পাখি

নরওয়েজিয়ান উপকূলের পাখিরা এবং সি-ইগল সাফারি

  • সৌরভ মাহমুদ
শেয়ার
নরওয়েজিয়ান উপকূলের পাখিরা এবং সি-ইগল সাফারি
আকাশে উড়ছে তিনটি গাঙচিল

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ আমার চোখে নরওয়ে। সুইজারল্যান্ডের প্রায় পুরোটাই ভ্রমণ করেছি, কিন্তু সেই দেশে আল্পস পর্বতমালার ভাঁজে ভাঁজে মোহনীয় সৌন্দর্যের চেয়েও নরওয়ের পর্বতমালার সৌন্দর্য, অপার নৈসর্গিক উপকূল, আর্কটিক মহসাগরীয় আবহাওয়া, হাজারো ফিয়র্ড, বন-জঙ্গল, বুনো পাখি, বুনো ফুল আমাকে মুগ্ধ করে অবিরাম। নরওয়ের বার্গেন শহর থেকে জাহাজে করে পুরো উত্তর উপকূল হয়ে উত্তর-পূর্ব উপকূলের রাশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন শহর কিরকেনেস পর্যন্ত এক দুর্দান্ত অভিযানের সময় দেশটির বুনো সব প্রাকৃতিক ভূমি এবং নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী দেখেছি। পুরো অভিযানটি ছিল ১২ দিনের এবং পাড়ি দিয়েছি নরওয়েজিয়ান সাগর ও ব্যারেন্ট সাগরের ১০ হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ।

জাহাজ ভিড়েছে নরওয়ের উপকূলের ৩৪টি শহর ও বন্দরে যাওয়া-আসার পথে। নানা জাতের বন্যপ্রাণী ও বন্যপাখির সঙ্গে দেখা হয়েছে পৃথিবীর সর্ব উত্তরের শহর হামারফেস্ট, উপকূলীয় জাতীয় উদ্যানে, ইউরোপের সর্ব উত্তরের বিন্দু নর্থকেপ, সর্ব উত্তরের বন্দর মেহাম, নরওয়ের সর্ব উত্তরের নগর হনিংসভাগ, নরওয়ের পুরনো রাজধানী নগর ট্রোন্ডহাইম, অ্যালিসুন্ড, লফোটেন, আর্কটিক রাজধানী ট্রমসো, দ্বীপের শহর ক্রিস্টিয়ানসুন্ড, ট্রলফিয়র্ডে, কামচাটকা, কাঁকড়ার শহর কিরকেনসসহ নরওয়ের অসাধারণ বুনো প্রকৃতিতে। যদিও নরওয়ের উপকূলে পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হলো বসন্তের শেষ থেকে পুরো গ্রীষ্মকাল। আমার এই ভ্রমণটি ছিল শীতের শেষের দিকে।
সে কারণে অনেক প্রজাতির পাখি দেখা হয়নি। তবে বিশ্বের দীর্ঘতম উপকূলরেখায় যে পাখির সংখ্যা দেখেছি, সেটা নেহাত কম নয়। পুরো নরওয়েতে ৫৪৭ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। নরওয়ের উপকূলকে বলা হয় পাখি পর্যবেক্ষকের স্বর্গ।
পাহাড়ের ক্লিফ থেকে ফিয়র্ড, মুক্ত সমুদ্র পাখি দেখার জন্য দুর্দান্ত জায়গা।

হ্যাভয়সুন্ডের কাছে দ্বীপে গাঙচিল

হ্যাভয়সুন্ডের কাছে দ্বীপে গাঙচিল

দীর্ঘ নরওয়েজিয়ান উপকূল লাখ লাখ সামুদ্রিক পাখির আবাসস্থল, আউক ও কিটিওয়াকের সর্বাধিক ঘনত্ব দেশের উত্তর অর্ধে। দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে হেরিং গাল, গ্রেট ব্ল্যাক-ব্যাকড গাল, কমন গাল, আর্কটিক টার্ন ও কমন টার্নের মতো প্রজাতির ছোট উপনিবেশ রয়েছে। কিছু প্রত্যন্ত দ্বীপে শ্যাগ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে সাধারণত পাফিন, কমন গিলেমোট, রেজারবিল, ব্ল্যাক গিলেমোট, কিটিওয়াক ও ফুলমারও বংশবৃদ্ধি করে। কমন ইডার সমগ্র উপকূল বরাবর দেখেছি।

