যে মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে, এমন সময়েই ক্যাম্পে নতুন করে ঘর ( রোহিঙ্গা শেড) নির্মাণের কাজও চলছে। ক্যাম্পে নতুন ঘর নির্মাণের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়ে আবারও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। নতুন আবাসনের ব্যবস্থায় একদিকে স্থানীয় এলাকাবাসী যেমন ক্ষোভে ফুঁসছে, তেমনি প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
নতুন ঘর নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বাসিন্দারা।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী উপজেলা দুটির সাত লক্ষাধিক বাসিন্দা এমনিতেই সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংখ্যালঘু হিসেবে নানা দুর্ভোগে বসবাস করে আসছেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের দাবি নিয়ে প্রায়ই স্থানীয়রা নানা কর্মসূচি নিয়ে রয়েছেন সোচ্চার। এমন সময়ে নতুন ঘরের ব্যাপারটি লোকেমুখে চাওর হয়ে পড়েছে।
নতুন ঘর নির্মাণের বিষয়টি আরো বেশি আলোচনায় এসেছে এর সুনির্দিষ্ট কারণ না জানানোর জন্য।
এমনকি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন।
'সওয়ার' নামের যে এনজিওটি ক্যাম্পে নতুন ঘর নির্মাণের কাজ করছে তারা বলছে, পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য এগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গা শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার- আরআরআরসি সংবাদকর্মীদের বলেছেন, 'নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্যই নতুন ঘর।'
আবার গতকাল সকালে অতিরিক্ত আরআরআরসি মো শামসুদ দৌজা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন ভিন্ন কথা।
তিনি বলেন, 'যা করা হচ্ছে তা কাঁটাতার দেওয়া বনভুমি ক্যাম্প এরিয়ায়। তাও সম্ভবত অনেক আগের টেন্ডারের কাজ এগুলো।' তবে কি জন্য ঘরগুলো করা হচ্ছে তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
এদিকে স্থানীয় লোকজন বলছেন, 'গত কয়েক মাসে প্রচুর রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তাদের জন্য এসব করা হচ্ছে।
'
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন শেড নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ও উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ক্যাম্পে নতুন করে আবাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আবার পিছুটান পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এমনকি প্রত্যাবাসনের পুরো ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হতে পারে বিভ্রান্তি।'
তিনি বলেন, 'যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিয়ে ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন এবং মায়ানমার সরকারও এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরানোর বিষয়ে ইতিবাচক, সেখানে নতুন করে শেড নির্মাণের আর কোনো দরকার থাকার কথা নয়।'
উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরোয়ার জাহান চৌধুরী ক্যাম্পে নতুন শেড নির্মাণের ঘটনাটিকে 'প্রত্যাবাসন বিরোধি' কাজ কিনা তা সরকারি ভাবে খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'কোনো কোনো মহল সরকারের প্রত্যাবাসন ভণ্ডুল করতে নানা কৌশল এঁটে চলেছে।'
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর কক্সবাজার জেলা শাখার আমির মাওলানা নূর আহমদ আনোয়ারী বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ মুহূর্তে ক্যাম্পে নতুন ঘর নির্মাণের ফলে প্রত্যাবাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে ব্যহত করবে। সেই সাথে আমরা শঙ্কিত, মায়ানমার থেকে নতুন করে আরো রোহিঙ্গা এপারে পাড়ি দিতেও উৎসাহিত হতে পারে।'
তিনি বলেন, 'আর কোনো ভাবেই বিলম্ব নয়, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।'
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৪ নম্বর হাকিম পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতারের সঙ্গে লাগোয়া বন বিভাগের পাহাড়ে চলছে এই নতুন করে ১২২টির অধিক শেড নির্মাণের কাজ। শেডগুলো নির্মাণ ঘিরে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয় লোকজন বনবিভাগের সঙ্গে শেয়ারের ভিত্তিতে সেখানে সামাজিক বনায়ন করেছিল। রোহিঙ্গা ঢলের সময় (২০১৭) কিছু বনভূমিতে শেড নির্মিত হয়েছিল। বাদবাকি বনভূমিতে গাছপালা ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দা নূরুল আবসার নামের সামাজিক বনায়নের একজন উপকারভোগি কালের কণ্ঠকে জানান, 'যেখানে এখন শেডগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে সেটি ২০০৮ সালের সৃজিত বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের জায়গা। সেখানে জলাধারও ছিল। উক্ত জলাধার ভরাট করে ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। শেডগুলো তৈরি করছে ' সাওয়াব' নামের একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। দেড়শ রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য এগুলো নির্মাণে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।' এসব বিষয় নিয়ে লিখিতভাবে উপকারভোগিরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী আকস্মিক রোহিঙ্গা শেড নির্মাণের বিষয়টিকে 'সন্দেহের' চোখে দেখছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি এলাকার একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। অথচ আমাকেও না জানিয়ে রাতারাতি পাহাড় ও শত শত গাছ কেটে এনজিওটি শেডগুলো নির্মাণ করছে।'
তিনি বলেন, 'সরকারি পাহাড়ে এনজিওটি গাছপালা ও পাহাড় কেটে শেড তৈরির পাশাপাশি সেখানে 'আমিনা ভিলেজ' লিখে একটি সাইনবোর্ডও টাঙ্গিয়েছে। জমির মালিক বন বিভাগ আর সেখানে নামকরণ হচ্ছে 'আমিনা ভিলেজ' নামে- এ টনাটি রিতীমত রহস্যময় বলেও জানান ইউপি চেয়ারম্যান।
সওয়াব নামের এনজিওটির কো-অর্ডিনেটর আতাউল্লাহ বলেন, 'যথারীতি রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে শেডগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। পাহাড় ও গাছ কাটার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি সাইনবোর্ড প্রসঙ্গে বলেন, কোনো একজনের দানের টাকায় কাজ করার কারণেই এটি লাগানো হয়েছে। তবে অনুমতি রয়েছে কিনা তা জানাননি তিনি।'