে।

হ্যাঁ, আমাদের দেশে সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগতে, বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রযুক্তি ব্যবহারে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও পদায়ন যথেষ্টই দৃশ্যমান। পাশাপাশি নারীর মৃত্যুহার, বাল্যবিবাহ, প্রজননজনিত বিভিন্ন সংকট, অপুষ্টি, আত্মহত্যা, অগ্নি-পানি-বিষে অস্বাভাবিক মৃত্যু, নানা রকম যৌন নির্যাতন ও উত্পীড়ন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, নারী ও কন্যাশিশু পাচার, ভ্রূণ হত্যা, নানা পারিবারিক সহিংসতা, অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকা, শিক্ষা-কর্মক্ষেত্র-গণপরিবহনে নিরাপত্তাহীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধকতাএমন অসংখ্য বৈষম্যও উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান। নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতা, উন্নয়ন রাষ্ট্র ও সংবিধানে কাগজ-কলমে স্বীকৃত। লক্ষণীয় এই যে ৩০ বছরের অধিক সময় আমাদের দেশে সরকারপ্রধান, বিরোধী দলের প্রধান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রধান পদ নারী দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। বুঝতে হবে, এই নারীরা প্রকৃতপক্ষে সেই নারী, যাঁরা পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে নিজেরাই পরিচালিত হয়ে এসেছেন। ক্ষমতার বৃন্ত স্পর্শ করেও পুরুষতন্ত্রকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করতে পারেননি। ব্যবহৃত হয়েছেন। তাঁদের অপশাসন ও যাবতীয় অপকর্ম-অপসংস্কৃতি পর্দার আড়াল থেকে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্দয় মুখোশ উন্মোচন করে। বলা বাহুল্য, ব্যক্তি বা সামগ্রিক পুরুষসমাজ আর পুরুষতন্ত্র এক নয়।

ধনতন্ত্র-পুঁজিবাদের মতো পুরুষতন্ত্র বিশ্বব্যাপী একটি ক্ষমতাব্যবস্থা। দেশে দেশে যার মাত্রাভেদ আছে। সব শ্রম বিভাজনের মধ্যে লিঙ্গ বিভাজনকে প্রধান করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রকে এই ব্যবস্থার অনুগত থাকতে বাধ্য করা হয়। এই তন্ত্রের নিচে চাপা পড়া নিঃশব্দে ক্রন্দনরত নারীকে মুক্তির দিশা দিতে দেশে দেশে যুগে যুগে মানবিক পুরুষদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের শিকড় এত গভীরে যে অনেক সদিচ্ছাসম্পন্ন পুরুষও অবচেতনে অনেক ক্ষেত্রে স্ববিরোধিতার শিকার হয়ে যান। মুক্তির পথটি নারী-পুরুষ সবার জন্যই তাই অনেক পিচ্ছিল হয়ে ওঠে।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১, আবার ১৯৭১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বারবার তরুণীরা জাতির সব সংকটে-সংগ্রামে সব বাধা উপেক্ষা করে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে-আন্দোলনে শরিক হন। এই ঐতিহ্য এ দেশের নারীদের দীর্ঘদিনের। নারীশিক্ষার সামান্যতম সুযোগ পেয়েই উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে অগণিত নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরিক হন। অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। শহীদ হন, কারাবন্দি হন, অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হন। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অন্দরের সঙ্গে বাইরের কৃত্রিম বিভাজন তাঁরা অস্বীকার করেন। সেই সময়কালে বিষয়টি মোটেই সহজ ছিল না।

ক্ষমতার ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। স্বাধীন দেশে নারীর মানবিক মর্যাদার স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় শাসকরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। ১৯৭১ আবার নারীদের বহুদূর পর্যন্ত স্বপ্ন দেখায়। মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা বহুবিধ। তদুপরি অসংখ্য নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হন। অথচ স্বাধীন দেশেও নারীদের মানবিক মর্যাদা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ সেই আদি-অন্তহীন পুরুষতন্ত্র। প্রতিদিনই সচেতন নারীসমাজ কোনো না কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়।

আরেকটু পিছিয়ে দেখি, গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আহ্বানে শত-সহস্র নারী ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে অংশ নেন। অথচ বিজয় লাভের নতুন ভোরে ওল্যাম্প দ্য গুজের নেতৃত্বে যে নারীরা শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, দিনশেষে তাঁরাই পুরুষতন্ত্রের ফতোয়ার শিকার হয়ে গিলোটিনে গর্দান দেন।

