মুক্ত নাটকের সন্ধানে

  • মামুনুর রশীদ
শেয়ার
মুক্ত নাটকের সন্ধানে
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে পথনাটক ‘রক্তে লেখা বাংলা ভাষা’। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের কোনো গ্রামের নাম কি নীলাঞ্জন হতে পারে? পারে। যেমন—সোনারং, বজ্রযোগিনী, রতনগঞ্জ, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, পলাশতলী। অবশ্য আরো অনেক সুন্দর সুন্দর নাম আছে, তবে নীলাঞ্জনের মতো মিষ্টি নাম আর শুনিনি। অবশ্য পরে জেনেছি, এই গ্রামের নাম আসলে করাতকান্দি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত কিছু তরুণ নিজেদের মতো করে নাম রেখেছে নীলাঞ্জন। এই নামে গ্রামের সাধারণ মানুষ অবশ্য কেউ ডাকে না, করাতকান্দিই বলে। ওই অঞ্চলের নামগুলোর মধ্যে একটা অন্য ধরনের ব্যঞ্জনা আছে; যেমন—ভাঙ্গুড়া, হাণ্ডিয়াল বাজার বা মিসমেথইর। আশির দশকে আমরা নাটককে মধ্যবিত্তের কাছ থেকে মুক্ত করে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
সেই থেকে নানা আয়োজন। একটা বড় আয়োজন হয়েছিল নীলাঞ্জনকে ঘিরে। এলাকাটি নানা ধরনের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। পালাগান, যাত্রাগান, তারপর জারি, সারি ভাটিয়ালি—এসব গাওয়ারও লোক ছিল প্রচুর।
সারা দিন কৃষিকাজ করে সন্ধ্যার পর তারা শিল্পের এসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতো। একটা অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ। সেই আসরে বোঝাই যেত না কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে উচ্চবর্ণের হিন্দু কিংবা নিম্নবর্ণের। অথবা কোনো মুসলমান কেমন, তার আভিজাত্য কতটুকু—এসব চেনা যেত না। আমরা তখন মুক্ত নাটকের দল বলে চিহ্নিত করতাম।
রাজশাহী মুক্ত নাটকের দলের কিছু সদস্য রাজশাহী থেকেই এই নাট্যমাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছুটির সময় গ্রামে এসে নানা ধরনের শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতো। মুক্ত নাটকের কাজ শুরু হওয়ার পর তারা এই মাধ্যমটি বেছে নেয়। নীলাঞ্জনকে কেন্দ্র করে চারদিকে দল গড়ে উঠেছে; যেমন—চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া—এ রকম আরো কয়েকটি গ্রামে। শীত-গ্রীষ্মে সব সময়ই ওই গ্রামে আমরা যাতায়াত করেছি। তখন ভাঙ্গুড়া পর্যন্ত বাস, ট্রেন চলত। এর পরে হাঁটা পথ, হাণ্ডিয়াল বাজার। হাণ্ডিয়াল বাজার থেকে নীলাঞ্জন যাওয়ার হাঁটা ছাড়া আর কোনো পথই নেই। একটি ভ্রমণের কাহিনি বলি—তখন বর্ষাকাল। ঢাকা থেকে রওনা হলাম দুপুরের পর পর। আরিচা ঘাটে এসে কোনোমতে ফেরিটা ধরলাম। ফেরি পার হয়ে ওপারে আষাঢ়ের ঝমঝম বৃষ্টি। যানবাহনের সংখ্যা খুব কম। একটা গাড়িতে উঠে, সম্ভবত একটা মিনিবাসে করে ভাঙ্গুড়া এসে নামলাম। বৃষ্টি ও বাতাসের তোড় তখনো কমেনি, ভাঙ্গুড়া নেমেই একটা ভ্যানগাড়ি খুঁজছিলাম, সেটাও নেই, অতঃপর আমার সঙ্গী তপন দাস হেঁটে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করল। কারণ তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, রাত প্রায় আটটা। ওখান থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার হাঁটা পথ। বৃষ্টি তখন একটু কমেছে, দ্রুত পায়ে হেঁটে হাণ্ডিয়াল বাজারে এলাম।

রাত তখন নয়টা, বাজার সুনসান, চায়ের দোকান খুঁজলাম। জানা গেল, হাটের সময় ছাড়া এখানে চা পাওয়া যায় না। অতএব, কালক্ষেপণ না করে হাঁটলাম। আমাদের হাতে টর্চ নেই আন্দাজ করে করে পথ চলা। তপন জানাল, আমাদের এখন গন্তব্য হবে একটি বটগাছ। হাঁটতে হাঁটতে পথ ফুরায় না, বটগাছও দেখা যায় না। আমরা আমাদের যাত্রাটা একটু হালকা করার জন্য ভূত খুঁজতে শুরু করলাম। একে তো বৃষ্টি, তার ওপর অমাবস্যার রাত। ভূতরা কোনো না কোনো দিক থেকে আমাদের দিকে চলে আসতে পারে। যেহেতু মানুষের গন্ধ ওরা চিনতে পারে। হাউ মাউ কাউ, মানুষের গন্ধ পাও। দুই দিকে পাটক্ষেত। ওই অঞ্চলের পাটক্ষেত তখনো অনেক বড় হয়ে ওঠেনি। ভূতের ভয় তখন আমাদের পেয়ে বসেছিল কি না জানি না। সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে কখনো বসে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবিনি। এবার নদীর পাশে এসে দাঁড়ালাম। তপন দাস অনেকটা আশ্বস্ত হলো। এবার আমাকে বলল, নদীর পার দিয়ে হাঁটতে হবে। আমরা খুঁজতে লাগলাম নদীতে কোনো নৌকা পাওয়া যায় কি না। একটি নৌকাও দেখা যাচ্ছে না। নদীটা পার হতে হবে, বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। মাঝে মাঝে নদীর পারের পথটা এত পিচ্ছিল যে পাশের ঘাসের ওপর দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করি। বৃষ্টি তখনো কমেনি। তবে মাঝে মাঝে একটা পাগলা বাতাস আশপাশের ঝোপঝাড়ে দোলা দিয়ে যায়। সামনে মনে হচ্ছে পাহাড়ের মতো কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের অনুমান সত্য হলো, ওই পাহাড়টাই আসলে আমাদের বটগাছ। সেই অন্ধকারের মধ্যেও অনেক রঙের কাপড় ঝুলতে দেখলাম। কাপড় ঠিক নয়, কাপড়ের টুকরা। তপন জানাল, এই গাছে কেউ কোনো কিছু মানত করলে একটা কাপড় গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে রাখে। কারো কারো মনোবাসনা নাকি তাতে পূর্ণ হয়। এবার যাত্রা আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। কারণ নদী পার হতে হবে, একটা নৌকা চাই। সেই সঙ্গে বটগাছটার নিচে একটা শিকড়ের ওপর বসার সুযোগ পাওয়া গেল। হঠাৎ করে নদীর ওপারে কিছু কণ্ঠস্বর আমাদের আশ্বস্ত করল। হয়তো তার আশপাশে কোনো নৌকা রেখে দিয়েছে। হাত দুটি মুঠো করে কণ্ঠ যত দূর যায় চিৎকার করে তপন মানুষগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। মানুষগুলো কোনো জবাব দিল না, উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল। এবার আমাদের সিদ্ধান্তের পালা, আমরা কী করব। আমার কাছে ছিল একটা চামড়ার ব্যাগ, তপনের কাছেও একটা ব্যাগ। তপন বলে ফেলল, নদীতে পানি তেমন একটা নাই, আর থাকলে একটুখানি হয়তো, আমাদের সাঁতরাতে হবে। আমি এককথায় বললাম—চলো। এরপর ধীরে ধীরে আমরা নদীতে নামলাম। কোমরপানি থেকে বুকপানি, বুকপানি থেকে গলা এবং তারপর সাঁতার। সাঁতরে কিছুদূর যাওয়ার পরই পায়ের কাছে মাটি অনুভব করলাম। কাদামাটি পেরিয়ে ওপারে উঠতেই দেখলাম দূরে লণ্ঠনের আলো। তপন আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ওই তো নীলাঞ্জন। আমরা যেন বহু বছর ধরে ওই নীলাঞ্জনের অপেক্ষায় ছিলাম। তার পরের পথ অত দীর্ঘ নয়, গন্তব্যে পৌঁছার আনন্দে পথটা