কক্সবাজারের মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য আমদানি করা কয়লার চালানে বিপুল পরিমাণ কাদামাটি পাওয়া গেছে। এই কয়লা সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনিক সিমেন্ট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো স্পর্শকাতর কাজে মাটিমিশ্রিত কয়লা কেন সরবরাহ করল মেঘনা গ্রুপ, তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটিতে বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন-১) মোহাম্মদ সানাউল হককে আহ্বায়ক করা হয়েছে।
অন্য সদস্যরা হলেন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব (উন্নয়ন-৫) মোহাম্মদ হোসেন পাটোয়ারী এবং বিপিডিবির উপপরিচালক (বেসরকারি প্রকল্প) মো. নাজমুল হক। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের এই কয়লা ব্যবহার করলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবে।
এ কারণে ৬৩ হাজার টন কয়লার বিশাল এই চালানটি ফিরিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি (সিপিজিসিবিএল)। সিপিজিসিবিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, টেন্ডারের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়া মেঘনা গ্রুপের কম্পানি ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এবং ভারতের আদিত্য বিরলা গ্লোবাল ট্রেডিং কম্পানি পিটিই (সিঙ্গাপুরের রেজিস্টার্ড) এই চালান পাঠায়। কিন্তু চালানটির কয়লায় বিপুল পরিমাণ মাটি ছিল। ফলে এই কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহারোপযোগী নয়।
৬৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে জাহাজটি বন্দরে এলে প্রায় ২০ হাজার টন কয়লা খালাস করা হয়। কিন্তু এসব কয়লা খালাস করতে গিয়ে দেখা যায়, কয়লার সঙ্গে কালো রঙের কাদামাটি। স্বাভাবিকভাবে কয়লা কালো ও শুকনা থাকে। কিন্তু আমদানি করা কয়লার সঙ্গে কাদামাটি মিশ্রিত আর ভেজা। তাই এসব কাদামাটি খালাস না করে ফেরত পাঠিয়েছে সরকারি এই সংস্থাটি।
সিপিজিসিবিএল সূত্রে জানা গেছে, ৬৩ হাজার টন কয়লা নিয়ে গত ১৭ মার্চ ‘এমভি ওরিয়েন্ট অর্কিড’ নামের সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী একটি জাহাজ মাতারবাড়ী বন্দরের চ্যানেলে প্রবেশ করে। ২১ মার্চ জাহাজ থেকে কয়লাগুলো খালাস করেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা। খালাস করার সময় দেখা যায়, কয়লায় প্রচুর পরিমাণে মাটির মিশ্রণ রয়েছে। অথচ চুক্তি ছিল, ইন্দোনেশিয়া থেকে উচ্চমানের কয়লা সরবরাহ করবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কয়লা খালাসকালে বারবার আনলোডিং কনভেয়ার বেল্টে আটকে যাচ্ছিল। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জাহাজ থেকে কয়লা খালাস বন্ধ করে দিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, সরবরাহকারী মাটিমিশ্রিত নিম্নমানের কয়লা দেওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
অভিযোগ উঠেছে, জাহাজটির ব্যবহার অনুপযোগী কয়লা যেকোনোভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে গছিয়ে দিতে ব্যাপক তদবির চালানো হচ্ছে। এ কারণে জাহাজটি সাগরের দূরবর্তী স্থানে না পাঠিয়ে কাছাকাছি রাখা হয়েছে। বন্দর ও কয়লাবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট লোকজন জানিয়েছেন, আমদানি করা প্রতি টন কয়লার দাম পড়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। ভারতীয় কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইন্দোনেশিয়া থেকে ভালো মানের কয়লা সরবরাহ করার কথা থাকলেও মাটি মেশানো ও ভেজা কয়লা সরবরাহ করে আসছিল। কয়লাবাহী জাহাজটি পরিচালনায় রয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব কম্পানি।
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর দুটি ইউনিটই সার্বক্ষণিক চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতি মাসে যেখানে চারটি জাহাজ ভর্তি করে কয়লা আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তখনই ঘটেছে এমন ঘটনা। এমনিতে শীত বিদায় নেওয়ার পর দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে বিদ্যুতের। চাহিদা পূরণের জন্য কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে দুটি ইউনিট চালুর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন রীতিমতো বিপাকে পড়েছে।
ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। দেশবাসীকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
