নকশী পিঠা ছাড়াও নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা বানানোয় ব্যস্ত সময় পার করছেন ময়মনসিংহের নান্দাইলের মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের কালেঙ্গা গ্রামের নারীরা। ঈদের দিন সকালে অতিথি আপ্যায়নে কিংবা আত্মী-স্বজনের বাড়িতে ঈদ উপহার হিসেবে নকশী পিঠার জুরী নেই। কিন্তু শখের বশে নকশী পিঠা বানিয়ে যে সফল হওয়া যায় তা জানা ছিল না। তবে এমনটিই হয়েছেন ওই গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে তরিকুল ইসলাম রনি।
রনি এখন এই পিঠা স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছেন। তিনি মাসে আয় করছেন প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা। এখন আর চাকরি খুঁজেন না রনি।
কালেঙ্গা গ্রামের আশরাফ মাস্টারের পুরাতন বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিনের ন্যায় ভোর থেকেই হান্নানের বাড়ির একটি ঘরের বারান্দায় বসে কাজ করছেন ২৫ জন নারী।
তারা সবাই রনির পরিবার পরিজন ছাড়াও প্রতিবেশী। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বেষ্টিত হয়ে তারা কাজ করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন স্বামী পরিত্যক্তা, অসহায় ও বিধবা নারীরা। রনি ওই পিঠা বাজারজাত জন্য বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করলেও ছোট বোন সাদিয়া আফরিন সনি ও মা সেলিনা আক্তার পিঠা বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন।
সনি পিঠা বানানোর কাজে নিয়োজিত নারীদের দেখভাল করেন। দেখা যায়, কেউ নকশী পিঠা, কেউ হাতে কাটা সেমাই, কেউ বাবুই ঝাঁক পিঠা বানাচ্ছে আবার কেউ এগুলো রোদে শুকাচ্ছে। এসব পিঠার মধ্যে অন্যতম হলো নকশী পিঠা, জামাই পিঠা, ঝর্ণা পিঠা, সিরিজ পিঠা, বাবুই ঝাঁক পিঠা, পয়সা পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, সাবুদানা পিঠা, পাতা পিঠা, ঝিনুক পিঠা।
বারান্দায় বসে কমপক্ষে ২০ জন কাজ করছেন। তাদের সবার সামনেই রয়েছে পিঠা বানানোর সরঞ্জামসহ একটি পিড়া।
ওই পিড়ার মধ্যেই কাই (চালের গুঁড়া পানি দিয়ে) নিয়ে নরম করে এতে প্রয়োজনীয় তেল ব্যবহার করে গোলাকৃতি করে খেজুরের কাঁটা ও টিনের তৈরি নকশা দিয়ে পিঠার নকশী করছেন তারা।
সনি জানান, প্রতি কেজিতে ৩০টি পিঠা থাকে। আর এক কেজি ১২০ টাকা দরে দোকানে দেওয়া হয়। দোকানদার এইগুলি ১৫০-১৬০ টাকা বিক্রি করেন।
সনি বলেন, 'নকশী পিঠা, সিরিঞ্জ পিঠা, ঝিনুক পিঠা, পয়সা পিঠা, এগুলো আমাদের গ্রামীণ ইতিহাসের অংশ। এগুলো ছাড়া আমাদের ঈদ আনন্দ জমে উঠে না।'
তিনি আরো বলেন, 'দলবেঁধে বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করি। এসব পিঠা তৈরি করতে চালের গুঁড়া, বেলুনি, পিঁড়ি, কাটার, খেজুর কাঁটা অথবা সুঁই, তেল, কলাপাতা, রং ইত্যাদি লাগে। পরে কাঁচা পিঠা রোদে শুকানো হয়। পরে প্যাকেটজাত করে বাজারে পাঠানো হয়। অনেকে পিঠা বাড়ি থেকেই নিয়ে যায়।'
প্রতিদিন ১০০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করছেন মনু, সাবিনা, মালা, সুফিয়া ও রিপাসহ অনেকেই। তারা জানান, ভোর থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত কাজ করে পরে নিজের সংসারের কাজ করা যায়। এতে বাড়তি একটা আয় হয়। যা দিয়ে সংসারের অনেক সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
রনি বলেন, 'হারানো দেশীয় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। চাকরি না পেয়ে বিকল্প কিছু করার জন্য স্ত্রী অনুপমা ইসলাম হিমুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে মা-বোন ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাই। সেখানে ব্যাপক চাহিদা বুঝতে পেরে এখন নকশী পিঠার ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এতো সেল হবে আমি কখনো ভাবিনি। এই পিঠা বিক্রি করে আমার প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়।'
রনি বলেন, কোনো ব্যাংক থেকে বিনাসুদে ঋণ পেলে এই পিঠার কারখানা আরো বিস্তর করা যাবে। এতে অনেকেই কাজ করার সুযোগ পাবে।
স্থানীয় সৈয়দ গ্রাম চন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং নারী উদ্যোক্তা সাহিদা ইয়াসমিন বলেন, 'এই গ্রামের ঘরোয়া মেয়ে ও গৃহবধূরা পিঠা নিয়ে কাজ বেশি করছে। আলহামদুলিল্লাহ এতে ঘরে বসেই তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে, সমাজের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাদের জীবনমানও উন্নত হচ্ছে।'
তিনি আরো বলেন, 'পিঠাগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশীয় ঐতিহ্য সমাজে তুলে ধরছে। আমাদের প্রাম বাংলার নারীরা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও পিঠা রপ্তানি করবে ইনশাআল্লাহ।'