ছোট হতে থাকল। একসময় পৌঁছে গেলাম তপন দাসের বাড়ি। সেখানে অপেক্ষা করছে অনেকে। ঘড়িতে সময় দেখলাম রাত দশটা। কিন্তু গ্রাম নিঝুম, কোনো বাড়িতে আলো জ্বলছে না। এতক্ষণে অনুভব করলাম, আমরা খুবই ক্ষুধার্ত। ভেজা কাপড়গুলো ছেড়ে টিউবওয়েলের জলে স্নান করে শুকনা কাপড় পরার পর ক্ষুধাটা আরো তীব্র হলো। এরই মধ্যে মাদুর পেতে দিয়েছেন তপন দাসের মা। গরম ভাতের সঙ্গে মাছের তরকারি এবং নানা ধরনের সবজি ও ডাল দিয়ে প্রাণপণে খেয়ে চলেছি। একটা পর্যায়ে লক্ষ করলাম, মলয়, স্বদেশ এবং আরো অনেকেই যেন আমার খাওয়ার দৃশ্য দেখছে এবং উপভোগও করছে। খাওয়ার পর শরীর আরো ক্লান্ত হয়ে পড়ল, ঘুমিয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম, পরদিন সকালেই পাখির ডাকে ঘুম ভাঙবে। কিন্তু ঘুম ভাঙল আমাদের প্রিয় কর্মী মিলন দাসের চিৎকারে। খালি গলায় সে চিৎকার করে ফিরছে, টিউবওয়েলের ওয়াশার চুরি হয়ে গেছে। পাড়ার বাসিন্দারা সবাই কলের পাড়ে আসো। বেশ অনেকবার এই চিৎকার করার পর টিউবওয়েলের পাড়ে পাড়ার অধিবাসীরা একত্রিত হলো। আমিও দূর থেকে দেখলাম অনেক মানুষের ভিড়, সবাই অভ্যাসবশত খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য কলের পাড়ে এসে জড়ো হয়েছে।

পুরো পাড়ার খাওয়ার পানির একমাত্র উপায় এই টিউবওয়েল। উপস্থিত পাড়াবাসীর মধ্যে নারী-পুরুষ সবার কণ্ঠে প্রতিবাদ, চোরকে অভিসম্পাত, নানাজনকে সন্দেহ—এসব চলছে। মিলন দাস এর মধ্যে লুঙ্গি পরে একটা ভালো জামা গায়ে জড়িয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো, তার সঙ্গে একটা সাইকেল। পাড়াবাসীদের আশস্ত করে সে সাইকেল নিয়ে ছুটল হাণ্ডিয়াল বাজারে টিউবওয়েলের মিস্ত্রি এবং একটি নতুন ওয়াশার কেনার জন্য। ওয়াশার কেনা এবং মিস্ত্রি বাবদ যে খরচটা পড়বে তারও একটা আনুমানিক হিসাব সে দিয়ে দিল। সবাই সমস্বরে বলল, কোনো অসুবিধা নাই, তুমি মিস্ত্রি নিয়ে আসো, আমরা সবাই মিলে টাকা দিয়ে দেব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাজারের দোকানগুলো দশটার আগে খোলে না। তখন একজন বলে উঠল, মিস্ত্রির বাড়িতে গিয়ে তাকে আনতে হবে। কেউ কেউ ওই মিস্ত্রিকে চেনেও। তারা বলল, ও িমিস্ত্রি সেই দোকানের মালিক নয়। প্রতিদিন দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে দোকানে আসে না। বাইরে তার সব কাজকর্ম সেরে তারপর দোকানে আসে। মিস্ত্রির নাম কেউ কেউ জানে। একজন বলে উঠল, আমি ওর বাড়ি চিনি। একবার শ্যালোর কাজে ওকে নিয়ে এসেছিলাম। মিলনের সাইকেলটি খুব ছোট, দুজন চড়া খুব মুশকিল। তখন বয়স্ক একজন মানুষ তাঁর বড় ছেলেকে হুকুম করলেন—এই রওশন, তুই যা, মিলনরে পেছনে উঠাইয়া নে। এবার মিলন জবাব দিল—রওশন যখন চেনে, তাইলে ওই যাইক। সকালবেলা সবাই পিপাসার্ত। আশপাশের কুয়ার পানি এখন আর কেউ খায় না।