জামায়াতের আমির বলেন, ‘এক মাস পবিত্র সিয়াম সাধনার পরে আনন্দের বার্তা নিয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর আমাদের দুয়ারে সমাগত। জাতি এমন এক মুহূর্তে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছে, যখন দেশ ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসা জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে পারছে। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে এবং শান্তিতে-স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছে।’
জামায়াতের আমির আরো বলেন, ‘যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতি শান্তি-স্বস্তির দেশ পেয়েছে এবং কথা বলার সুযোগ পেয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করুন। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ও আহত হয়েছেন আমরা তাঁদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
’
জামায়াতের আমির বলেন, দেশ থেকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও তারা বিদেশে বসে এবং দেশে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা তাদের দোসরদের দিয়ে দেশে নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেই যাচ্ছে। দেশে যাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হতে পারে, সে জন্য নানাভাবে বিতর্ক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের মাঝে আগমন করছে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। পবিত্র ঈদুল ফিতর ধনী-গরিব সব শ্রেণির মুসলমানের মধ্যে নিবিড় ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে।
তিনি বলেন, ‘পবিত্র ঈদের এই দিনে আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষে মানুষে দয়া, সৌভ্রাতৃত্ব, সাম্য, ঐক্য ও ভালোবাসার এক মহা সেতুবন্ধ তৈরি করি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠনে তৎপর হই এবং সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসি এবং একে অপরের সুখানন্দ ও দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিই।’
জামায়াতের আমির সবার সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ জীবন কামনা করেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরে পাইনি এবং আমরা নির্বাচন পাইনি। নির্বাচন পেতে হলে আমাদের মধ্যে ঐক্যকে আরো অটুট রাখতে হবে।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে রুহিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত ইফতার মাহফিলে ভার্চুয়ালি বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফখরুল বলেন, ‘আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’
এ সময় আরো বক্তব্য দেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় পর্যবেক্ষণ টিমের সহসভাপতি মফিদুল আলম খান, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জাকির হোসেন, ঠাকুরগাঁও স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাসুদুল ইসলাম, সদস্যসচিব কামরুজ্জামান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রুহিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল হোসেন এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুুর রহমান।
জগন্নাথ হলে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসমাধির সামনে মোহন রায়। ছবি : কালের কণ্ঠ
তখনো সূর্যের আলো ফোটেনি। দূর থেকে আসছে কান্নার শব্দ। এ যেন স্বজন হারানোর বেদনা। জগন্নাথ হলের গণসমাধির দিক থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ।
কাছে গিয়ে দেখা গেল, ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসমাধি’র নিচে ঘাসের ওপর বসে কাঁদছেন এক ভদ্রলোক। পরনে নীল ফুলহাতা শার্ট, কালো প্যান্ট। একবার হাত দিয়ে গণসমাধি ছুঁয়ে দেখছেন, আরেকবার সবুজ ঘাস। চোখের জল যেন কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
মিনিট দুয়েক পর পিঠে হাত দিলাম—‘দাদা কাঁদছেন কেন?’
পেছন ফিরে তাকালেন। শার্টের হাতায় চোখ মুছে বললেন, ‘ভাই, আজ ২৫ মার্চ। দিনটা এলে নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারি না। একাত্তরের এই দিনে এই সবুজ চত্বর রাঙা হয়েছিল আমার স্বজনদের রক্তে।
কত যে লাশ টেনেছিলাম!’
বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। শুধু যে স্বজন বা পরিচিতদের হারিয়েছেন তা নয়, সেদিন নিজেও মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন।
নাম তাঁর মোহন রায়। পেশায় মালি। এখন ঢাকার বাংলামোটরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
থাকেন আজিমপুর। বয়স সত্তরের ঘরে। কিন্তু দেখলে বোঝার উপায় নেই। এই বয়সেও নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেন।