ইতিহাসের এই পরম্পরা জানা-বোঝা ও উপলব্ধিতে আনা তরুণীদের জন্য তাই অত্যন্ত জরুরি। দেশ ও দশের বৃহত্তর স্বার্থে, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তরুণীরা অবশ্যই রুখে দাঁড়াবেন। কিন্তু অনেক কথার কথায় সমাজ ও রাষ্ট্র দিনশেষে নারীকে অসমান বখরা দিয়েই সন্তুষ্ট রাখতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ। এখন দেশের অকুতোভয় তরুণীদের হিসাব বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে। দেশ আর দেশজ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে এখনকার প্রজন্মকে নতুন বিশ্বব্যবস্থাও বুঝে নিতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে আন্তর্জাতিক নারী অধিকার-মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার দায়দায়িত্ব রয়ে গেছে। স্বাধীনতা আর সমতা শব্দটিকে ব্যক্তিগত ব্যাবহারিক জীবনের প্রতিটি কোণ থেকে দেখা জরুরি। কারণ সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম বিভিন্ন নামে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দেশের সর্বত্রই অধিকতর নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। নারীর প্রতি আক্রমণ চারপাশ থেকেই বেড়ে চলেছে। নারীর মানবাধিকার আদায়ের প্রশ্নটি তাই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

বুঝতে হবে, কোনো বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহাত্মক অভ্যুত্থান সমাজকে ওপর থেকে পাল্টায়। ক্ষমতার পালাবদল হয়। নারীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। নারীর মানবাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের, এমনকি নারীবাদের প্রগাঢ় তাত্ত্বিকদের অনেকেরই ভেতর ও বাইরে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। একুশ শতকের তরুণীদের তাই নিজেদের মানবিক হিস্যা বুঝে নিতে লিঙ্গবৈষম্য, কন্যাশিশুসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

পুরুষকে অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা বা অস্বীকার করে নারী এই জটিল বাঁধন ছিন্ন করতে পারেন না। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ গঠনে সুসংগঠিত কর্মকৌশল সুসংহত করতে হবে। সমমনা-সহযোদ্ধা পুরুষকে সহযোগী করে তরুণীদের মানবাধিকার ছিনিয়ে আনার প্রত্যয় ঋজু হয়ে উঠুক। সুপ্রাচীন প্রতারক পুরুষতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে এই তরুণীরা দৌড়ে চলুন। পেছনে পড়ে থাকুক ঘেরটোপে ঢাকা একরাশ অনুশাসন আর অন্ধতা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস এই তরুণী নারীদের প্রতি দিবস হয়ে আঘাত হানুক অটল-অনড় পুরুষতন্ত্রকে—‘প্রতিবাদ হোক সহিংসতার, নিশ্চিত হোক মানবাধিকার।

লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

 

মন্তব্য

খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান দরকার

    ড. জাহাঙ্গীর আলম
শেয়ার
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান দরকার

দেশে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে নিয়মিত যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল থাকে কম। আমাদের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন, ভোগ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে সাধারণ মানুষের পুরোপুরি আস্থা থাকে না।

এই আস্থাহীনতা দূর করা দরকার। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে উপস্থাপন করা দরকার সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান। নতুবা যথাযথভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমরা যে গবেষণা করি, তার জন্যও দরকার হয় সঠিক পরিসংখ্যান।
নতুবা তার ফলাফল ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হয় না। অনেক সময় গবেষকরা তাঁদের বিশ্লেষণের মূল ভিত্তি নির্মাণ করেন নিজস্ব সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত থেকে। তবে তার পরিধি থাকে খুবই সীমিত। নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্ধারিত নমুনার ভিত্তিতে প্রণীত হয় ওই সব পরিসংখ্যান।
বৃহত্তর পরিসরে ও জাতীয়ভাবে তা অনেক সময় প্রযোজ্য হয় না। জাতীয়ভাবে প্রণীত পরিসংখ্যান মূলত দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ বা সংস্থা থেকে প্রকাশ করা হয়। তার ওপর প্রচ্ছন্নভাবে আধিপত্যমূলক প্রভাব থাকে ক্ষমতাসীন সরকারের। তারই ইঙ্গিতে কখনো পরিসংখ্যান হয় অতিরঞ্জিত, স্ফীত। আবার কখনো হয় কম মূল্যায়িত।
নিকট অতীতে এ ধরনের আলোচনা-সমালোচনা বরাবরই আমরা শুনে এসেছি।

বিগত সরকারের আমলে প্রায় ১৫ বছর ধরে নিয়মিতভাবে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা হয়েছে। এতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে প্রায় ৬ থেকে ৮ শতাংশ। এর সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের উপলব্ধি তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তবে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বরাবরই তাতে আপত্তি জানিয়েছে। তারা ওই হিসাব থেকে এক থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত কম অনুমান করেছে। দেশে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান দরকারবিদ্যমান জনজীবনের আর্থিক অবস্থা, ভোগ চাহিদা ও বিনিয়োগের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিগত সরকার প্রদর্শিত জিডিপির প্রবৃদ্ধি অনেকের কাছেই অতি মূল্যায়িত মনে হয়েছে। এর ঠিক উল্টো অবস্থা আমরা লক্ষ করেছি মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। কাগজে-কলমে মূল্যস্ফীতির হার সীমিত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ৫-৬ শতাংশের মধ্যে। কখনো তা প্রদর্শন করা হয়েছে ৭-৮ শতাংশে। বাস্তবে তা অনেক সময় দুই ডিজিটও অতিক্রম করে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সম্পর্কে মানুষের সন্দেহ ও অনাস্থা ছিল প্রবল। গত জুলাই মাসে এই হার ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। অনেকে অনুমান করেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি। একইভাবে সরকার বেকারত্বের হার কম দেখিয়ে স্বস্তি পেতে চেয়েছে। বিভিন্ন হিসাবে তা দেখানো হয়েছে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ। বেকারত্বের ক্ষেত্রে উপস্থাপিত সংখ্যার কারণেও এই হারে কিছুটা তারতম্য ঘটেছে। তবে সাধারণভাবে দেশে বেকার মানুষের ঘনত্ব বিবেচনায় প্রদর্শিত হার অনেক কম বলে ধারণা করা হয়েছে। এমনিভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বিগত সরকার। জনতুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে অনেকটা বিফল হয়ে পুষ্পশোভিত পরিসংখ্যান দিয়ে জন-অসন্তোষ ঢাকতে চেয়েছে।

