
জনপ্রিয়তা পেয়েছে এম-ফোর প্রসেসরযুক্ত ম্যাক মিনি ছবি : সংগৃহীত
অ্যাপলের আধিপত্য অব্যাহত
নতুন এম৪ প্রসেসরযুক্ত ল্যাপটপ, ডেস্কটপ ও ট্যাবলেট বাজারের সব ডিভাইসকে পারফরম্যান্সে হারিয়ে দিয়েছে, বেড়েছে বিক্রি। আইফোন ১৬ সিরিজও হয়েছে হিট, বিক্রি বেড়েছে ৬ শতাংশ। তবে অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স ছিল এ বছরের অন্যতম বড় ব্যর্থতা। তাদের এআই ফিচারের অপরিপক্বতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়েছে তুমুল সমালোচনা।
ওলেড মনিটরের দাম কমেছে
পিসিবাজারে অবশেষে ওলেড প্রযুক্তির মনিটর জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এখনো দাম পুরোপুরি হাতের নাগালে না এলেও হাজার ডলারের নিচে নেমেছে ওলেড প্রযুক্তির মনিটরের দাম।

এআই প্রসেসিংয়ে সেরা ‘ব্ল্যাকওয়েল’ প্ল্যাটফরম ছবি : সংগৃহীত
এআই
এআইয়ের জয়জয়কার
চ্যাটজিপিটি এখনো সেরা
এ বছরেও ওপেনএআই তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। নতুন ‘জিপিটি ফোর-ও’ মডেলটি সব ধরনের কাজেই যথেষ্ট পারদর্শী, নেই বড় কোনো দুর্বলতা। গুগলের জেমিনি, অ্যানথ্রোপিকের ক্লড অথবা মেটা লামা মডেলগুলো কিছু কাজে তূলনামূলক বেশি পারদর্শী হলেও অন্য বিষয় আছে বেশ পিছিয়ে। ফলে ব্যবহারকারীদের পছন্দের তালিকায় চ্যাটজিপিটি এখনো সবার ওপরে অবস্থান করছে।
কাজের নয় এআই স্মার্টফোন
গুগল, স্যামসাং ও অ্যাপল—প্রতিটি নির্মাতাই চেষ্টা করেছে তাদের স্মার্টফোনে এআই যুক্ত করার। গ্যালাক্সি এআই, গুগল জেমিনি ও অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স খুব কাছাকাছি ধরনের ফিচার ব্যবহারকারীদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। ফোনকল ও বিভিন্ন লেখা সরাসরি ফোনেই ভাষান্তর করা, ছবি জেনারেট এবং আরো সাবলীল ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রতিটি ডিভাইসে দেখা গেলেও ব্যবহারকারীরা তাকে ‘চটকদার’ উপাধি দিয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নতুন ফিচারের বিষয়ে কৌতূহল শেষ হওয়ার পর ব্যবহারকারীরা সেসব আর ব্যবহার করে না।
চ্যাটবটের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে
লেখালেখি অথবা প্রগ্রামিংয়ের পাশাপাশি চ্যাটবটকে বন্ধু অথবা থেরাপিস্ট হিসেবেও ব্যবহারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। চ্যাটবটগুলো ভালো-মন্দ অথবা ভুল-শুদ্ধের মধ্যে এখনো তফাত করতে পারে না, যার ফলে দেয় প্রচুর ভুল উত্তর। মানসিক সমস্যার মতো জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় এআইয়ের ওপর নির্ভর করা অনুচিত। ভুল পরামর্শ গ্রহণে বড় ক্ষতিও হতে পারে। এআইকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাও বেড়েছে। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ভুল তথ্য। এআই ব্যবহার করে সংবাদ ম্যানিপুলেশনের জোরালো অভিযোগ উঠেছে এ বছর, যদিও তা প্রমাণিত নয়।
শক্তিশালী এআই প্রসেসর এনেছে এনভিডিয়া
দুটি বি২০০ টেনসর কোর জিপিইউ এবং তা পরিচালনার জন্য শক্তিশালী গ্রেস সিপিইউ মিলিয়ে তৈরি গ্রেস-ব্ল্যাকওয়েল সুপারচিপ বর্তমানে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী এআই প্রসেসিং প্ল্যাটফর্ম। চলতি বছরের শুরুতেই সেটি উন্মোচন করেন এনভিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জেনসেন হুয়াং। সর্বমোট ১ দশমিক ৪ এক্সাফ্লপ এআই পারফরমেন্স এবং ৩০ টেরাবাইট মেমরি এতে আছে। উন্মোচনের পরপরই বিশ্বের সব এআই নির্মাতা এটি কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলাফল এনভিডিয়ার আয় বৃদ্ধিতে এ বছর আবারো হয়েছে নতুন রেকর্ড।