২৫ মার্চ জগন্নাথ হল ও তত্সংলগ্ন এলাকায় গণহত্যার শিকার লাশগুলো জগন্নাথ হলের মাঠে জড়ো করার পর সবার সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন মোহন। পায়ে গুলি লাগলেও বেঁচে যান। জীবন-মৃত্যুর সংকটময় সময়ে মানবতার ডাকে সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।
স্কুলে যাওয়া হয়নি : মোহনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। অভাব মোহনদের সংসারে বারো মাসের গল্প। স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। তবে নাম-ঠিকানা লিখতে পারেন। তাঁর বাবা বাসু রাজভর ফজলুল হক হলের মালি ছিলেন। মোহন ঢাকা ক্লাবে টেনিস বয় হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর। সেই সুবাদে কাজ চালানোর মতো উর্দু বলতে পারতেন। পরে চাকরি পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে।
সেদিন জ্বর ছিল তাঁর : জগন্নাথ হলে রবীন্দ্রভবনের পেছনের পূর্ব পাশটায় ছিল মোহনদের বাসা। একাত্তরে তিনি ২০ বছরের তরুণ। ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত। মোহনরা টের পাচ্ছিলেন বড় কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে বসে। ২৫ মার্চ দুপুর থেকেই জ্বর ছিল তাঁর। শরীরটাও ছিল ক্লান্ত। সন্ধ্যার একটু পর ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙে গোলাগুলির শব্দে। উঠে দেখেন লাল আলো এবং ধোঁয়া। হলের পাশের মেইন রোডে পাক সেনাদের অনেক গাড়ি। হলের ভেতরে দলে দলে সেনারা প্রবেশ করছে। অনবরত গুলির আওয়াজ। বাড়ির সবাই মিলে চৌকির নিচে আশ্রয় নিলেন। আক্রমণটা শুরু হলো রাত ১২টার দিকে। চারদিকে শুধু ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ শব্দ। হানাদারদের একটা গাড়ি তাঁদের বাসার সামনে রাখল। আর্মিরা দরজা খুলতে বলল। বাসু রাজভর উঠে দরজা খুলে দিলেন। ওরা সবাইকে বের হতে বলল। মোহন উর্দুতে বলেছিলেন, ‘হাম লোক কৈ কাছর নেই হ্যায়, হাম লোককা উপর ক্যা জুলুমছে আয়া।’ ওরা বলল, ‘তুম লোক উর্দুমে বাত চিতকে বাতায়া সামাজ মে নেহি তো হাম মেজর সাব কো বোলায়া।’
জি সি দেব পড়ে ছিলেন মেঝেতে : মোহন মাঠে এসে দেখেন, টিনশেডের ছাত্রাবাস, সোনালি ব্যাংক জ্বলছে। মেজরের সামনে থেকে সেনারা মোহনদের ডেকে নিয়ে গেল লাশ টানার জন্য। বাংলা এবং উর্দু বলতে পারে যারা—দুটো দলে ভাগ করল তাদের। দুই গ্রুপ সৈন্য ভার নিল কাজ করানোর। বাংলাভাষী গ্রুপ কাজ শুরু করল হলের ভেতর, আর অন্য গ্রুপকে নিয়ে গেল শিববাড়ীর দিকে।
মোহন বলেন, ‘আমরা সামনে, পেছনে সেনারা। রাইফেল তাক করা—যেন পালাতে না পারি। বুধিরাম, মিস্ত্রি, জহরলালসহ আমার সঙ্গে আরো পাঁচজন ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। থাকতেন শিববাড়ীসংলগ্ন শিক্ষক কোয়ার্টারে। মোহনরা গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা বন্ধ। পাক সেনারা লাথি মেরে ভাঙল। মোহন বলেন, ‘ঘরের ভেতরে আর কেউ ছিল না। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে দেব বাবুকে ওরা গুলি করেছে। ঘরে ঢুকে দেখি, দেববাবু মেঝেতে পড়ে আছেন। আমরা তাঁর লাশ টেনে নিয়ে বর্তমান জগন্নাথ হল শহীদ মিনারের কাছে রাখি। রক্তমাখা ভারী শরীর। আনার সময় তাঁর পরনের ধুতিটা খুলে গিয়েছিল। তখন লাশটা মাটিতে রেখে ধুতিটা ঠিক করে দিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই ঘাড়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারল এক পাক সেনা। গালিও দিল—‘তুম ইয়ে লাশকো কিউ রাখতা হ্যায়, এক সাথমে টেনে চল।’
মধুদা তখনো বেঁচে ছিলেন : চারদিক থেকে লাশ টেনে আনা হচ্ছে। মৃত ভেবে মধুদার লাশ আনতে যখন তাঁর বাসায় গেলেন, তখনো তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানালেন মোহন। বললেন, ‘আহত লোকটাকে নিয়ে আসতে হলো সেনাদের হুকুমে। তাঁর দেহটা রাখলাম মাঠে লাশের স্তূপে। রাখার পর গুলি করল সেনারা। গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বুট দিয়ে মুখটা থেঁতলে দিল।’
জগন্নাথ হল থেকে যেসব লাশ টেনেছিলেন—ততক্ষণে সবার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। উত্তরবাড়ি থেকে, পুকুর পার থেকেও বহু ছাত্রের লাশ এনেছেন। যেসব ছাত্রের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন তাঁদের অনেকের লাশও টানতে হয়েছে।
লাশ টানতে টানতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। পরে উর্দু জানা সবাইকে নেওয়া হলো মেজরের কাছে। এদের মধ্যে মোহনের এক স্বজনও ছিলেন। তিনি উর্দুতে পাক সেনাদের সঙ্গে বাতচিত করলেন। অন্যদের কাতর প্রার্থনা। কিন্তু মন গলল না।