বছর তিনেক আগে গ্রামে কলেরা হয়েছিল, সেই সময় থেকে একটু দূরে হলেও সবাই টিউবওয়েলের পানি এনে খায়। উপস্থিত জনতা এবার একসঙ্গে বলে উঠল—না মিলন, তোমারই যাইতে হইব। মিলন এবার নিজের সাইকেলটা তার ভাগ্নেকে বুঝিয়ে দিয়ে রওশনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। উপস্থিত জনতার কেউ কেউ বাড়ি চলে গেল আর কিছু লোক কলের পাড়েই বসে রইল। তবে যারা কলস নিয়ে এসেছিল, সেগুলো লাইন করিয়ে সিরিয়ালে বসিয়ে দিল। আমি আশঙ্কা করলাম, আমাদেরও বোধ হয় সকালের খাওয়া বিলম্বেই হবে। কিন্তু তপনদের বাড়ি থেকে জানাল, ওরা গত রাতেই জলের ব্যবস্থা করে রেখেছে। যা হোক, এবার আমাদের গ্রাম ঘোরার পালা। আমাদের মুক্ত নাটকের দল নিয়ে। গ্রাম ঘুরতে বের হয়েছি, পুরো গ্রাম পার হয়ে মিসমেথিউর পর্যন্ত এসেছি, এর মধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও কবি স্বদেশ বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। স্বদেশ বন্ধু খুবই চৌকস কবি। কথা বলেন কবিতার ভাষায়, ছন্দে নয়। তাঁর বাংলা কবিতা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। তপন দাস সঙ্গেই আছে, মলয়ও গ্রাম সম্পর্কে কিছু আগাম ধারণা দিচ্ছে। এর মধ্যে কাদেরের বাড়িতেও গেলাম। একটা চায়ের দোকান খুঁজছিলাম, সেটি বাজারে। বাজারে গিয়ে চা খেলাম। এরই মধ্যে মিলন দাস টিউবওয়েলের মিস্ত্রিকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। শত শত উত্সুক মানুষের চোখের সামনে টিউবওয়েলে ওয়াশার লাগানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে নানা রকম নাট-বল্টু লাগানোর পর পানি উঠতে শুরু হলো। জনতার উল্লাসের মধ্য দিয়ে পানি উত্তোলন উৎসব পালিত হলো এবং কেউ কেউ বিষয়টিকে শত্রুতামূলক হিসেবেই সিদ্ধান্ত দিল।

আবার কেউ কেউ গত নির্বাচনের ঝামেলা থেকেই একটা রাজনীতি চলছে, তারই ফলাফল বলে বিবেচনা করছে। যা হোক, আমরাও ঘটনাস্থলে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর মিলন দাসকে ডেকে একটি উঠানে বসে কর্মপরিকল্পনা শুরু করলাম। মিলন দাস এলাকায় খুবই সত্যবাদী ব্যক্তি এবং সেই সঙ্গে খুব যুক্তিবাদীও বটে। তর্কে সে অসামান্য। তার সঙ্গে তর্ক করতে করতে কখনো কখনো গভীর রাত হয়ে যেত। সে একেবারেই ছাড়ার পাত্র নয়। যা হোক, আমরা প্রথম অধিবেশনটি করব সন্ধ্যার পরে, কারণ কৃষকরা মাঠের কাজ শেষ না করে আসবে না। আবার কেউ কেউ আসবে রাতের খাবার খেয়ে। আমাদের মুক্ত নাটকের একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল, গ্রামে গ্রামে গিয়ে একেবারে কৃষকদের কাছ থেকে তাদের জীবনের কাহিনি শোনা এবং সেই কাহিনিকে একটা শৈল্পিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। অবশ্য তার মধ্য দিয়ে একটা শ্রেণিসংগ্রামের চিত্রই ভেসে উঠত।

প্রথম দু-তিন দিন আমরা শুনতাম এবং এই শোনার মধ্য থেকেই বেশ কিছু অভিনেতা, গায়ক, তাদের সঙ্গে পরিচিত হতাম। একেবারেই জীবনে অভিনয় করেনি এমন উৎসাহিতও পাওয়া যেত। তাদের নিয়ে কাজ করতে সুবিধা হতো। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হতো আমাদের পরিচয়। আমরা কারা? এই অঞ্চলে অবশ্য এই অসুবিধাটা কম হয়েছে। কারণ এলাকার ছাত্ররা আগে থেকেই আমাদের সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছে এবং আমাদের যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, এ বিষয়টা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। তবু কৃষকরা সত্য কথা বলতে গিয়ে নানা রকম বিপদে পড়েছে। তাই সব কথা প্রথম দু-তিন দিন অকপটে বলতেন না। কিন্তু পরে এক ধরনের আপনজন হয়ে যেতাম আমরা। একটা ঠাট্টা-মসকরার