জ্যামিতিক হারে বেড়েছে এআই ব্যবহার
প্রচুর অসন্তোষ ও নিন্দার পরও এআই ব্যবহারের পরিমাণ এ বছর বেড়েছে। বিশেষত কাস্টমার কেয়ার এজেন্ট, অফিসের বিভিন্ন লেখালেখির কাজ এবং বিজ্ঞাপনের জন্য ছবি ও ভিডিও তৈরিতে এআই ব্যবহৃত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ বছর এআইভিত্তিক সেবার বাজারমূল্য ২০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ওপেনএআইকে একাই মূল্যায়ন করা হয়েছে ১৫৭ বিলিয়ন ডলার।

চমক দেখিয়েছে স্পেস মেরিন-২। ছবি : সংগৃহীত
গেম
সবার পছন্দ সহজবোধ্য গেম
সিঙ্গল প্লেয়ার গেমের জয়জয়কার
বছরের শেষ প্রান্তিকে প্রকাশিত হয়েও সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে স্পেস মেরিন ২, স্টকার ২ : হার্ট অব চোরনোবিল এবং ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য গ্রেট সার্কেল। স্পেস মেরিন ২-এর তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল এ বছরের সবচেয়ে বড় চমক। বহু বছর ধরে চলছে অতিরিক্ত প্যাঁচানো কাহিনি, জটিল গেমপ্লে এবং মাইক্রোট্রানজাকশনে ভরা মাল্টিপ্লেয়ার মোডের গেম ডিজাইনের দৌরাত্ম্য। সেসব বাদ দিয়ে সিঙ্গল প্লেয়ার গেমের স্বর্ণযুগে ফিরে গেছে স্পেস মেরিন ২-এর গেম ডিজাইন, ফলাফল গেমটির বিক্রি গড়েছে বেশ কয়েকটি রেকর্ড।
বড় বাজেটের গেম ফ্লপ
এ বছর বেশ কয়েকটি মাল্টিপ্লেয়ার গেম চরম ফ্লপ করেছে। সুইসাইড স্কোয়াড : কিল দ্য জাস্টিস লীগ এবং কনকর্ড তার মধ্যে অন্যতম। সুইসাইড স্কোয়াড গেমটি নিয়ে বহুমুখী বিতর্ক হলেও শেষ পর্যন্ত গেম ডিজাইন এবং গেমপ্লের চরম ঘাটতির ফলে গেমাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কনকর্ড তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আট বছর, ব্যয় হয়েছে ৪০ কোটি ডলারেরও বেশি। এর পরও মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্মাতা সনি গেমটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। স্কাল অ্যান্ড বোনস, অ্যাসাসিনস ক্রিড মিরাজ এবং স্টার ওয়ার্স আউটলজ—পর পর তিনটি ফ্লপ গেম বাজারে এনে একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় গেম নির্মাতা ইউবিসফটও বড়সড় লস দিয়েছে এ বছর। তাদের নতুন গেম অ্যাসাসিনস ক্রিড শ্যাডোসের ট্রেইলার নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। অ্যাক্টিভিশন প্রকাশ করেছে কল অব ডিউটি ব্ল্যাক অপস ৬, গেমটির সিঙ্গল প্লেয়ার ক্যাম্পেইন নিয়ে গেমাররা সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও মাল্টিপ্লেয়ারে প্রচুর মাইক্রোট্রানজেকশন থাকায় দ্রুত গেমটি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
গেমারদের খরচ বেড়েছে
এ বছর সনি বাজারে এনেছে প্লেস্টেশন ৫ প্রো, যার মূল্য ৭০০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান মন্দার মাঝে এমন চড়া মূল্যের গেমিং কনসোল বাজারে এনে সনি পড়েছে নিন্দার মুখে। অন্যদিকে পিসি গেমারদেরও বেড়েছে খরচ, চলনসই জিপিইউ কিনতে তাদের খরচ হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ ডলার। গেমের দামও বাড়ছে দ্রুত। অচিরেই নতুন গেমের দাম ৮০ থেকে ৯০ ডলার দাঁড়াবে ধারণা করছে গেমাররা। গেমের আকৃতিও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ পিসি গেমের জন্য ১৫০ জিবি জায়গা হরহামেশাই প্রয়োজন হচ্ছে। তাই দ্রুতগতির ইন্টারনেটসেবা এবং বড়সড় এসএসডির জন্যও গেমারদের রাখতে হচ্ছে বাজেটের বড় অংশ।