অ্যালেসুন্ডের কাছে রুন্ডেতে হাজার হাজার পাফিন আসে গ্রীষ্মে। দ্বীপটিতে একটি বৃহৎ কিটিওয়াকের উপনিবেশও রয়েছে এবং প্রচুরসংখ্যক কমন গিলেমোট, ব্ল্যাক গিলেমোট, রেজারবিল, শ্যাগ ও ফুলমার প্রজনন করে। তা ছাড়া গ্যানেট, গ্রেট স্কুয়া, লিচের পেট্রেল, স্টর্ম পেট্রেল রুন্ডের কাছাকাছি কিছু ছোট দ্বীপে বংশবৃদ্ধি করে। ফিনমার্কের উত্তর উপকূলে অসংখ্য পাখি উপনিবেশ করে। তাদের মধ্যে ব্রুনিচের গিলেমোট, আউক, চার প্রজাতির স্কুয়া, তিন প্রজাতির ইডার ও শিয়ারওয়াটার অন্যতম।

ভার্দো বন্দরে কিটিওয়াক পাখির কলোনির কাছে লেখক

ভার্দো বন্দরে কিটিওয়াক পাখির কলোনির কাছে লেখক

২৯ মার্চ ২০২৪। নরওয়ের বার্গেন বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে সন্ধ্যার পরে। পরের দিন সকালে নরওয়েজিয়ান সাগরে পাখির সঙ্গে দেখা হবে। তখন ভোরের আলো সুষমা ভালো করে ফোটেনি। জাহাজ মেলও শহরের বন্দরে নোঙর করা হয়েছে। বাইরের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি। ফ্রেশ হয়ে শীতের পোশাক জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি। সকাল ৬টার সময় সূর্যের সোনালি আভা আকাশে উঁকি দিয়ে সাগরের জলে তার রূপের আলো ভাসিয়ে দিল। ভোরের সোনালি আকাশে কয়েকটি গাঙচিল উড়ে গেল দূর দিগন্তের দিকে। ভোরের আলোয় পাহাড় ও সাগরের রূপ দেখতে দেখতে নরওয়ের একটি ছোট্ট বন্দর টোরভিকে পৌঁছলাম। টোরভিক হলো মোর ও রোমসডাল পৌরসভার লেইনোয়া দ্বীপের একটি ছোট ও সুন্দর গ্রাম। আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য টোরভিক এবং আশপাশের দ্বীপপুঞ্জ আকর্ষণীয়। এখানে অসংখ্য হিমবাহ ও জলপ্রপাত আছে। প্রতিবেশী দ্বীপ রুন্ডে পাখির জন্য বিখ্যাত। সেখানে ২৪০ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে। প্রতিবছর এখানে ৫০ হাজারের বেশি সামুদ্রিক পাখি বাসা বাঁধে! টোরভিক পোতাশ্রয়ে দেখা হলো শ্যাগ, হেরিং গাল, দুটি ধূসর রাজহাঁস, একটি ধূসর বক এবং দুটি বুনো কাকের সঙ্গে। গ্রীষ্মে এই পোতাশ্রয়ে হাজারো পাখির মেলা বসে। তবে শীতের সময় কম থাকে। সকাল ৯টার দিকে নরওয়ের অপূর্ব সুন্দর অ্যালেসুন্ড শহরের বন্দরে জাহাজ আসার পর শত শত গাঙচিল এবং শতাধিক কমন ইডার হাঁস চোখে পড়ল। এই প্রথম পুরুষ ইডারদের দেখলাম। তার রূপের ঝলক রাজকীয়। তারা দল বেঁধে নরওয়েজিয়ান সাগরে সাঁতার কাটছে।