সম্পর্ক গড়ে উঠত তাদের সঙ্গে। তারপর সবাইকে নিয়ে গল্প তৈরির চেষ্টা করতাম। এখানেই চরিত্রগুলো আসত। চরিত্রগুলো যথাসম্ভব নিজেরাই বাছাই করে নিতেন এবং পরে দৃশ্য বিভাজন করা হতো। সবটাই হতো কাগজ-কলম ছাড়া, একেবারে তাৎক্ষণিক অভিনয়ের মাধ্যমে। এমনি করে কখনো গভীর রাত পর্যন্ত মহলা চলত। কখনো দেখা যেত, প্রথম দিন মহলার পর পরদিন বেশ কয়েকজন আসেনি। গ্রামের জোতদার, প্রভাবশালী মহল—এরা জেনে যেত এবং নানা রকম ভয় দেখানোর চেষ্টা করত। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যেত, যারা অংশ নিচ্ছে তাদের বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে। তাদের সাহসী করে তোলা ছিল আমাদের কাজ। এখানে মূল কাজটা করত এলাকার মুক্ত নাটক দলের কর্মীরা। দু-একজন স্কুল শিক্ষক, যেমন—অশোক সরকার ছিলেন আমাদের মধ্যে, কাদেরও এসব ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। মিলন সরকার যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে কাজটি কেন করা উচিত তার ওপর কথা বলতেন। তপন দাস, স্বদেশ বন্ধু—এরা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র। তাদের এমনিতেই আদর্শবাদী হিসেবে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল গ্রামে।

এমনি করে দিন পাঁচেক যাওয়ার পর একটা নাটকের সম্ভাবনা দেখা দিত, আর সেই সঙ্গে অভিনয়ের স্থান, প্রচারকাজ, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোশাক-আশাক, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি—এগুলো সংগ্রহ শুরু হয়ে যেত। অতঃপর যথাস্থানে দিনের বেলা অথবা রাতে অভিনয়টি সম্পন্ন হতো। মাইকের ব্যবস্থা না থাকলেও যেহেতু দর্শকদের মনোযোগ ছিল এবং জায়গাটিতে অভিনয়ের সময় নীরবতা নেমে আসত, তাই দর্শকদের শুনতে অসুবিধা হতো না। নাটকের পর শুরু হতো নাটক নিয়ে আলোচনা। অনেকের কাছেই ঘটনাটি চেনা। নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়েই নাটকসংক্রান্ত কাজটি ওই মুহূর্তে শেষ হলো। কিন্তু বাড়ি ফেরা মানুষের মুখে ওই আলোচনা শোনা যেত। এবং বেশ রাতের বেলা আমরা যখন আমাদের থাকার জায়গায় ফিরছি, তখনো বিভিন্ন বাড়ির বাইরে অথবা বারান্দায় বসে নাটক সম্পর্কিত আলোচনাগুলো কানে আসত। এই আলোচনা চলত বেশ কিছুদিন ধরে। কিন্তু আমাদের চলে যেতে হতো অন্য জায়গায়। তখন বর্ষাকাল। ঢাকা ও রাজশাহী থেকে আগত মুক্ত নাটক দলের সদস্যরা ভাগ হয়ে গেলাম। মলয় ভৌমিকসহ কয়েকজন চলে গেলেন চাটমোহরে। পাবনা জেলার একটি থানা শহর। আমরা আশপাশের কয়েকটি গ্রাম, যেমন—প্রতাপ, বাগলবাড়ি, রহিমপুর—এসব এলাকায় নতুন দল গড়ে তোলার কাজ শুরু করলাম। রহিমপুরে শেষ পর্যন্ত দল গঠন সম্ভব হলো না, ওরা এসে যোগ দিল মিসমেথইর গ্রামে। একদিন যখন দল গড়ে উঠছিল, কাহিনি তৈরি হয়ে গেছে, চরিত্র বণ্টন হয়ে গেছে, তখন আবার আমরা দু-তিনজন চলে এলাম চাটমোহরে। চাটমোহর একটি বেশ বড় গ্রাম, থানা আছে, হাই স্কুল আছে এবং আছে বিরাট বাজার। এখানেই সারা উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত পদাবলি কীর্তনের প্রধান কীর্তনিয়া দয়াল বাবাজির বাড়ি। তাঁর ছেলেই বর্তমানে জনপ্রিয় টেলিভিশন নাট্যকার বৃন্দাবন দাস। বৃন্দাবন দাস তখন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। সেই বাড়িতেই আমাদের আশ্রয় হলো।