মোবাইল গেমের বাজার প্রায় অপরিবর্তিত
বরাবরের মতোই রোব্লক্স, ফ্রি ফায়ার, মোবাইল লেজেন্ডস, মাইনক্রাফট এবং পাবজি মোবাইল ছিল স্মার্টফোনে সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম। বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে গেম খেলার পরিমাণ কমেছে। তবে স্মার্টফোন গেম থেকে এ বছর নির্মাতারা আয় করেছেন ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ প্রতিটি গেমার এ বছর তূলনামূলক বেশী অর্থ গেমগুলোর পেছনে ব্যয় করেছেন। স্মার্টফোনে ক্যাজুয়াল, মাল্টিপ্লেয়ার শ্যুটার এবং বিল্ডিং স্যান্ডবক্স ছাড়া অন্য ঘরানার গেম কেন সফলতা পাচ্ছে না, সে বিষয় নিয়ে গেম নির্মাতা চিন্তিত। আগামী বছরগুলোতে হয়তো স্মার্টফোন গেমিং বাজার থেকে তাদের আয় আরো বাড়বে, কিন্তু নতুনত্বের আশা নেই।

ফোন
ক্রেতাদের আস্থা আইফোনেই
স্মার্টফোন বাজারে অস্থিরতা
বছরের শুরুতে বিক্রি কিছুটা কম থাকলেও বছরের শেষে মন্দা কাটিয়ে উঠেছে স্মার্টফোন বাজার। মার্কিন বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে চীনা স্মার্টফোন নির্মাতাদের ওপর। যেমন—এ বছরের সেরা ক্যামেরাসমৃদ্ধ স্মার্টফোন ভিভো এক্স ২০০ প্রো বিশ্বব্যাপী তেমন একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন প্রসেসরযুক্ত স্মার্টফোন তেমন দেখা যায়নি, বেশির ভাগ চীনা নির্মাতার ফোনই ছিল মিডিয়াটেক প্রসেসরচালিত।
ট্যাবলেট বাজারে হতাশা
গুগল আবারও ঘোষণা দিয়েছে, তারা অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেট নিয়ে কাজ করবে না। দোদুল্যমান অ্যানড্রয়েড ট্যাবলেট বাজারে গুগল কখনোই শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি, স্যামসাং এবং লেনোভোও বিক্রি কমেছে এ বছর। যারা ট্যাবলেট ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে আইপ্যাড ও অ্যামাজন ফায়ারের জনপ্রিয়তা রয়েছে অপরিবর্তিত।
অপারেটিং সিস্টেম অপরিবর্তিত
আইওএস ১৮ এবং অ্যানড্রয়েড ১৫, দুটিই ব্যবহারকারীদের তেমন নতুনত্ব দিতে পারেনি। দুটি নির্মাতাই জোর দিয়েছে এআই ফিচারের ওপর; যেমন—সরাসরি ডিভাইসেই ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট চালনা, ট্রান্সলেশন করা, ছবি তৈরি অথবা লেখার সামারি তৈরির মতো ফিচার ব্যবহারকারীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার। অ্যাপল তাদের নিজস্ব অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স এখনো পুরোদস্তুর চালু করতে পারেনি, তা নিয়ে প্রচুর সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন ফোরামে।
মানসম্মত ভিডিওর কদর বেড়েছে
এ বছর ছবি নয়, স্মার্টফোন ক্রেতারা ভিডিওর ওপর জোর দিয়েছে বেশি। স্ন্যাপচ্যাট ও টিকটকের পাশাপাশি ভিডিও কলের জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সেলফি ক্যামেরার মানের ওপরও অনেকটা নির্ভর করেছে ফোনগুলোর জনপ্রিয়তা। প্রচুর স্মার্টফোনের মূল ক্যামেরার চেয়ে আলট্রাওয়াইড ও জুম ক্যামেরার মান খারাপ হওয়ায় ভিডিওর মধ্যে জুম পরিবর্তন করলে তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। সমস্যাটিকে ‘ডিল ব্রেকার’ বলেছে বেশির ভাগ ক্রেতা।
♦ বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারের তথ্য সংগ্রহ ও সালতামামি লিখেছেন আশিক উল বারাত ও এস এম তাহমিদ