ঢাকা, বুধবার ০৯ এপ্রিল ২০২৫
২৬ চৈত্র ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, বুধবার ০৯ এপ্রিল ২০২৫
২৬ চৈত্র ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৬
৬ সেপ্টেম্বর : ডায়াবেটিক সেবা দিবস

ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের স্বাস্থ্যেরও সম্পর্ক আছে

অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী
অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী
শেয়ার
ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের স্বাস্থ্যেরও সম্পর্ক আছে

ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুখের ভেতরের দাঁতে, মাড়িতে, জিহ্বার বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ভালো দাঁতের যত্ন মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস মুখের ভেতরের অনেক অংশের যেমনদাঁত ও মাড়িতে ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের মাড়ির রোগ মুখগহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যত্ন নিলে এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরো খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখকে বা মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমনহৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে।

ডায়বেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারে তরল, যা মুখকে ভেজা রাখে। মুখের ভেতরের লালা দাঁতের ক্ষয় রোধ করে খাবারের টুকরা ধুয়ে ফেলে, ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধে এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত এসিডের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লালায় খনিজ উপাদান রয়েছে, যা মুখের টিস্যু রক্ষা করতে এবং দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্তক্ষয় বেশি হয়।
ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখগহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয় তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে।

এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে নরম আঠালো ফিল্ম প্লেক তৈরি করে। এটি  দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয় তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এই সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে।

 

মাড়ির রোগ

মাড়ির রোগ, যাকে পিরিওডন্টাল গাম ডিজিজও বলা হয়। এটি ডায়াবেটিস সম্পর্কিত মুখের সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় রোগ এবং গুরুতর সমস্যা সৃষ্টিকারী রোগ। চিকিৎসা না করা হলে রোগটি পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়, মাড়ি ফোলা বা রক্ত পড়া অবস্থা থেকে দাঁত পড়ে যাওয়া পর্যন্ত। রক্তে গ্লুকোজের উচ্চ মাত্রা উপস্থিতি মাড়ির রোগ মৃদু থেকে গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমনজিনজিভাইটিস থেকে পিরিওডনটাইটিজ।

জিনজিভাইটিস : মাড়ির রোগের প্রথম পর্যায় হলো মাড়ির প্রদাহ, দাঁতের চারপাশে নরম টিস্যুগুলোর অর্থাৎ মাড়ির একটি হালকা প্রদাহ। মাড়ির কাছে দাঁতে প্লাক এবং টার্টার তৈরি হলে মাড়িতে জ্বালাপোড়া এবং প্রদাহ সৃষ্টি হলে মাড়ির প্রদাহ হয়। এতে মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যেতে পারে এবং দাঁত ব্রাশের সময় বা শক্ত ফল খাওয়ার সময় রক্তপাত হতে পারে।

পিরিওডনটাইটিস : চিকিৎসা না করা হলে মাড়ির প্রদাহ পিরিয়ডনটাইটিসে অগ্রসর হতে পারে, মাড়ি এবং হাড়ের একটি সংক্রমণ, যা দাঁতকে মাড়ি থেকে আলগা করে রাখে। মাড়ি দাঁত থেকে সরে যেতে থাকে, পকেট তৈরি করে, যা ধীরে ধীরে সংক্রমিত হয়। মুখের ব্যাকটেরিয়া এবং সংক্রমণের ফলে দাঁতকে ধরে রাখে এমন হাড় এবং টিস্যু যেমনপিরিওডন্টাল মেমব্রেন ও এলভিউলর বোন ভেঙে দিতে শুরু করে। যদি পিরিওডনটাইটিসের চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে দাঁত আলগা হয়ে যেতে পারে এবং এমনকি তুলে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় নিজে থেকেই দাঁত নড়তে নড়তে পড়ে যেতে পারে।

 