জাহাজ থেকে নেমে অন্য একটি ছোট জাহাজে বিশ্ববিখ্যাত ইওরুন্ড ফিয়র্ড ঘুরে দেখার জন্য যাত্রা শুরু করার পর জীবনে প্রথম দেখলাম শত শত কালোপা কিটিওয়াক। এরা এক প্রজাতির গাঙচিল। একটি সরু চ্যানেলের পাশে থাকা ভবনে তারা বসে ডাকাডাকি করছে। আর কদিন পরই সামান্য এ জায়গাতে তারা বাসা বেঁধে ডিম দেবে। পাখিগুলো অনবরত ডাকছে এবং একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে। ফিয়র্ডের স্বচ্ছ জলের ধারাসহ বিচিত্র এক মায়াবী ও স্বপ্নময় প্রকৃতিতে আরো দেখলাম কালো মাথা গাঙচিল এবং কয়েক জোড়া হেরিং গাল। সবচেয়ে বেশি দেখেছি কিটিওয়াক, ইডার হাঁস এবং কিছু মারগেঞ্জার ও ধূসর রাজহাঁস। সারা দিন এসব পাখির পালকের রং, ওড়াউড়ি দেখে সন্ধ্যায় পৃথিবীর মায়াবী রূপের মাঝে জাহাজে ফিরলাম।

ট্রডেনহাইমের একটি পার্কে ইউরেশীয় ওয়েস্টারকার্টার

লফোটেন দ্বীপের ভলভেয়ারে এক জোড়া হেরিং গাল

মার্চ মাসের শেষ দিনের সকালটা মেঘলা। ছিট ছিট বৃষ্টির ফোঁটাও ঝরছে আকাশের মেঘমালা থেকে। আজ পাখিদের দেখা কম পাওয়া যাবে। পুরো দিনটিই এ রকম আবহাওয়া থাকবে। তার পরও ক্যামেরা ও দুরবিন নিয়ে জাহাজের ডেকে ছাউনি আছে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে পাখি দেখার জন্য বসে রইলাম। তখন সকাল ৬টা। জাহাজ চলছে নরওয়ের পুরনো রাজধানী এবং তৃতীয় বৃহত্তম নগর ট্রোন্ডহেইমে। পাখিদের দেখা নেই। কেবল মাঝে মাঝে সাগরে ভাসছে কিছু গাঙচিল ও ইডার। তবে দুপুরের দিকে এই প্রথম দেখলাম, তিনটি ছোট পাখি সাগরের জলে সাঁতার কাটছে। ভালো করে দেখার পর বুঝতে পারলাম, এরা তরুণ কমন মুরে। সাগরের পাখি। মুরে একটি বড় প্রজাতির আউক। উত্তর আটলান্টিক ও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, আর্কটিক ও বোরিয়াল জলে এরা বাস করে। খোলা সমুদ্রে তারা বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে। শুধু পাথুরে পাহাড়ের উপকূলে বা দ্বীপে বংশবৃদ্ধির জন্য ভূমিতে আসে।

ট্রোন্ডহেইমে আসার পরে বৃষ্টি আরো বাড়ল। এ পথে আরো কিছু গাঙচিল, চারটি শ্যাগ এবং একটি কাক দেখে সেদিনের পাখি দেখার পর্ব শেষ হলো। পরের দিন নেসনা থেকে স্টামসুন্ড পর্যন্ত সাগরপথে কয়েক প্রজাতির গাঙচিল, একটি শ্যাগ এবং কয়েকটি কাক ছাড়া অন্য কোন পাখির দেখা পায়নি। কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেছি।