মরার মতো পড়ে রইলেন : যারা লাশ টেনেছে, সবাইকে নিয়ে আসা হলো হলের শহীদ মিনারের সামনে। কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন সবাই। কিন্তু তাঁদের লাইন ধরে দাঁড়াতে বলা হলো। মোহন ছিলেন একেবারে প্রথমে। উর্দুতে নিজেকে বিহারি বলে পরিচয় দিয়ে প্রাণভিক্ষা চাইলেন তিনি। মেজর বলল, ‘ওর লুঙ্গি উঁচিয়ে দেখ’। একজন সৈনিক সজোরে মোহনের গালে থাপ্পড় মারল। ঘুরে কয়েকজনের পেছনে চলে গেলেন তিনি। এরপর লাইনে দাঁড় করানো লোকগুলোকে গুলি করলে গুলিবিদ্ধ লোকগুলো পড়ল মোহনের ওপর। রক্তে গা ভেসে গেল।
মোহন বলেন, ‘ওরা মনে করল আমিও মারা গেছি। তবে কিছু সময় পর আমার পা নড়ে উঠলে পায়ে গুলি করল। গুলি খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম। একটা গুলি ডান পায়ের ঊরুতে এবং অপরটা বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে লাগে।’
অনেকক্ষণ গুলির শব্দ না পেয়ে মোহন চোখ খুলে দেখলেন, পাক সেনাদের দেখা যাচ্ছে না। তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, পা ফুলে গেছে। কাছেই দেখলেন বুধিরামকে। বোনাই (দুলাইভাই) বলে ডাক দিলেন। পেটে গুলি লেগেছে তাঁর। খুব কষ্টে পেট চেপে ধরে রেখেছেন। বুধিরামের খুব রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।
আবার হলে ফেরা : স্বাধীন দেশে আবার হলে ফেরেন মোহন। আবার শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে ফুল ফোটানো। একসময় বিয়েও করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।
২৫ মার্চের সেই বিভীষিকা আর ভুলতে পারেননি। পায়ে এখনো গুলির ক্ষত রয়ে গেছে। সাইকেল চালালে ব্যথামুক্ত থাকেন। হাঁটতে গেলে এখনো ব্যথা পান বলে জানালেন মোহন।
বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়ে প্রস্তাবনা পাস অস্ট্রেলিয়ার সংসদে
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
বাংলাদেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে প্রস্তাবনা পাস হয়েছে। দেশটির তিনটি রাজনৈতিক দল—লেবার, লিবারেল ও গ্রিন পার্টির সংসদ সদস্যরা এই বিল প্রস্তাব করেন, যা সংসদে পাস হয়।
গত বুধবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশটির সংসদের অধিবেশনে এই আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট মো. রাশেদুল হক এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো এবং নির্বাচনী সততা ও জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রূপান্তর; জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যরা।
সংসদে লিখিত বক্তব্য দেন এনএসডব্লিউয়ের সদস্য এবিগেইল বয়েড। তিনি বলেন, ‘এই হাউস উল্লেখ করে যে—ক. ২৬ মার্চ ২০২৫ হচ্ছে বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস, যা বাংলাদেশের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে ৫৫ বছর পূর্তি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটিকে স্মরণ করে; খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, মুক্তি, ন্যায়বিচার, ঐক্য, সাম্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামে বাংলাদেশি জনগণের শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা উদযাপন করে; গ. ২৩ মার্চ বাংলাদেশ কমিউনিটি কাউন্সিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য লাকেম্বা লাইব্রেরি হলে দোয়া ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে অনেক সম্প্রদায়ের সদস্য এবং অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য একত্র হয়েছিলেন, যা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশি-অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায়সহ বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি জনগণের জন্য একটি চিরন্তন গর্বের; ঘ. সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাবেক শাসনব্যবস্থার পতনের পর বাংলাদেশের জনগণ গুরুতর চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতি, হুমকি এবং অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হচ্ছে। এই সংকটময় সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন এবং পদ্ধতিগতভাবে দুর্নীতি ভেঙে ফেলা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এই সংসদ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশি জনগণের চলমান লড়াইয়ের সঙ্গে তার সংহতি নিশ্চিত করে।
’
এবিগেইল বয়েড আরো বলেন, ‘এই সংসদ অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এবং নির্বাচনী সততা, জবাবদিহি ও শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়নের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।’