আলসার এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোগ

শুকনা মুখ লালার অভাব, যা মুখের ভেতরে ঘা বা আলসার এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোগের কারণ হতে পারে। এ অবস্থাকে ড্রাই মাউথ বলে। অনেক সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও এমনটা হয়। থ্রাশ একটি ছত্রাক সংক্রমণ, যা মুখে বেদনাদায়ক, সাদা দাগ সৃষ্টি করে। বানিং মাউথ সিনড্রোম মুখের ভেতরে একটি জ্বলন্ত অনুভূতি, যা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রার কারণে হয়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্যের যেকোনো পরিবর্তন সম্পর্কে ডেন্টিস্টকে আপডেট রাখা জরুরি এবং নিয়মিত পরিষ্কার বা স্কেলিং এবং চেকআপের জন্য কত ঘন ঘন আসা উচিত তা জিজ্ঞাসা করাও প্রয়োজন। ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কিভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ অনুসরণ করা প্রয়োজন।

 

কিভাবে মুখ সুস্থ রাখা যায়?

   রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা প্রয়োজন।

   স্বাস্ব্যকর খাবার এবং পানীয় গ্রহণের ব্যাপারে ডায়েটিশিয়ান যেভাবে আপনার ওজন, উচ্চতা এবং বয়স মেপে খাবার পরিকল্পনা করেছেন, তা অনুসরণ করা ভালো।

   নিয়মিত একজন ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।

   মুখের যত্ন নেওয়ার জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করলে বা দেরি করলে অবস্থা আরো খারাপ করতে পারে।

 

লেখক : প্রফেসর ও সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানসমাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা

 

 

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

নিজেই বানান

ফার্স্ট এইড কিট

শেয়ার

কিশোরীদের খাওয়াদাওয়া

    ছোটবেলায় সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললে ভবিষ্যতেও সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন করতে পারে সবাই। এ কথাটি নারীদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তাই বয়ঃসন্ধিকালেই সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। কিশোরীদের সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করার উপায় জানাচ্ছেন পুষ্টিবিদ নূরে কদর তিসা
শেয়ার
কিশোরীদের খাওয়াদাওয়া
জাংক ফুড নয়, চাই সুষম খাবার। ছবি : সংগৃহীত

মেয়েদের জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এর স্থায়িত্বকাল ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত। শুধু শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং বিকাশের সময়ই নয় বয়ঃসন্ধিকাল, বরং ভবিষ্যৎ সুস্থতার ভিত্তি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপও বটে। এ সময় শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমনহাড়, পেশি, মাংসপেশি এবং হরমোনাল সিস্টেমে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি সমীক্ষা অনুযায়ী

  ৪০% কিশোরী রক্তস্বল্পতায় (অ্যানিমিয়া) ভুগছে।

  ২৫% কিশোরীর শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি রয়েছে, যা ভবিষ্যতে হাড়ের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

  ৩০% কিশোরী অপুষ্টির শিকার, যা উচ্চতা ও ওজন বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।

তাই এই বয়সে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টি গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক খাবার গ্রহণ শক্তি, মনোযোগ এবং শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ভুল খাদ্যাভ্যাস কিশোরীদের স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে।

যা খেতে হবে

শক্তি ও রক্ত তৈরিতে সহায়ক আয়রনসমৃদ্ধ খাবার : লাল মাংস, কলিজা, পালং শাক, কাঁচা কলা, ডিম, ডাল, চিনাবাদাম। শরীরে অক্সিজেন পরিবহন বাড়ায় আয়রন এবং ক্লান্তিভাব দূর করে।

পেশি ও কোষ গঠনে সহায়ক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার : ডিম, দুধ, মুরগি, মাছ, ডাল, ছোলা ও সয়া প্রোটিন। এটি শরীরের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

হাড় ও দাঁত মজবুত করতে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডিদুধ, দই, ছানা, কাঁটাসহ ছোট মাছ, শাক-সবজিপালং ও কলমি শাক। এতে হাড়ের ঘনত্ব বাড়বে, হয়ে উঠবে ফ্র্যাকচার প্রতিরোধী।

ত্বক, চোখ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য ভিটামিন এ, বি, ও সি : গাজর, পেঁপে, কুমড়া, আম, লেবু, টমেটো ও সবুজ শাক-সবজি।

