বরিশাল নগরে শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মো. সুজন (২৩) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার করা হয়েছে। তবে তার পরিবারের দাবি, মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকতে চায়নি বলে বলে তাকে হত্যা করেন মাদক ব্যবসায়ীরা।
শনিবার সন্ধ্যায় নগরের ধান গবেষণা রোডে সুজনকে আটক করে পিটুনি দেয় স্থানীয়রা। রাত ৮টার দিকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান তিনি।
তাকে পিটুনি দেওয়ার ঘটনায় বাঁধন নামের এক যুবককে রবিবার আটক করেছে পুলিশ।
সুজনের পরিবারের সদস্যরা বলছে, ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ মিথ্যা, এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ে সুজনকে পরিকল্পিতভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় তারা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
সুজন নগরের ধান গবেষণা রোড এলাকার জিয়া নগরের একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন।
তার বাবা মনির হোসেন পেশায় একজন শ্রমিক। রবিবার তার লাশ দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ কোতয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছে। তবে এজাহারে কারো নাম উল্লেখ্য করা হয়নি।
কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, যারা সুজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তদন্তকালে তাদের নাম উঠে আসবে। এই ঘটনার বেশকিছু ভিডিও ফুটেজ এবং স্থিরচিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
এদিকে সুজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করে ভুক্তভোগীর বাবা শনিবার বরিশাল কোতোয়ালি থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে তার মেয়েকে একটি কাজে সুজনের বাড়িতে পাঠানো হয়। তখন সুজন একা বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
ওই শিশু ভেতরে প্রবেশ করতেই তাকে আটকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন সুজন। এ সময় শিশুটি চিৎকার দিলে সুজন পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে স্থানীয় মালেক মুন্সির ছেলে রুবেল, বাচ্চু দুরানীর ছেলে ছাব্বির, বিএনপি কর্মী কাউয়ুম হোসেন, মাদক ব্যবসায়ী ঈমন, মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে বাঁধনসহ বেশকিছু লোক জিয়ানগর চরে জড়ো হন। এক পর্যায়ে তারা সুজনকে বাড়ি থেকে ধরে এনে কীর্তনখোলা তীরের সেই চরের একটি গাছের সঙ্গে দুই হাত বেঁধে ফেলেন। পরে পালা করে লাঠি দিয়ে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত পেটাতে থাকেন তারা।
পিটুনির ফলে সুজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সন্ধ্যার দিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। একইসঙ্গে সুজনের বিরুদ্ধে চার বছরের শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে থানায় এজাহার দেওয়া হয়। পুলিশের নির্দেশনা অনুযায়ী একই সঙ্গে শিশুকে বরিশাল-শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টাফ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। সুজনকে সন্ধ্যার পর বরিশাল-শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। চিকিৎসাধীন রাত ৮টার দিকে সুজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
সুজনের ছোট ভাই মো. আকাশ রাতে হাসপাতালে বলেন, সুজনকে দিয়ে এলাকার একটি মাদক ব্যবসায়ীচক্র মাদক বিক্রি করাতো। সুজনও মাদকাসক্ত ছিলেন। মাসখানেক আগে স্বজনদের পক্ষ থেকে সুজনকে মাদক বিক্রি ও সেবন না করতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। এমনকি তাকে ঘর থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দেয় পরিবার। এরপর সুজনকে ওই চক্র বারবার তাদের সঙ্গে কাজে যেতে তাগিদ দিলেও সুজন আর যাননি। এতে ক্ষিপ্ত হয় ওই চক্রটি।
আকাশের দাবি, কয়েক দিন আগে তার ভাইকে বাইরে ডেকে নিয়ে ওই চক্রের সদস্যরা মারধর করেছিল এবং তাদের সঙ্গে কাজ না করলে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এর জেরেই মিথ্যা অভিযোগ তুলে তার ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।
সুজনের মা বলেন, শুক্রবার ঘটনার পর বাচ্চু দুরানী তার বাসায় গিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছিলেন। তিনি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় বাচ্চু ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিলেন, ধর্ষক সুজনকে মানুষ পিটিয়ে মারবে।
সুজনের মায়ের দাবি, বাচ্চুর নেতৃত্বেই তার লোকজন সুজনকে বাঁচতে দেয়নি, পিটিয়েই মেরে ফেলেছে।
এই মারধরের সঙ্গে তার ছেলে ছাব্বির জড়িত ছিল না বলে দাবি করে বাচ্চু দুরানী মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, শনিবার দুপুর ৩টার দিকে সুজনের মা তার বাড়িতে এসেছিলেন। ছেলেকে মামলা থেকে মুক্ত করার জন্য তার সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। তিনি সুজনের মাকে বলেছিলেন, এটা মীমাংসা যোগ্য মামলা নয়। আদালত এটার সিদ্ধান্ত দেবে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে সুজনকে মারধরের খবর শুনতে পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনিই সুজনকে উদ্ধার করে থানায় পাঠান।
পুলিশ জানায়, ধর্ষণচেষ্টার শিকার শিশুটির বাবার অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ তদন্ত করতে ওই এলাকায় যায়। পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে স্থানীয় লোকজন সুজনকে আটক করে। এ সময় উত্তেজিত লোকজন তাকে পিটুনি দিলে সুজন আহত হন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। রাত ৮টার দিকে চিকিৎসাধীন মারা যান তিনি।
হাসপাতালে থাকা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মানিক সাহা বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তার পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে সুজনের সারা শরীরে মারধরের ক্ষত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তারা। মারধরের কারণেই সুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিক ধারণা।
ওসি মিজানুর রহমান বলেন, শিশুটির বাবার করা অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। শিশুটি ওসিসিতে রয়েছে। অন্যদিকে পিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুজনের পরিবার থেকে এজাহার দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া বাঁধনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আরো যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের অন্তত চারজনকে শনাক্ত কর গেছে। তাদেরকেও গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ মাঠে রয়েছে।