এপ্রিলের ২ তারিখ সকাল হলো সরটল্যান্ডে আকাশে মেজেন্টা রঙের আলোর আভা নিয়ে। একটু পরে কড়া রোদ উঠেছে। সাগরের জল নীল হয়ে আছে। মনে হয়েছিল অনেক পাখির দেখা পাব। হারস্টাড বন্দর পেরিয়ে যখন ফিননেস বন্দরে এলাম, তখন সাগরের নীল জলে জলকেলি খেলছে একঝাঁক ইডার। এই দলে প্রায় ৩৫টি হাঁস। ইডার ছাড়া একজোগা গাঙচিল ও পানকৌড়ির সঙ্গে দেখা হলো সেদিন। সেদিন আর্কটিকের রাজধানী বলে খ্যাত ট্রমসো গিয়ে আবার শুনলাম শত শত কিটিওয়াক পাখির ডাকাডাকি। কয়েকটি ভবনের ছাদ দখল করে তারা ভালোবাসার কথা বলছে। বন্দরের সিঁড়ির পাশে দেয়ালে ছিল কয়েক প্রজাতির পাখি ও সামুদ্রিক প্রাণীর আঁকা ছবি। ছবিগুলো দৃষ্টিনন্দন।

বাইরে তুষারপাত হচ্ছে অবিরাম। জাহাজ তখন উত্তর নরওয়ের ব্যারেন্ট সাগরে। সাগরটি বরফময় এবং মাঝে মাঝে উত্তাল হয়ে থাকে। আমাদের জাহাজ খানিকটা দুলছে এই সাগরে চলার সময়। ৩ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে হোনিংসভাগ শহরে এলাম। এখান থেকে পর্যটক বাসে পরবর্তী গন্তব্য নর্থকেপ, যেটি কন্টিনেন্টাল ইউরোপের সর্বশেষ বিন্দু। বাইরে প্রচণ্ড তুষারপাত। পথে কয়েক মিটার উঁচু বরফ ও তুষারপাত উপেক্ষা করে বাসে উঠলাম। তুষারঝড়ের মধ্যে নর্থকেপে এসে মাত্র এক প্রজাতির কাক এবং দুই প্রজাতির গাঙচিল দেখলাম। এখানে একটি মিউজিয়াম আছে, সেখানে একটি অংশে ব্যারেন্ট সাগরে যে পাখিগুলো পাওয়া যায়, সেসব পাখির নমুনা দেখলাম। ব্যারেন্ট সাগরে তিমি ও শুশুক দেখেছি। আর যেখানে শুশুক জেগে ওঠে, সেখানে দেখেছি কয়েক শ ইডার হাঁস। মাছ খাওয়ার জন্য হাঁসগুলো ছোটাছুটি করছে। গ্রীষ্মে এখানে হাজার হাজার আটলান্টিক পাফিন পাখির আগমন হয়।

আজ জাহাজের সপ্তম দিন। বিকেল ৩টায় জাহাজ ভিড়ল নরওয়েজিয়ান-রাশিয়ান আর্কটিক এবং উত্তর-পূর্ব প্যাসেজের দিকের বন্দর ভার্দো। নরওয়ের প্রাচীনতম আন্ডারওয়াটার টানেলের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত এই দ্বীপে এসে আমি রোমাঞ্চিত। এই দ্বীপে এসে দেখা হলো শত শত কিটিওয়াক পাখির সঙ্গে। তাদের কলোনি ঠিক বন্দরের টার্মিনালে বেঁধে রাখা গাড়ির টায়ারে। তাদের ডাকাডাকি, ভালোবাসা, সাগরের জলে জলকেলি এতটাই প্রভাব বিস্তারকারী যে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। কিছু পাখি বরফের ওপর বসে ছিল। একদম কাছে গেলেও উড়ে যায় না। এমন দৃশ্য কেবল অ্যান্টার্কটিকায় দেখা মেলে। সেখানে পাখিরা মানুষদের ভয় পায় না। ভার্দো দ্বীপে গ্রীষ্মে জনবসতিহীন এবং খাড়া পাহাড়ের ধারে প্রায় ৪০ হাজার জোড়া কিটিওয়াক পাখি বাসা বাঁধে। এখানে প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত হয় এবং দুর্দান্ত উত্তরের আলো দেখা যায়। ভার্দো বন্দরের কাছের কয়েকটি মেরুন রঙের বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে এই পাখির দল।