দেশের পণ্য উৎপাদন, চাহিদা এবং স্থিতির পরিসংখ্যান সম্পর্কে অতীতে সরকারের সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃষি পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করা যায়। অনেক সময় সরকারি ভাষ্যকে অতিকথন বলে মনে হয়েছে। প্রায়ই বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রয়েছে। অথচ প্রায় প্রতিবছরই গড়পড়তা ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে বিদেশ থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। স্বাধীনতার পর মোট আমদানির পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টন। এরপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় আড়াই শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে ১.২ শতাংশে। অন্যদিকে মোট খাদ্যশস্যের কথিত উৎপাদন এক কোটি টন থেকে বেড়ে হয়েছে পাঁচ কোটি টনেরও অধিক। অথচ খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ সে অনুপাতে হ্রাস না পেয়ে বরং বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। এ ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনের পরিসংখ্যান অতি মূল্যায়িত ভাবা অস্বাভাবিক নয়। অতি সম্প্রতি দেশে বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই স্ফীত; যে কারণে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেক সময় পণ্যের সরবরাহ সংকট হেতু বাজার অস্থির হয়ে পড়ছে। পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আমদানির আগাম প্রস্তুতি না থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ২০২৩-২৪ সালের আলু উৎপাদনের হিসাব সম্পর্কে উল্লেখ করা যায়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে আলুর উৎপাদন ছিল এক কোটি ছয় লাখ টন। খাদ্য চাহিদা ও বীজ মিলে আমাদের বার্ষিক সর্বোচ্চ চাহিদা ৯০ লাখ টন। এতে ১৫-১৬ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু বাজারে অস্থিরতা ও আলুর মূল্যবৃদ্ধি দেখে ধারণা করা হয়েছে যে ওই পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত ও স্ফীত ছিল। কারণ বিদেশ থেকে আলু আমদানি করেও মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি। বাজারে আলু বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কোল্ড স্টোরেজগুলোতে অন্যান্য বছরে যেখানে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হতো, সেখানে গত অর্থবছরে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ মিলেও ৩০ লাখ টন আলু মজুদ ছিল না।

পেঁয়াজের উৎপাদন বার্ষিক ৩৪-৩৫ লাখ টন বলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে দাবি করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। আমাদের দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। তার পরও প্রতিবছর ন্যূনপক্ষে ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। অনেক সময় পেঁয়াজের দাম হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। ভারত থেকে পেঁয়াজের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে বাংলাদেশে এর আকাল নেমে আসে।

চালের উৎপাদন নিয়ে সব সময়ই বিভ্রান্তি বিরাজ করে। আমাদের বার্ষিক উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বিশাল উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়। অনেক সময় আমদানি কম হলে সরবরাহ সংকটের কারণে চালের দাম বেড়ে যায়। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের চালের উৎপাদন ছিল চার কোটি সাত লাখ মেট্রিক টন। ১৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের জন্য বার্ষিক খাদ্য চাহিদা সর্বোচ্চ তিন কোটি ৭৩ লাখ টন। এতে উদ্বৃত্ত থাকার কথা ৩৪ লাখ টন চাল। কিন্তু বাজারের অস্থিরতা ও মূল্যবৃদ্ধি দেখে মনে হয়নি এই উৎপাদনের পরিসংখ্যান সঠিক। ইউএসএআইডির হিসাব অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন হয়েছিল তিন কোটি ৭০ লাখ টন। অর্থাত্ বাংলাদেশের সরকারি তথ্য অনুসারে চালের উৎপাদন ৩৭ লাখ টন বেশি দাবি করা হয়েছিল। এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে চালের উচ্চমূল্যের কারণে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা আমদানিতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু গমের আমদানি ছিল রেকর্ড উচ্চতায় ৬৬ লাখ মেট্রিক টন।

