কল্পনাতীত বেশির ভাগ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল পতিত হাসিনা সরকারের আমলে। কোনো ধরনের যাচাই না করেই খেয়াল-খুশিমতো বিভিন্ন অঙ্গ ধরে নেওয়া হতো প্রকল্প। যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে গিয়ে বিভিন্ন কাজে পরিবর্তন করা হতো। এতে বারবার প্রকল্প সংশোধন করতে হতো এবং ব্যয় বেড়ে যেত।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পে বরাদ্দ দিলেও খরচ করতে পারত না। যার কারণে প্রতি অর্থবছরেই এডিপি বাস্তবায়ন মূল এডিপির তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম হতো।
হাসিনা সরকারের পলায়নের পর পালিয়েছে তাঁর দোসর অনেক প্রকল্প পরিচালক। কিছু ঠিকাদার পালিয়েছেন, আবার কিছু বন্দিও হয়েছেন।
যার ফলে চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের চাহিদা না থাকায় সংশোধিত এডিপিতে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। অথচ চাহিদা আরো অনেক কম। যার ফলে আরো প্রায় ২৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ হিসেবে রেখে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো অর্থবছরে এত বিপুল পরিমাণ কাটছাঁট ও থোক বরাদ্দ আগে কখনো রাখা হয়নি।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুমোদন পাওয়া আরএডিপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) ‘বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা’ নামে থোক বরাদ্দ হিসেবে রাখা হয়েছে ২৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা, যা ইতিহাসের যেকোনো অর্থবছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ খাতের বরাদ্দ চার হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে আরএডিপিতে ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে আরএডিপিতে থোক বরাদ্দ প্রায় আট হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা বা ৪৭.৪৯ শতাংশ বেড়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার এডিপি থেকে ১৮.৪৯ শতাংশ বা প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা কেটে নিয়ে সম্প্রতি দুই লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার আরএডিপি অনুমোদন দিয়েছে এনইসি।
এ হিসাবে নতুন আরএডিপির ১২.৩৩ শতাংশই কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নাম উল্লেখ না করেই থোক বরাদ্দ হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। এর আগে মূল এডিপির ২.৯৩ শতাংশ বা ছয় হাজার ৩২৯ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ হিসাবে সংশোধিত এডিপিতে মূল এডিপির তুলনায় থোক বরাদ্দ ২০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা চার গুণের বেশি বেড়েছে।
এডিপি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের এডিপি থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের আরএডিপি পর্যন্ত থোক বরাদ্দের পরিমাণ মোট বরাদ্দের আধা শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে এর হার ০.৪৭ শতাংশ থাকলেও আরএডিপিতে বেড়ে দাঁড়ায় ১.৬৬ শতাংশে। এর পর থেকেই থোক বরাদ্দের পরিমাণ ও শতকরা হার বেড়েই চলেছে।
সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মোট চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কারণে থোক বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে আরএডিপি বাস্তবায়নে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক লাখ ২০ হাজার ৮৭৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ও বিদেশি সহায়তা বাবদ ৭০ হাজার ২৩৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা মিলে মোট এক লাখ ৯১ হাজার ১১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার চাহিদা পাওয়া গিয়েছিল।
তবে অর্থ বিভাগের বরাদ্দের আলোকে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ও প্রকল্প সহায়তার ৮১ হাজার কোটি টাকা যোগ করে দুই লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়গুলো চাহিদার তুলনায় এডিপির আকার ২৪ হাজার ৮৮৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা বা প্রায় ১৩.০২ শতাংশ বেশি ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বেশি ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ১২৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বা ১১.৬৯ শতাংশ। অন্যদিকে প্রকল্প সহায়তা বাবদ ১০ হাজার ৭৬২ কোটি ১৬ লাখ টাকা বা ১৫.৩২ শতাংশ বেশি জুড়ে দেওয়া হয়েছে এডিপিতে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। সাধারণত অন্যান্য অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিল থেকে চাহিদা অনেক বেশি থাকে।
কিন্তু চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যে পরিমাণ সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চাহিদা তার চেয়ে কম রয়েছে। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু বড় প্রকল্পে উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কিছু ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন।
এনইসি সভায় পরিকল্পনা বিভাগ ও কার্যক্রম বিভাগের সচিব ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, চাহিদার তুলনায় সম্পদ বেশি থাকায় চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়ার পর অবশিষ্ট অর্থ বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনে থোক রাখা হচ্ছে।
পরে চাহিদার ভিত্তিতে বরাদ্দ প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ পুনর্বণ্টন ও পুনর্নির্ধারণ করা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন বলে এনইসি সভার কার্যবিবরণীতে উঠে এসেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা পরিষদসহ ৯টি খাতে বিশেষ সহায়তা খাতে মোট চার হাজার ১৮০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে আরএডিপিতে।