৪ এপ্রিল, সকাল ১০টা। আমাদের জাহাজ নরওয়ের উত্তর উপকূল পেরিয়ে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করেছে। এখানে সাগরপারে পাহাড়গুলো ছোট ছোট এবং ঢেউ-খেলানো। উত্তর উপকূলেরর মতো নয়। তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি। চকচকে রোদের কারণে পুরো এলাকাটা ধবধবে লাগছে। সাগরে বরফের চাঁই জমে আছে। সবকিছুই বরফে ঢাকা। জাহাজ থেকে নেমে কিরকিনেস শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ি। নেমে একটু হাঁটার পরই দেখা পেলাম কয়েকটি চড়ুই পাখির। এখানের একটি গির্জার ছাদে অড্ডা জমিয়েছে কিটিওয়াক পাখিরা। পরের দিন সকাল ৭টায় চারদিকে শুভ্র বরফে আচ্ছাদিত পর্বতমালা ঘেরা একটি চ্যানেল থেকে বেরিয়ে খোলা সাগরে আসার পর দেখা পেলাম  শৈবালযুক্ত পাথরের একটি ছোট দ্বীপের। সেখানে ভিড় জমিয়েছে শতাধিক গাঙচিল। দ্বীপটি হ্যাভয়সুন্ড বন্দরের কাছাকাছি। সেদিনই উত্তরের শেষ শহর হ্যামারফেস্ট ছাড়িয়ে অকসফিয়র্ডের দিকে যেতে হাসভিক গ্রামের কাছের সাগরে দেখা পেলাম শতাধিক ইডার হাঁসের।

নরওয়েজিয়ান উপকূলের পাখিরা এবং সি-ইগল সাফারি

ট্রডেনহাইমের একটি পার্কে ইউরেশীয় ওয়েস্টারকার্টার

পরের দিন রিসোহাইম বন্দরে সকাল ১০টা ২০ মিনিটের সময় দেখা হলো এক কুড়ি স্লোফিঞ্চের সঙ্গে। বরফসাদা পাখিগুলো দেখে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এমন সুন্দর পাখি দেখার জন্য আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। রিসোহাইম বন্দর থেকে যাওয়ার সময় এক জোড়া মার্গেঞ্জার ও ৫০টি ইডার হাঁস আমাদের বিদায় জানাল। এরপর সকাল ১১টার দিকে স্টকমারকনেস পোতাশ্রয়ে এক জোড়া গাঙচিল, শতাধিক ইডার এবং একটি ছোট ফিশিং বোটের কাছে একঝাঁক গাঙচিলের মাছ ধরার দৃশ্য দেখলাম। লফোটেন দ্বীপমালার প্রধান শহর ভলভেয়ার শহরে বিকেল ৩টায় এক জোড়া সামুদ্রিক গাঙচিল দেখলাম কেবল।