২০২৪ পঞ্জিকা বর্ষের আমন চালের উৎপাদন এক কোটি ৭১ লাখ টন বলে দাবি করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। ইউএসএআইডি বলেছে, উৎপাদন হতে পারে এক কোটি ৪০ লাখ টন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পর পর বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে চালের উৎপাদন অনেক কম হয়েছে। দেরিতে চারা রোপণের কারণে হেক্টরপ্রতি ফলনও কম হয়েছে। কিন্তু তার প্রকৃত চিত্র কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানে নেই। তবে সাম্প্রতিক অস্থির চালের বাজারের অবস্থা দেখে মনে হয় না যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব সঠিক। বিবিএস এখনো এবারের আমন চাল উৎপাদনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। ওরা এত দেরি করে পরিসংখ্যান দেয়, যখন এর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। এর ওপর ভিত্তি করে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন পরিসংখ্যান নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তির অবকাশ আছে। বর্তমানে দুধ, মাংস ও মাছের বার্ষিক উৎপাদন যথাক্রমে ১৪১, ৮৮ ও ৪৯ লাখ মেট্রিক টন। ডিমের উৎপাদন দুই হাজার ৩৩৮ কোটি। গত ১৫ বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দুধের ক্ষেত্রে বার্ষিক ১২ শতাংশ, মাংসের ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ, ডিমের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ এবং মাছের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ শতাংশ। পণ্যের উৎপাদনে এত বেশি প্রবৃদ্ধি যখন হয়, তখন পণ্যমূল্য এত বেশি বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক নয়। কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যাড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে প্রদত্ত দৈনিক জনপ্রতি দুধ, মাংস, ডিম ও মাছ ভক্ষণের পরিসংখ্যানের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যের মিল নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) মোট দুধ উৎপাদনের যে হিসাব দিচ্ছে, সে অনুযায়ী দৈনিক জনপ্রতি দুধের প্রাপ্যতা ২২৫ গ্রাম। অথচ বিবিএসের তথ্য মতে, জনপ্রতি দুধের ভোগ মাত্র ৩৪ গ্রাম। ডিএলএসের তথ্য মতে, মাংসের প্রাপ্যতা জনপ্রতি ১৪০ গ্রাম, ডিম ১৯ গ্রাম, মাছ ৭৯ গ্রাম এবং মাছ-মাংস মিলে ২১৯ গ্রাম। বিবিএসের তথ্য মতে, মাংসের ভোগ ৪০ গ্রাম, ডিম ১৩ গ্রাম, মাছ ৬৮ গ্রাম এবং মাছ-মাংস মিলে ১০৮ গ্রাম। দুটি পরিসংখ্যানের মধ্যে বিশাল ফারাক।

ডিএলএসের তথ্যে মনে হয়, আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন জাতীয় চাহিদার একান্ত কাছাকাছি, যা খুবই ভালো। আর তা-ই যদি হয়, তাহলে এসব পণ্যের দাম এত বেশি কেন? পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যখন ডিমের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি পিস ছয় টাকা, তখন সেটি এখানে ১৪-১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দুধের দাম পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। বর্তমানে প্যাকেটজাত দুধ প্রতি লিটার ১০০ টাকা, প্রায় এক ডলার। এটি বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে উৎপাদন খরচ আমাদের চেয়ে অর্ধেক। তারা সারা বিশ্বে সরবরাহ করছে দুধ। ডিম, মাছ ও মাংসের উৎপাদন খরচও বাংলাদেশে বেশি। ব্রাজিল ৫০০ টাকার কমে এক কেজি মাংস বাংলাদেশে সরবরাহের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাহলে তাদের উৎপাদন খরচ আরো কম। আর বাংলাদেশে ৮০০ টাকার বেশি দামে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের উৎপাদন খরচ কমানোর উপায় হচ্ছে দক্ষভাবে আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করা। প্রডাকশন স্কিল বাড়ানো। সে জন্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা দরকার।

বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রদানের রাষ্ট্রীয় সংস্থা হচ্ছে বিবিএস। এই সংস্থাটির কাছ থেকে সঠিক পরিসংখ্যান প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আমরা আশা করতে পারি। কিন্তু সংস্থাটির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে। সে কারণে সংস্থাটিকে একটি স্বতন্ত্র ও প্রকৃত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাঁদের কাজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। নির্মোহভাবে কাজ করে তাঁদের জাতির সামনে সঠিক পরিসংখ্যান উপস্থাপনে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বিভ্রান্তিকর, অতি মূল্যায়িত ও অবমূল্যায়িত তথ্য প্রদান থেকে তাঁদের বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় সঠিকভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

মন্তব্য

কারাগার থেকে হৃদয়ের মণিকোঠায় তারেক রহমান

    ড. মোর্শেদ হাসান খান
শেয়ার
কারাগার থেকে হৃদয়ের মণিকোঠায় তারেক রহমান

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন করে নাম লেখাল বাংলাদেশ। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে কেবল একটি সরকারের পতনই নয়, পলায়নেরও সাক্ষী হলো বিশ্ববাসী। কেননা একসঙ্গে একটি সরকারের সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে যাওয়ার এই রেকর্ড এর আগে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেনি।

হাসিনা পতনের এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে থেকে ছাত্র-জনতাকে উজ্জীবিত করেন। আওয়ামী সরকারের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যুবসমাজকে ভিডিও বার্তায় সাহস জোগান। তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত বক্তব্য স্বৈরাচারের স্বরূপ উন্মোচনে ভূমিকা রাখে।