মুক্ত নাটকের ওখানকার সংগঠক হলেন আসাদুজ্জামান দুলাল। এখানে অংশগ্রহণকারীদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না, বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে আমরা বেশ কিছু উদ্যমী তরুণকে পেয়েছিলাম। এমনকি এখানে একটা বেশ স্থায়ী মুক্ত নাটকের দল গড়ে উঠল, যার অবশেষ এখন পর্যন্ত আছে। এ তো গেল একটি এলাকার ছোট্ট একটি ভ্রমণকাহিনি। বাংলাদেশের শত শত গ্রামে আমরা গেছি, সেগুলো লিখতে গেলে বিশাল একটা আখ্যান হয়ে যাবে। আরেকটি এলাকায় আমাদের ব্যাপক কাজ হয়েছিল। সেটি হয়েছিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। উল্লাপাড়ার কানসোনা গ্রামের অনেক পরিবার যুক্ত হয়েছিল মুক্ত নাটকের কাজে। সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন তার ‘কানসোনার মুখ’ বইয়ে মোটামুটি বিস্তারিত লিখেছিলেন। কিভাবে একটি গ্রামের প্রতিটি মানুষ মুক্ত নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এগুলো আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। অনেক এলাকায় আমরা মুক্ত নাটক করতে গিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে মঞ্চায়ন করতে পেরেছিলাম, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ সময় কত যে স্থানীয় শিল্প আঙ্গিক দেখেছি, কী অসাধারণ তাদের সৃজনভঙ্গি, নতুন নতুন ঢং। এসব দেখে অবাকও হয়েছি। সেসবও মুক্ত নাটকে আমরা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনো রাজনৈতিক দল বা দলের নেতাকে আমাদের পাশে পাইনি, এমনকি প্রগতিশীল দলগুলোও আমাদের সঙ্গে আসেনি। কিন্তু দেশের এনজিওগুলো একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই মাধ্যমটি ব্যবহার করার জন্য এবং তারা এই দলগুলোর সংগঠকদের কাউকে কাউকে বিপুল অর্থের বেতন দিয়ে পরবর্তীকালে নিজেরাও ধ্বংস হয়েছে, জনগণের একটি মাধ্যমকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। আজকে সারা বিশ্বেই জনগণের এই মাধ্যমগুলো ডিজিটাল মিডিয়ার কাছে নানাভাবে যুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারছে না।

বিশ্বব্যাপী বাজার অর্থনীতি, রাজনীতিতে গণবিরোধিতা যুগের নতুন করে এইসব মুক্ত নাটকের মতো মাধ্যমগুলোকে খুঁজতে হবে। মানুষের মুক্তির জন্য মুক্ত নাটকের মতো একটি আঙ্গিক আশির দশকে বিশ্বব্যাপী দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনও সেই সময় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাজনীতিতে মানুষের কল্যাণকামী কোনো চিন্তা-ভাবনা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজার অর্থনীতির জোয়ারে যেন সবকিছু ভাসিয়ে নিতে চাইছে। যে বিত্তহীন কর্মীরা বড় বড় আন্দোলনের সূচনা করেছিল বিংশ শতাব্দী জুড়ে, সেসবও আজকাল অনুপস্থিত। তবু মানুষের সংগ্রাম যেমন থেমে নেই, তেমনি থেমে নেই নতুন চিন্তা। মানুষের নতুন চিন্তাকে কেউ প্রতিহত করতে পারবে না। এই প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গে রুচির দুর্ভিক্ষের কালে আবারও উচ্চারণ করতে চাই—মানুষের শুভ চিন্তা, শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