৬ এপ্রিল বিকেল ৩টায় আমরা প্রায় ১৫ জন অনন্যসুন্দর ট্রলফিয়র্ডে ছোট্ট একটা মোটরবোট নিয়ে সি-ইগল সাফারির জন্য যাত্রা শুরু করলাম। এই ফিয়র্ডটির চারপাশের পর্বতমালার রূপ হৃদয়গ্রাহী। এখানে বাস করে নরওয়ের সবচেয়ে বড় শিকারি পাখি ধলা লেজ সিন্ধু ইগল। তবে পাখিটি সি-ইগল নামেই পরিচিত। প্রায় দুই ঘণ্টার সাফারি। ছোট বোটে প্রশিক্ষিত ও অনুমোদিত ব্যক্তি মাছের টুকরা কেটে কেটে যাত্রাপথে ছুড়লে সি-ইগল তার বৈচিত্র্যময় ছোবলে পায়ের ট্যালন দিয়ে সেই মাছ ধরে নিয়ে পর্বতের ওপরে গিয়ে খায়। এ সময় একটার পর একটা সি-ইগল উড়ে আসতে থাকে। সঙ্গে থাকে আরো অনেক গাঙচিল পাখি। সি-গাল হাত থেকে মাছ কেড়ে নেয়। যখন সামুদ্রিক ইগলরা প্রথমে আসে, তখন তারা কয়েকবার চক্কর দেয়। দুর্দান্ত দুই ঘণ্টার এই সাফারিতে আমরা প্রায় ১৮০টি সি-ইগল দেখেছি। সেই সঙ্গে শখানেক গাঙচিল। পুরো অভিযানে পাখি দেখার এই অভিজ্ঞতা ছিল সবচেয়ে রোমাঞ্চকর।

ট্রলফিয়র্ডে মাছ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে সি-ইগল

ট্রলফিয়র্ডে মাছ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে সি-ইগল

পরের দিন মেঘলা দুপুরে ব্রনোয়সুন্ড বন্দরে গিয়ে জীবনে প্রথম দেখা পেলাম তিনিট ব্ল্যাক গিলেমোট পাখির। গিলেমোট মাঝারি আকারের সামুদ্রিক পাখি। উত্তর আটলান্টিক উপকূল এবং পূর্ব-উত্তর আমেরিকার উপকূল জুড়ে এবং উচ্চ আর্কটিকে বাস করে। পাখিটিকে পাথুরে উপকূল, পাহাড় ও দ্বীপের প্রজনন আবাসস্থলে একক বা ছোট জোড়া জোড়ায় দেখা যায়। এরা মূলত মাছ, অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের খাওয়ার জন্য সমুদ্রের তলদেশের দিকে ডুব দেয়। এক ডুব দিয়ে অনেক দূরে যেতে পারে এবং জলের নিচে অনেকক্ষণ খাবার খুঁজতে পারে। পাখিগুলো খুব চালাক মনে হলো। পরের দিন দুপুরে  ট্রডেনহাইম শহরের একটি পার্কে দেখা হলো এক জোড়া ইউরেশীয় ওয়েস্টারকার্টার পাখির সঙ্গে। পার্কের ঘাসের মধ্যে এরা খাবার খুঁজছিল। পরের দিন দুপুরে ক্রিস্টিয়ানসুন্ড পোতাশ্রয়ে দেখা হলো একঝাঁক ইডার পাখির সঙ্গে। বিকেলের দিকে আটলান্টিক রোডের এলাকায় গিয়ে দেখেছি ধূসর বক, গাঙচিল ও ধুসর রাজহাঁস এবং এক জোড়া সারস পাখি। জাহাজের শেষ দিন সকালে বার্গেন বন্দরে দেখা হলো মিউট সোয়ান, কয়েক প্রজাতির গাঙচিল এবং ইউরেশীয় ওয়েস্টারকার্টার পাখির সঙ্গে। ১২ দিনের নরওয়ের উপকূল ভ্রমণে পাখির প্রজাতির সংখ্যা বেশি ছিল না। তবে কয়েকটি প্রজাতির প্রায় শত শত পাখি দেখেছি। পাখির বসতিগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, যেটি আগামী দিনের কোনো এক গ্রীষ্মে নরওয়ের উপকূলে পাখি দেখতে সাহায্য করবে আমাকে। নরওয়ের উপকূলের পথে পাখিদের জীবন, পর্বতের আবেদন, অসাধারণ সব ফিয়র্ড, সি-স্কেপ, উত্তরের আলো, নীল জল, জেলেদের গ্রাম, বরফের সাগর, তিমি, শুশুক, সুমেরু সাগরের তীর, নরওয়ের উপকূলের অনেক সুন্দর শহর ও নগরের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা ছিল অফুরন্ত সজীব ও স্বপ্নময়।

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