ফলে দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয় দেশবাসী। দেশ-বিদেশে গণ-অভ্যুত্থানের বিস্তার ঘটে, যা অগ্নস্ফুিলিঙ্গের মতো বিশ্বকে নাড়িয়ে বিপ্লবের স্বপ্নসারথিদের বিজয় এনে দেয়। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা এখন দেশে-বিদেশে আলোচনার বিষয়।

তারেক রহমান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাঁর অভিষেক ঘটে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। সে সময় ওই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আন্দোলনের অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে মা খালেদা জিয়ার যোগসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তারেক রহমান। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর থেকে তারেক রহমানের নেতৃত্বগুণের প্রকাশ পেতে থাকে, যদিও কৈশোরে বাবা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং পরে মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনা ও নেতৃত্বগুণে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের এই বিকাশমান অবস্থানকে ধীরে ধীরে ভয় পেতে থাকে দেশবিরোধী শক্তিগুলো।

কেননা ওই শক্তিগুলোর প্রধান ভয় ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। জিয়া পরিবারের ক্রমবিকাশমান রাজনৈতিক ধারা তাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চেতনা ও আধিপত্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ অবস্থান তাদের অস্তিত্ব সংকটের সৃষ্টি করে। আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর অব্যাহত ষড়যন্ত্রের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে সংঘটিত হয় রাজনৈতিক সংঘাত। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উদ্ভব ঘটে। মূলত দেশপ্রেমিক জিয়া পরিবারকে দেশের রাজনীতি থেকে উত্খাত করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তখনই।

কারাগার থেকে হৃদয়ের মণিকোঠায় তারেক রহমানএরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে বন্দি করা হয়, যা ছিল সামগ্রিকভাবে এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সেই স্বপ্নকে সেদিন বন্দি করা। পরবর্তী সময়ে তাঁর নামে ১৩টি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনও দেওয়া হয়। তাঁকে ছয় দফায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনও করা হয়। তাঁর ওপর দেশ ও রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করা হয়।

তবে দেশ ও দেশের জনগণের কথা ভেবে কুশীলবদের কোনো প্রস্তাবেই রাজি হননি তিনি। ২০০৭ সালের ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের অনুমতি নিয়ে তারেক রহমান তাঁর ওপর করা অমানবিক নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন। সরকারের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন ও যথোপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা না হওয়ায় তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তাঁকে পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। এরপর আদালতের চিকিৎসকদের দেওয়া মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়, তারেক রহমানের স্পেশালাইজড অর্থোপেডিক ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। নির্যাতনে তাঁর মেরুদণ্ডের ৬ ও ৭ নম্বর হাড় ভেঙে গেছে। কয়েকটি হাড় বেঁকে গেছে। মেরুদণ্ডের ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে গেছে। চোখ ও হৃদযন্ত্রে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে পর্যায়ক্রমে তিনটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। মেডিক্যাল বোর্ডগুলোর পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেক রহমানকে বিদেশের অর্থোপেডিক, ফিজিওথেরাপি, কার্ডিওলজি ও রেডিওগ্রাফির সুবিধাসংবলিত যেকোনো হাসপাতালে অতি দ্রুত ভর্তি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এরপর তাঁর স্বাস্থ্যের আরো অবনতি হতে থাকলে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তিলাভ ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে রাজপথে শুরু হয় আন্দোলন। এতে সরকারের টনক নড়ে এবং তারা তারেক রহমানকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিতে সম্মত হয়। কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভীক তারেক রহমান নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে অনড় থাকেন এবং এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্তি লাভ করেন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পান।

সেই থেকে তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন। তবে কঠিন সময়েও তিনি দেশ ও দল থেকে বিচ্ছিন্ন হননি ক্ষণিকের জন্যও। হাজার মাইল দূর থেকেও তিনি নিয়মিত সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে তিনি সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতারাসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতাকর্মীদের একসূত্রে গেঁথে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য দেখান। তাঁর দিকনির্দেশনায় হাসিনাবিরোধী আন্দোলন এ দেশের গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। জনগণ বুঝতে পারে, শেখ হাসিনা একজন স্বৈরশাসক। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার-মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হলে খুনি হাসিনাকে উত্খাতের বিকল্প নেইএই ধারণাটি মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যায়। চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান জনতার সেই সচেতন রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, সাধারণ কর্মী থেকে নেতাএই যে শ্রেণিভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শনের উন্মেষ, সে তো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানেরই রাজনৈতিক দর্শন, যা কিনা তাঁরই উত্তরাধিকার তারেক রহমান প্রবাহিত করতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন।

ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যখন তার পথ হারিয়ে ফেলে, তখনই এগিয়ে আসেন শহীদ জিয়ার গর্বিত উত্তরাধিকার তারেক রহমান। দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে তিনি ঘোষণা করেন রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা। গণতন্ত্রের পুনঃস্থাপন, ক্ষমতার ভারসাম্য ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা, মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নারী ও যুব উন্নয়ন, পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নসহ শিক্ষা খাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় এই ৩১ দফার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন শুধু সরকারের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য একটি স্বপ্নের প্রস্তাব, যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হবে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা ও দাবি পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটি মূলত তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনেরই প্রতিবিম্ব।