উজ্জ্বল ত্বক ও ভালো দৃষ্টিশক্তি নিশ্চিত হবে এতে।

মস্তিষ্কের বিকাশ ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক স্বাস্থ্যকর চর্বি : বাদাম, অলিভ অয়েল, তিল, চিয়া সিড ও মাছের তেল। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং মনোযোগ বাড়ায়।

হজম ও পরিপাকতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার : লাল চাল, ওটস, ডাল, শাক-সবজি ও ফলমূল। এসব খাবারে হজম উন্নত হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের আশঙ্কা কমে।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের টিপস

সুষম খাবার, সজীব শরীর : প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ভালো কার্বোহাইড্রেটসহ খাবার খান। পুষ্টিকর খাবার আপনার শরীরকে শক্তিশালী করবে।

পানি, প্রাণের উৎস : প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। আপনার ত্বক ও শরীর থাকবে সতেজ ও চনমনে।

ফাস্ট ফুড নয়, স্বাস্থ্যকর নাশতা : চিপস বা কুকির পরিবর্তে বাদাম, ফল বা সিদ্ধ ডিম খান। আপনার স্বাস্থ্য থাকবে সুরক্ষিত।

ফাইবারে ভরপুর খাবার : শাক-সবজি, ফল, মটরশুঁটিএগুলো আপনার পেট ও হজম থাকবে একেবারে ঠিকঠাক!

নিয়মিত খাবার খাও, শক্তি বাড়াও : তিন বেলা খাবার খেয়ে শক্তি পান। একেবারে ঝামেলামুক্ত দিন কাটান।

আয়রন ও ক্যালসিয়াম নিন, শক্তির

জন্য : আয়রন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমনপালং শাক, দুধ ও মাংস খান। আপনার শরীর হবে আরো শক্তিশালী।

শরীরচর্চা খুবই জরুরি : প্রতিদিন একটু হাঁটুন বা কিছু ব্যায়াম করুন। শরীরের শক্তি ও স্বাস্থ্য বজায় থাকবে।

পর্যাপ্ত ঘুম, ভালো কাটবে দিন : প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা ভালো ঘুম নিন। মস্তিষ্ক থাকবে সতেজ এবং মন থাকবে শান্ত।

মন ভালো রাখুন : নিজের শখ ও পছন্দের কাজগুলোতে সময় কাটান। অতিরিক্ত মানসিক চাপ নেওয়া কমিয়ে দিন।

 

লেখক : রিসার্চ অফিসার ও পুষ্টিবিদ

আইসিডিডিআর,বি

 

মন্তব্য
অটিজম

সঠিক ব্যবস্থাপনায় স্বাভাবিক জীবন

    ২ এপ্রিল পালিত হয়েছে ১৮তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এ রোগে শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এটি নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে এ রোগের উপসর্গ অনেকাংশে কমানো যায়। অটিজমের লক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত জানাচ্ছেন অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু
শেয়ার
সঠিক ব্যবস্থাপনায় স্বাভাবিক জীবন
অটিজম চিকিৎসায় আছে বিশেষ স্কুল। ছবি: সিআরপি বাংলাদেশ

অটিস্টিক শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষায় বিশেষ চাহিদাকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা  করা অপরিহার্য

 

অটিজম কী?

শিশুদের একটি স্নায়ুবিকাশ জনিত সমস্যা অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিস-অর্ডার। এর ফলে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ ও কার্যকলাপ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অটিজমের ৮০-৯০ শতাংশ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই।

শিশুর সামাজিক যোগাযোগ ও পরিবেশের দিকে অনাগ্রহ থাকে, জড় জগৎ ও বস্তুর প্রতি থাকে অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা। পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেখা যায় পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ, যেমনতারা পারিপর্শ্বিকতায় পরিবর্তনকে মেনে নিতে চায় না। একক কোনো বিষয়ের প্রতি তৈরি হয় মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ। এর ফলে শিশুর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা হয়।
আশপাশের পরিবেশ এবং ব্যক্তির সঙ্গে মৌখিক ও ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে না। দেখা দেয় আচার-আচরণের সমস্যা।

