রবীন্দ্রনাথের 'তালগাছ' কবিতাটি শৈশবে পড়েননি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। কবি খান মহম্মদ মইনুদ্দিনও লিখেছিলেন তালগাছ নিয়ে কবিতা- 'ওই দেখা যায় তালগাছ/ ওই আমাদের গাঁ/ ওইখানেতে বাস করে/ কানাবগির ছা...।
তালগাছ নিয়ে দুই কবির ছড়ায় যে বর্ণনা, বলতে গেলে চোখের সামনেই ভেসে ওঠে আমাদের গ্রামের তালগাছের ছবি। কেননা, আমাদের গ্রামবাংলার সঙ্গে তালগাছও দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে সমানভাবে জুড়ে আছে।
তালপাতার পুঁথি থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনা, সিপাই বাঁশি, আবার বাড়ির ছাউনি থেকে বর্ষাতি, রস থেকে নানা সুস্বাদু পদ- গোটা গাছটাই কাজে লাগে মানুষের। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, তালগাছ বজ্রনিরোধক বলে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দেওয়ার পর তালবীজ রোপণের শোরগোল পড়ে গেছে দেশব্যাপী।
কিন্তু সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের আগেই বিকল্প সব উপায় এসে যাওয়ায় গ্রাম বাংলার এই সুপরিচিত গাছটি বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। কারণ এর কদর কমছে ক্রমশ।
কদরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে তালগাছের সংখ্যাও। এমন সময়ে দাঁড়িয়ে তাল-ঐতিহ্যকে ফিরে দেখতে এবং তালবীজ রোপণে উৎসাহিত করতে উদ্যোগী হলো বরিশালের দেড় বছরের পুরনো কলসকাঠী বিএম একাডেমি।
স্কুলের উদ্যোগে আজ সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) 'তাল উৎসব-২০২০' নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান উদ্বোধন করেন এই তাল উৎসব।
স্কুল ক্যাম্পাসে আয়োজিত 'তাল উৎসব'কে দুইভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। একদিকে রয়েছে, তালের তৈরি নানা খাবারের সম্ভার। তাল পুলি, কেক, মালপোয়া, তালপোয়া, পাটিশাপটা, তাল মালাই, তালের বড়া, তাল ফোপড়া, তাল ফাঁপা, রকমারি পিঠে, মালপোয়াসহ নানা পদ। গ্রামের অন্তত ১০ জন নারী তাঁদের ঘরে তৈরি পিঠা স্কুলে প্রদর্শন করেন।
অন্যদিকে চলে তালগাছ সম্পর্কিত প্রদর্শনী।
সেখানে রয়েছে তালপাতা, তালবীজ রোপণের ব্যাপারে আলোচনা। সঙ্গে তালের ইতিহাস, বাংলা ছাড়াও দেশের অন্যভাগে ও বিদেশে তালগাছ নিয়ে নানা অজানা কথা। তালগাছ নিয়ে লেখা গল্প, কবিতা, ছড়া। কীভাবে এতদিন ধরে মানুষের কাজে লেগে এসেছে ওই গাছ, ভবিষ্যতেও জীবন-জীবিকাকে কীভাবে আরো উন্নত করতে পারে তালগাছ, তার ওপর আলোচনা ছিল।
বিএম একাডেমি পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন, বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাধবী রায়, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকমল হোসেন, বাকেরগঞ্জ থানার ওসি আকরাম হোসেন, কলসকাঠী বিএম একাডেমি প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার পাল, জেলা প্রশাসনের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ, বাকেরগঞ্জ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এইচ এম জাফর আহমেদ, কলসকাঠী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু তরুণ কুমার গাঙ্গুলী, বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল কলেজ অধ্যক্ষ এস এম জোবায়ের আলম পারভেজ, জনতা ব্যাংক কলসকাঠির শাখা ব্যবস্থাপক শাহানুর আজিজ, গ্রামীণ ব্যাংক অলংকার শাখা ব্যবস্থাপক ফজলুর রহমান।
আলোচকরা বলেন, আম উৎসব হতে পারে, ইলিশ উৎসব হতে পারে, কেন তাল উৎসব নয়? শ্রাবণের শেষ থেকে ভাদ্রের প্রথম ভাগে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে তালের নানা পদ হয়ে থাকে। সময়ের অভাবে সেই রেওয়াজ বন্ধ হওয়ার মুখে। বাচ্চারাও বোধহয় তাল কুড়িয়ে এখন আর ততটা মজা পায় না। নানা পদও হারাতে বসেছে।' সেই ভাবনা থেকেই কাজে লেগে পড়া।
গ্রামের অনামিকা চন্দ্র ও অনিমা রানী দাশ বলেন, 'সেরা পদ বানিয়ে নজর কাড়তে আমরা চেষ্টা করেছি। যাতে করে তালগাছ শুধু আমাদেরকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করবে না, খাদ্যও দিবে সেই তথ্য আমরা জানাতে চেয়েছি। আমরা সুযোগ পেলে তালপাতার সামগ্রী তৈরি শিখতে চাই।'
স্কুলের খুদে শিক্ষার্থীরা মেতেছিল তালপাতার পাখা তৈরিতে। সাজসজ্জার দায়িত্ব সামলাচ্ছিল স্কুলের ছেলেরা। তাদের নেতৃত্বে ছিল দীপ রাজ চন্দ। তাঁকে সহযোগিতা করেছে অভিজিৎ আইচ, দীপংকর পাল, পিয়াস কুণ্ডু, ফাহাদ, নাদীম, অর্পন, শীমান্ত ঘোষ, পার্থ চন্দ, শীমান্ত কুণ্ডু, তীথ চন্দ, রাতুল কুণ্ডু, অংশু, অর্ণব, সৌরভ, রুহিত প্রমুখ।