শিরোনামে ফিরতে চাই এবার। তারেক রহমানকে যখন কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি ছিলেন একজন উদীয়মান রাজনীতিক। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের একজন সিপাহসালার। এরপর কেটে গেছে আরো প্রায় দুই দশক। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের বিকাশ-বিচ্যুতি দেখেছেন। রাজনীতির মাঠে খেলেছেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে। দলকে সুসংগঠিত করে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে করেছেন লাগাতার লড়াই-সংগ্রাম। তাঁর নেতৃত্বে দল হয়েছে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী। সব শেষে চব্বিশের হাসিনা পতন আন্দোলনে তিনি ও তাঁর দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাঠে। জনগণের মৌল-মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাঁর দলের অসংখ্য নেতাকর্মী। এসব কারণে রাজনীতিক তারেক রহমান এখন আর কোনো নির্দিষ্ট দল-মতের মানুষের নেতা নন। তিনি এ দেশের মুক্তিকামী আপামর জনতার প্রিয় নেতৃত্ব।

২০০৭ সালের আজকের এই দিনে তাঁকে রাজনীতি থেকে সরানোর খায়েশে যে দেশবিরোধী শক্তিটি ষড়যন্ত্র করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল, তারা আজ পরাজিত হয়েছে। জনরোষের কবলে পড়া ওই গোষ্ঠীর অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে এখন কারাগারে। আর বিপ্লব-দ্রোহের সেই দিনগুলোতে সঠিক নেতৃত্ব  দেওয়া তারেক রহমান স্থান পেয়েছেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষের মনের মণিকোঠায়। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। কেননা তিনি মুক্তিকামী মানুষের ত্রাতা, আজ এবং আগামীর।

লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

আয় বৃদ্ধি করতে অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই

    আব্দুল বায়েস
শেয়ার
আয় বৃদ্ধি করতে অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই

ইউজিরো হায়ামি  ও এম কিকুচি লিখিত একটি বইয়ে  অবকাঠামোর ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত করেছেন এভাবে : গ্রামের একজন বৃদ্ধ লোক দুষ্টুমির সুরে বললেন, বিদ্যুতের বাতি আসার ফলে দম্পতিরা আর অতীতের মতো বেশির ভাগ সময় বিছানায় কাটায় না; আজকাল তারা টেলিভিশনের বিনোদন ও অন্যান্য কাজে সময় ব্যয় করে। এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটির বক্তব্যে যে সত্যতার ছাপ আছে তার প্রমাণ সত্তরের দশক থেকে গ্রামটিতে জন্মহার তীক্ষভাবে হ্রাস পেতে থাকে। পি ম্যালানি নামে এক গবেষক দারিদ্র্য-ফাঁদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, চরম দারিদ্র্যে আক্রান্ত খানাগুলো সনাতনি জ্বালানি বেশি ব্যবহার করে বলে অভ্যন্তরীণ দূষণের সৃষ্টি হয়, মহিলাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং স্বাভাবিকভাবেই তখন শিশুসন্তান অকালে মৃত্যুবরণ করে।

আর শিশুর মৃত্যুর কারণে শিশুর চাহিদা বৃদ্ধি জন্মহারকে উসকে দেয়। তাই জন্মহার তথা জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমাতে হলে গরিবের ঘরে আধুনিক জ্বালানির সরবরাহ অপরিহার্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিদ্যুতের বাতি আর জ্বালানি উভয়ই কিন্তু অবকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুধু গবেষক নন, বেশির ভাগ গরিব তাদের দারিদ্র্যের জন্য রাস্তাঘাট, পরিবহন, বিদ্যুত্, পানি, স্বাস্থ্যসেবার অপর্যাপ্ততা বা অনুপস্থিতিকে দায়ী করে থাকে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দরিদ্রের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পেশ করা মতামত তা-ই বলে। যেমননাইজেরিয়া কিংবা উগান্ডার গরিব শ্রেণি মনে করে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলে তাদের দারিদ্র্যের  প্রকোপ ও তীব্রতা অনেকটা হ্রাস পেত। বাংলাদেশ, ভারত, ইয়েমেন, উগান্ডা ইত্যাদি দেশে দরিদ্রতম সম্প্রদায়গুলো বিচ্ছিন্ন বদ্বীপে বাস করে রাস্তা বা বাজার থেকে অনেক দূরে। সুতরাং গবেষক আর গরিব একই সুরে বলছে, উন্নয়ন (এবং সেই হেতু দারিদ্র্য হ্রাস ) রাস্তাকে অনুসরণ করে।

দুই.

কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে অবকাঠামোগত সুবিধা এই যে তা বাজারজাতকরণের খরচ নিমিত্তে কমিয়ে দেয়। আহমদ ও হোসেন একটি অধ্যয়নের সূত্র থেকে ব্যক্ত করেছেন যে এশিয়ার কৃষকরা যেখানে ভোক্তামূল্যের ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ হাতে পান, আফ্রিকার কৃষকরা সেখানে পান ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। আরো দেখা যায়, দুই মহাদেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান পরিবহন খরচের ব্যাপক পার্থক্য এই ব্যবধানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সৃষ্টি করে।

আন্তর্জাতিক বাজারের আপেক্ষিক সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যবর্তী ব্যবধানে অবকাঠামো একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এই উঁচু ব্যবধান রপ্তানিমূল্যকে বাড়িয়ে দেয় এবং এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশটির আপেক্ষিক সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ আমদানি পণ্যের মূল্যকে স্ফীত করে। অর্থাত্ বাজারজাতকরণের খরচ বৃদ্ধিতে বাণিজ্য ব্যাহত হয়। এমনিভাবে অবকাঠামো দ্বারা প্রভাবিত বাজারজাত খরচের ভিন্নতা আন্তর্জাতিক কিংবা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রসারে ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

দাম সঞ্চারিত করার প্রক্রিয়ায় অবকাঠামোর ভূমিকা কম নয়। বলা হয়ে থাকে যে দামবৈষম্য, বাজার বিভাজন এবং তথ্যপ্রবাহে অসমতার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে অবকাঠামো সুবিধার অনুপস্থিতি। একটি অধ্যয়নে দেখা যায়, এশিয়ায় মুদ্রা অবমূল্যায়নের স্বল্পকালীন প্রভাব হিসেবে খামার পর্যায়ে পণ্যের দাম ৫০ শতাংশ, কিন্তু আফ্রিকান দেশে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে।

উন্নয়নশীল দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এবং খানার প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে শ্রম। শ্রমবাজারে এই অপূর্ণতাবিশেষত জমি, ঋণ এবং পণ্য বাজারের সঙ্গে পরস্পর পরিবদ্ধতাগ্রামাঞ্চলে আয় ও কর্মসংস্থান সংঘটনে একটি বিরাট বাধা হিসেবে চিহ্নিত। বলা যায়, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি এই অপূর্ণতা ও পরস্পর পরিবদ্ধতার বেশির ভাগ কারণ।

আয় বৃদ্ধি করতে অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেইপ্রযুক্তি প্রচার বা ব্যাপনে অবকাঠামোর ভূমিকা স্বীকৃত। অবকাঠামো ভালো হলে সম্প্রসারণকর্মীর পক্ষে দূর-দূরান্তে প্রযুক্তিগত ধারণা পৌঁছানো সম্ভবপর হয়। সাধারণত সম্প্রসারণ বিভাগের প্রদর্শনীর ভূমিখণ্ডগুলো সেখানেই বেছে নেওয়া হয়, যেখানে অবকাঠামোগত সুবিধা অপেক্ষাকৃত বেশি। আধুনিক প্রযুক্তির সূত্রপাত শহরে, কিন্তু কেবল ভালো অবকাঠামোর মাধ্যমে খুব দ্রুততার সঙ্গে তা কৃষকের কাছে পৌঁছতে পারে। যথাযথ অবকাঠামোর অভাবে কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যসেবা, ঋণ ও সরকারি সাহায্য যথাসময়ে এবং ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়ে পৌঁছাতে পারে না। এর ফলে এসব সেবাপণ্যের ভোগ পরিমাণ এবং প্রবণতা কম থাকে। ভালো অবকাঠামো খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বিস্তারে সাহায্য করে। অবকাঠামোগত দিক থেকে উন্নত গ্রামগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয় এবং অ-কৃষি শ্রমবাজার তেজিভাব ধারণ করে। মনে রাখা দরকার, অবকাঠামো সরাসরি কোনো কর্মসংস্থান বা আয় সৃষ্টি করে না; একটি পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে তা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

তিন.

সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে উন্নত গ্রামের (রাস্তার সন্নিকটে) অনুপাত বেড়েছে এবং একই সময়ে আধা-উন্নত গ্রামের অনুপাত প্রান্তিক বেড়েছে। অর্থাত্ অনুন্নত গ্রামের অনুপাত কমেছে। এ প্রবণতা অস্বাভাবিক নয়। কারণ আশি ও নব্বইয়ের দশকে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নের ব্যাপক বিস্তৃতির কথা শোনা যায়।