রোগের প্রকোপের ওপর ভিত্তি করে অটিজমকে যেভাবে তিনটি ভাগ করা যায়

  অটিস্টিক ডিস-অর্ডার

এসপারজার্স ডিস-অর্ডার

  পারভাসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিজ-অর্ডার নট আদারওয়াইজ স্পেসিফায়েড।

 

অটিজমের ইতিহাস

লিওক্যানার সর্বপ্রথম ১৯৪৩ সালে অটিজমের লক্ষণের বর্ণনা দেন।

এই বিশেষ শিশুদের মধ্যে অন্য শিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অসমর্থ্যতা পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। ক্যানার আরো লক্ষ করেন যে, এদের মধ্যে রয়েছে পরিবেশের প্রতি অস্বাভাবিক ধরনের সাড়া প্রদান করার প্রবণতা, একই ধরনের আচরণের পুনরাবৃত্তি, কোনো বস্তুর প্রতি অস্বাভাবিক ভালো লাগা এবং রুটিন মেনে চলার প্রবণতা। এই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করতে চাইলে এই শিশুরা অস্বাভাবিক আচরণ করে। তিনি আরো অভিমত প্রকাশ করেন যে এই শিশুরা গুছিয়ে কাজ করায় পারদর্শী নয় এবং কখনো কখনো কিছু কাজের ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে।

এরপর ১৯৪৪ সালে হানস অ্যাসপার্জার এটিকে অটিস্টিক সাইকোপ্যাথি বলে সম্মোধন করেন।

তিনি বলেন, এই শিশুদের আচরণের অস্বাভাবিকতা এবং সামাজিক মেলামেশায় অক্ষমতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

কাদের হয়?

ধর্ম-বর্ণ-আর্থ-সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে যেকোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় চার গুণ বেশি।

 

লক্ষণ

১৮ থেকে ৩৮ মাস বয়সের মধ্যেই অটিজমের লক্ষণগুলো শিশুদের মধ্যে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে আছে

►  দুই বছর বয়সের মধ্যে অর্থপূর্ণ কথা বলতে না পারা।

►  শিশু চোখে চোখ রাখে না।

►  নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না।

►  অন্যের সঙ্গে মিশতে, আদর নিতে বা দিতে সমস্যা হয়।

►  পরিবেশ অনুযায়ী মুখ ভঙ্গি পরিবর্তন না করা।

►  অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে মুখে মুখে কথা বলা এবং ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে না।

 

এর পাশাপাশি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে কখনো কখনো কিছু আনুষঙ্গিক অসুবিধা থাকতে পারে। যেমন—

►  খিঁচুনি

►  অতিমাত্রায় চঞ্চলতা

►  ঘুমের সমস্যা

►  খাদ্য হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য

►  বুদ্ধি বা জ্ঞানের স্বল্পতা

►  দাঁত কিরমিরি দেওয়া ইত্যাদি।

 

অটিজম নিরূপণের জন্য চিহ্ন

শিশুর আচরণে যদি নিচের তালিকার একাধিক উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই অটিজম বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

►  ছয় মাস বয়সের মধ্যে শিশু যদি পরিপূর্ণ হাসি না হাসে।

►  ৯ মাস বয়সের মধ্যে হাসির উত্তরে হাসি বা ভাব প্রকাশ না করে।

►  ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল না বলা, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা না করে।

►  ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বলতে না পারে।

►  ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারে।

►  ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যায়।

►  বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করতে না পারে।

 

সম্ভাব্য কারণ

অটিজম কেন হয় সে বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা সুস্পষ্টভাবে অবগত নন। সারা বিশ্বেই এর মূল কারণ জানার জন্য গবেষণা অব্যাহত রয়েছে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কিছু বিষয়ের সমন্বয়ে শিশুদের অটিজম হতে পারে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। এর মধ্যে জিনগত কারণ সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও কিছু পরিবেশগত কারণও আছে। ধারণা করা হয়, অটিজমের জন্য দায়ী ১০০টিরও বেশি জেনেটিক ত্রুটি। 

