<p style="text-align:justify">প্রতিবছর শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রতিমা বিসর্জনের পরের দিন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী মিলন মেলা। কিন্তু এ বছর মেলাটি আরো একদিন পর উৎসব মুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো। এ মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ আসে। মেলায় আসা অধিকাংশ তরুণী তরুণদের নজর কাড়তে কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক ও চুলের বেণিতে গুঁজে দেয় ফুলের মালা। এতে পিছিয়ে থাকেন না তরুণরাও। মেলায় খুঁজে নেন তাদের পছন্দের জীবনসঙ্গী।</p> <p style="text-align:justify">মেলাটি অনেকের কাছে বাসিয়া হাটি নামেও পরিচিত। আজ মঙ্গলবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো আদিবাসী এই মিলন মেলা। এ মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের সমাগম হয়। বিশেষ করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার মানুষের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। মেলা উপলক্ষে দু-একদিন আগে থেকেই স্থানীয় আদিবাসী আন্তীয়-স্বজনদের বাসায় চলে আসে।</p> <p style="text-align:justify">স্থানীয়রা জানায়, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা এখান থেকে পছন্দের পাত্র-পাত্রী খুঁজে নিতে পারেন। এখানে কোনো পাত্র বা পাত্রী পছন্দ হলে পরিবারের আলোচনার মাধ্যমে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হয়। এই মেলায় অংশ নেওয়া অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। বিবাহযোগ্য পাত্রীরা পাত্রদের নজর কাড়তে নিজেকে মেলে ধরেন বাহারি পোশাক ও নানা সাজসজ্জায়।</p> <p style="text-align:justify">সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেলায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সব বয়সী নারী-পুরুষের ভিড়। বাহারি সব কাঁচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুক ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও খাবারের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। মেলার একপাশে ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের আসর। অন্যপাশে চলছে তরুণ-তরুণীদের জীবনসঙ্গী বাছাই।</p> <p style="text-align:justify">জেলার কাহারোল উপজেলা থেকে আসা সনাতন সরেন জানান, একটা সময় এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। এখন এই রীতিতে ভাটা পড়েছে।</p> <p style="text-align:justify">উপজেলার পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জোসেফ হাসদা জানান, সময়ের সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মান এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ আদিবাসী ছেলে-মেয়ে এখন স্কুলমুখী হয়েছে। কালের বিবর্তনে পুরোনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে।</p> <p style="text-align:justify">মেলা আয়োজক কমিটি বীরগঞ্জ থানা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সহ-সভাপতি এডয়ার্ড হেমরম জানান, গোলাগঞ্জ আদিবাসী মিলন মেলাটি ২০০ বছর পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে। মেলাটি প্রতিমা বিসর্জনের বিজয়া দশমীর পরের দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসী ছেলেমেয়েসহ নানা বয়সের মানুষজন আসেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা তাদের আপন সঙ্গীকে চিহ্নিত করতে এবং পরবর্তীতে এটি সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। </p> <p style="text-align:justify">তিনি জানান, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এই মেলা চলমান। আমরা শুধু তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে, সেটি সঠিকভাবে বলা যাবে না। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি দুইশত বছর ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।</p> <p style="text-align:justify">নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান আনিস জানান, গোলাপগঞ্জ আদিবাসী মিলনমেলাটি দুইশত বছর আগে থেকে ঐতিহ্যবাহী মেলা। এ মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের মানুষ আসেন। এই মেলায় প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজনের সমাগম ঘটে। আমরা সকলের সহযোগিতা নিয়ে মেলার কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকি। আশা করি কোনো ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়াই মেলার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।</p> <p style="text-align:justify">প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সদস্য আলহাজ্ব মনজুরুল ইসলাম মনজু বলেন, এই মেলাটি আমাদের পূর্বপুরুষের আমল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মেলাকে ঘিরে সব আয়োজন এই বেশ নন্দিত হয়েছে। দেশবাসীর কাছে আমাদের আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য কৃষ্টি-কালচার পরিচিতি লাভ করেছে। তবে এ বছর আর্থিক সংকটের কারণে এ মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। </p>