বিবৃতিতে দাবি করা হয়, উভয় দেশ একমত হয়েছে যে বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছরে, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সব সময় শক্তিশালী ও স্থিতিশীলভাবে এগিয়ে গেছে।
উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচ নীতির প্রতি অটল থাকার, ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্ব এগিয়ে নেওয়ার, রাজনৈতিক পারস্পরিক বিশ্বাস দৃঢ় করার, উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় গভীর করার এবং বাংলাদেশ-চীন কৌশলগত অংশীদারিকে আরো সমৃদ্ধ করার বিষয়ে একমত হয়েছে। এতে উভয় দেশের জনগণের জন্য আরো বেশি সুফল নিশ্চিত করা যাবে বলে তারা আশাবাদী।
চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মেনে চলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে শ্রদ্ধা করে এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় সমর্থন প্রদান করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, চীন সব সময় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সুপ্রতিবেশীসুলভ নীতির অনুসারী এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকর শাসন পরিচালনা, জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমর্থন দিয়ে আসছে।
উভয় দেশ সমতার ভিত্তিতে শৃঙ্খলাপূর্ণ বহুপক্ষীয় বিশ্ব ও সর্বজনীনভাবে উপকারী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন প্রতিষ্ঠায় একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
মায়ানমার সংকট ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের ভূমিকা : বাংলাদেশ মায়ানমারের শান্তি আলোচনায় চীনের গঠনমূলক ভূমিকা এবং রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে চীনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে।
চীন রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত জনগণকে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে এবং বাংলাদেশ ও মায়ানমারকে পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। চীন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ায় তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং এবং চীনের জনগণকে তাঁর ও বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের প্রতি উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি উভয় পক্ষের সুবিধাজনক সময়ে চীনা নেতৃত্বকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনের জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা : শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনকে আরো জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সকালে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। বৈঠকে উভয় নেতা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। বাংলাদেশে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অভ্যুত্থান ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের পথ সুগম করেছে।
চীনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক ও সামাজিক ব্যবসার প্রচলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বৈঠকের সময় তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেন এবং মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনে চীনের শক্তিশালী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং নিজ নিজ পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
ঢাকা ও বেইজিং ৯ চুক্তি স্বাক্ষর : বাংলাদেশ ও চীন অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতাসংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং ক্লাসিক সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আব্দুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, বিনিয়োগসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা, চীন শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল শুরুর ঘোষণা, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং হৃদরোগ সার্জারি যানবাহন দানের বিষয়ে পাঁচটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
চীনের কাছে ৫০ বছরের পানি ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছে বাংলাদেশ : শত শত বিস্তৃত নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বেইজিংয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে চীনের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি এ আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস চীনের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করে বলেন, চীন পানি সমস্যার সমাধানে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। চীনা মন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের যে সমস্যা রয়েছে, আমাদেরও সেই একই সমস্যা। তাই যদি আপনারা আপনাদের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন, তাহলে আমরা খুশি হব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের কাছ থেকে শেখার জন্য এখানে এসেছি, কিভাবে আমরা পানিসম্পদকে জনগণের জন্য উপযোগী করে তুলতে পারি।’
চীনের পানিসম্পদমন্ত্রী স্বীকার করেন, চীন ও বাংলাদেশ পানি ব্যবস্থাপনায় একই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তিনি বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত : চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে ঐতিহাসিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর চীন ও বাংলাদেশ তাদের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনের রাজধানীর গ্রেট হল অব দ্য পিপলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বৈঠককালে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডার প্রতি চীনের পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশকে চীনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বেইজিংয়ের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা বিনিময় করার এবং বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, চীন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শূন্য শুল্ক সুবিধা প্রদান অব্যাহত রাখবে এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের দুই বছর পর ২০২৮ সালের শেষ পর্যন্ত এই মর্যাদার মেয়াদ বাড়াবে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে আরো চীনা বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে বেইজিং ঢাকার সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং বিনিয়োগচুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে চায়।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বত্তৃদ্ধতা ও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি : প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিকেইউ) বত্তৃদ্ধতা করবেন। সকাল ১০টার দিকে তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে।