তবে মাত্র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মাটি মেশানো কয়লার চালান আনলোড করা বন্ধ করে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের একজন শ্রমিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পর পর দুটি জাহাজের কয়লার চালানই অত্যন্ত নিম্নমানের। এত নিম্নমানের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র কিভাবে গ্রহণ করছে বুঝতে পারছি না।’
শ্রমিকরা বলেন, ‘এই দেশ আমাদের, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও আমাদের। এটির মালিক দেশের ১৮ কোটি মানুষ। এই কেন্দ্রটি নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই কেন্দ্রটিও বন্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে।’
শ্রমিকরা জানান, গত সাড়ে তিন মাস সময়ে অন্তত ১২টি কয়লার চালান এসেছে। কিন্তু এবারের এই দুই চালানের মতো খারাপ কয়লা আর আসেনি। এমন মানহীন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো অত্যন্ত ঝুঁকির। এতে যেকোনো সময় কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
শ্রমিকরা আরো বলছেন, শীত শেষে দেশের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এ অবস্থায় মনে হচ্ছে, মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, যাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুত্সংকটে বিপাকে পড়ে।
শ্রমিকরা বলছেন, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবুল কালাম আজাদ ছিলেন সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক। তাঁর আমলে দুর্নীতি করে প্রকল্পে অন্তত ৫০০ লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এঁদের অনেকে দলীয় পরিচয়ে চাকরি পেয়েছেন। এ কারণে মাটি মেশানো কয়লার চালান নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকে নীরব। শ্রমিকরা প্রথম চালানের কয়লা নিয়ে যেমন প্রতিবাদ করেছেন, দ্বিতীয় চালানের কয়লা নিয়েও প্রতিবাদ করছেন।
আবার গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে কয়লা অনলোডে নিয়োজিত মাতারবাড়ী বন্দরের শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এ কারণে জাহাজটিতে থাকা ১৩ হাজার টন কয়লা আনলোড করা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, হাশেম অ্যান্ড সন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে তাঁরা বন্দরের পণ্য লোড-আনলোড করেন। ওই প্রতিষ্ঠান এবার ঈদ বোনাস এবং মাসিক বেতন নিয়ে গড়িমসি করছিল। তবে শেষ পর্যন্ত দেনদরবার করে হাশেম অ্যান্ড সন্স কম্পানির মাধ্যমে শ্রমিকদের ঈদ বোনাস ও বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করে মেঘনা গ্রুপের লোকজন মঙ্গলবার রাতেই জাহাজের বাকি কয়লা আনলোডের কাজ শুরু করে দেয়।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, মেঘনা গ্রুপের লোকজন দ্বিতীয় জাহাজটির সব কয়লা আনলোড করা শেষ করেছেন। এখন মেঘনা গ্রুপের বহির্নোঙরে থাকা প্রথম জাহাজটির কয়লা যেকোনো মূল্যে আনলোড করাই তাঁদের কাজ। শ্রমিকদের তাঁরা (মেঘনা গ্রুপের লোকজন) বলেছেন, প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে হলেও আটকা পড়া জাহাজের কয়লা আনলোড করার ব্যবস্থা করা হবে।
এসব বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেনকে মোবাইলে না পেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
মেঘনা গ্রুপের লাখ কোটি টাকা পাচার তদন্তে এনবিআর
মেঘনা গ্রুপের মালিক মোস্তফা কামালের তরতর করে ওপরে উঠে যাওয়ার গল্প রূপকথাকেও হার মানায়। অর্থপাচার, শুল্ক ফাঁকি, কারসাজি, জালিয়াতিসহ নানা অপকর্মের অগণন উদাহরণ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সততার ভাবমূর্তি তৈরি করে ভালো উদ্যোক্তার আড়ালে দুর্নীতি আর অনিয়মকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। খোদ সরকারি দপ্তরের তথ্য-উপাত্তই বলছে, ৭০টি শিল্পের মালিক মোস্তফা কামালের টাকার কুমির হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে অবৈধ আয়। বলা হচ্ছে, গত ২০ বছরে তিনি অন্তত এক লাখ কোটি টাকা পাচার করেছেন, যার মধ্যে অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকাই আন্ডার ইনভয়েসিং।
আর হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর ও ভ্যাট ফাঁকি তো রয়েছেই। টাকা পাচারের বিষয়টি উচ্চতর তদন্তের জন্য একটি অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। একটি গোয়েন্দা সংস্থা, দুদক ও এনবিআরের তৈরি নথিপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মেঘনা গ্রুপের অনিয়ম-জালিয়াতির বিস্তারিত তুলে ধরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি এনবিআরকে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
গত বছর ২০ জুন এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়েছে, মোস্তফা কামাল ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে আমদানিতে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্কায়নযোগ্য পণ্য-মোটরযান-নৌযানের বিপরীতে বাধ্যতামূলক বীমা পলিসি এড়িয়ে গিয়ে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সের এক হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, সরকারের ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি ও ব্যাংক কমিশনের এক হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন।
অর্থপাচার ও বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিতে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল। মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, অবৈধ দখলে নদী ভরাট করে নষ্ট করেছেন নদীর গতিপথ। বেসরকারি ৯টি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে আট হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি, যার বেশির ভাগই ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।