পরিবেশগত কারণ বিদ্যমান থাকলে রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। যেমনপ্রতিনিয়ত রং ও সংরক্ষণের কেমিক্যালযুক্ত ফাস্ট ফুড খেলে, কিছু ওষুধের প্রভাবে বা ভারী ধাতুর সংস্পর্শেও অটিজমের প্রকোপ বাড়তে পারে। কারণ এসব শরীরে প্রবেশ করে কিছু জিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কথা বলতে শেখার সময় একাধিক ভাষার সম্মুখীন হলে, শিশুর বিকাশের উপযুক্ত সময়ে স্মার্টফোন বা ট্যাব নিয়ে খেলা করলে বা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য উপযুক্ত উদ্দীপনা না পেলেও অটিজমের লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে।

 

পরিসংখ্যান

অটিজম নিয়ে বাংলাদেশে তেমন পরিসংখ্যান নেই। তবে এ নিয়ে কর্মরত চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, দেশে অটিজম রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চালানো ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় শতকরা তিনজন শিশু অটিস্টিক। সেই তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই সংখ্যাাটি কম, ৭০০ জনে একজন। গবেষণাটি পরিচালনা করেন প্রখ্যাত শিশু নিউরোলজিস্ট ও বর্তমানে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন সদস্য অধ্যাপক ডা. নায়লা জামান খান। এক থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

সারা দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিস-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) পরিচালনা করে এক গবেষণা। এতে জানা যায়, শহরের ছেলে শিশুরা অটিজমে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং ৩০ মাসের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজমের হার মাত্র এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৭ জন।

অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে আরো কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় বেশি। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে তারা। কিছু জেনেটিক সিনড্রোম, যেমনডাউন সিনড্রোমের সঙ্গেও অটিজমের প্রকোপ বাড়ে। এ ছাড়াও স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে অটিজমের তীব্রতাএমনও বলছে কোনো কোনো গবেষণার ফলাফল।

 

অটিজম নিয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অটিজম নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে যেমন বেড়েছে অটিজম নিয়ে কাজে আগ্রহীর সংখ্যা, তেমনি হয়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ও অন্যদের প্রশিক্ষণের ফলে এই শিশুরা আর প্রয়োজনীয় সেবা ও রোগের সঠিক নির্ণয় সেবার বাইরে থাকছে না। এ বিষয়ে কাজের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে নিউরোডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট ও অটিজম এবং এনডিডি সমস্যা বিষয়ক সেল। এর ফলে ইপনা (বিএমইউ) এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও কাজ করছে বেশ কিছু সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। 

 

ব্যবস্থাপনা

অটিজমকে নির্মূল করার ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে এর মাত্রা তথা মূল লক্ষণ কমিয়ে আনা ও এ শিশুদের জীবনযাপনের মান উন্নত করতে পারে এমন বেশ কিছু ওষুধ আছে। এই রোগের সঙ্গে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, যেমন এডিএইচডি, লার্নিং ডিস-অ্যাবিলিটি, খিঁচুনির সমস্যা, হজমের সমস্যা, যা অটিজমের মাত্রাকে আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। এসব রোগের চিকিৎসার মাধ্যমে অটিজমেরও প্রকোপ অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। তাই এর চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত দলের প্রয়োজন। অটিজম ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে

►  ব্যাবহারিক শিক্ষা।

►  স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি।

►  পড়ালেখার জন্য বিশেষ স্কুল।

 

অটিজম ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে—

►  ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিস-অর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

►  ঢাকা শিশু হাসপাতাল, ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’, ঢাকা।

►  জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলানগর, ঢাকা।

►  জাতীয় নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট।

►  প্রয়াস, বিশেষায়িত স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট

  মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-এর শিশু বিকাশ কেন্দ্র। 

►  সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল।

►  জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।

 

অটিস্টিক শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষায় বিশেষ চাহিদাকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা অপরিহার্য।

 

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান

শিশু নিউরোলজি বিভাগ

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

 

 

মন্তব্য

যেভাবে বুঝবেন দেখা দিয়েছে পানিশূন্যতা

শেয়ার

সর্বশেষ সংবাদ