সময়ের বিবর্তনে শস্য-নিবিড়তার ক্ষেত্রে উন্নত গ্রামগুলো অন্য গ্রামের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছে। এর কারণ হতে পারে এই যে পাকা রাস্তার কারণে উন্নত গ্রামগুলো সঠিক সময়ে এবং সঠিক দামে অতি দ্রুত উপকরণ হাতে পাওয়ার সুযোগ লাভ করে। তা ছাড়া একই ধরনের সুবিধা এসেছে বাজারজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতির ফলে। দ্বিতীয়ত, তুলনীয় সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে উন্নত গ্রামে সেচের অধীন জমির অনুপাত দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্য গ্রামে বৃদ্ধির মাত্রা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আবার আধুনিক প্রযুক্তি পরিগ্রহণের ক্ষেত্রেও উন্নত গ্রামগুলো সবার ওপরে থাকছে। বলা বাহুল্য, অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে ওই সব গ্রামে কৃষি উপকরণ, সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ড এবং পণ্য বাজারজাতকরণের সুবিধা বৃদ্ধি পায়। এবং সব শেষে সময়ের বিবর্তনে উন্নত গ্রামগুলোতে ধানের উৎপাদনমাত্রা বৃদ্ধি পায় ৬৯ শতাংশ, যা অন্য গ্রামের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি। তাই প্রতীয়মান হওয়া স্বাভাবিক যে ধানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে গ্রামীণ অবকাঠামো; যথাপাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের একটা ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে।

গ্রামের খানাগুলোর সার্বিক কল্যাণসম্পদ সঞ্চয়নের ওপর নির্ভরশীল। সম্পদ সঞ্চয়ন কৃষি ও অ-কৃষি উভয় খাতেই ঘটতে পারে। আমরা দেখছি যে আধা-উন্নত ও অনুন্নত গ্রামের চেয়ে উন্নত গ্রামে কৃষিজাত স্থায়ী সম্পদের স্বত্বাধিকার অপেক্ষাকৃত কম, এমনকি উন্নত গ্রামে কৃষি পুঁজির সঞ্চয়ন কমেছে। কৃষিবহির্ভূত স্থায়ী পুঁজির ক্ষেত্রে সব গ্রামেই ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়, তবে এ ক্ষেত্রে উন্নত গ্রামে বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। অর্থাত্ অবকাঠামো যেখানে উন্নত, সেখানে কৃষিবহির্ভূত স্থায়ী পুঁজির প্রয়োজন যেমন বেশি, সঞ্চয়নও তেমন বেশি। অন্যদিকে অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে উন্নত গ্রামগুলোতে ঋণগ্রহীতা খানার অনুপাত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি ঘটেছে। অন্য গ্রামগুলোতেও এই অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে থাকলেও তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আবার যদি মাথাপিছু ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি বিশ্লেষণে আসে, আমরা দেখি এই প্রবণতার তেমন কোনো ব্যতিক্রম নেই। অর্থাত্ অনুন্নত বা আধা-উন্নত গ্রামের তুলনায় উন্নত গ্রামে মাথাপিছু ঋণ লভ্যতা বেশি।

এবার আসা যাক মানবপুঁজি সংঘটনের কথায়। দেখা যাচ্ছে যে যদিও ভিত্তি বছরে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল, মানবপুঁজি সঞ্চয়নের ক্ষেত্রেও উন্নত গ্রামগুলো এগিয়ে আছে। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে একসময় মানবপুঁজির মাত্রায় পিছিয়ে থাকা গ্রামগুলো অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে সামনে চলে আসছে। অন্যদিকে এগিয়ে থাকা গ্রামগুলো পিছিয়ে পড়ছে সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার জন্য। উন্নত অবকাঠামো যে শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করে, এটি তার প্রমাণ। সব শেষে উন্নত অকাঠামো যেখানে আছে, সেখানে কৃষির তুলনায় অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য বেশি। এটি খুবই স্বাভাবিক যে পাকা রাস্তা আর বিদ্যুত্ থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি শক্তিশালী হয় কৃষি ও অ-কৃষি সংযোগ প্রভাবটি। বোধ করি, এ কারণেই উন্নত গ্রামে অ-কৃষিজাত কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি বেশি হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে খানার সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনার ক্ষেত্রে সম্পদ সঞ্চয়ন একটি দরকারি শর্ত মাত্র; খানার কল্যাণ নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট শর্ত হচ্ছে প্রাপ্ত সম্পদের উৎপাদনশীলতার মাত্রা। উৎপাদনশীলতা অর্থাত্ এককপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেয় দুর্লভ সম্পদের অর্থনৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে খানাগুলো কল্যাণ বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা দেখছি যে আধা-উন্নত ও অনুন্নত গ্রামের তুলনায় উন্নত গ্রামের মাথাপিছু আয় বেশি। শুধু কি তাই? সময়ের ব্যবধানে উন্নত গ্রামগুলোতে আয় বৃদ্ধির হার অন্য গ্রামের চেয়ে অধিক। যে ব্যাপারটি লক্ষণীয়, তা হলো এই যে ভিত্তি বছরে উন্নত গ্রামে মাথাপিছু আয় প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক কম ছিল সত্য, তবে পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের প্রাপ্যতা অ-কৃষি শ্রমিকের মাথাপিছু আয় প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দেয়। কারণটি আর কিছুই নয়। অবকাঠামোগত সুবিধা আয় উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে, বাজারে প্রবেশগম্যতা গভীরতর করে এবং সামাজিক নির্দেশকগুলোকে উন্নীত করে। তাই গ্রামীণ খানাগুলোর আয় বৃদ্ধি করতে অবকাঠামো উন্নয়নের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