<p>ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বিনি শিক্ষাধারা ‘দরসে নিজামি’র বাইরে যে শিক্ষাক্রম দ্বিনি শিক্ষার বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে তা হলো আলিয়া মাদরাসা। ব্রিটিশ সরকারের আনুকূল্যে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রায় আড়াই শ বছর ধরে এই শিক্ষাক্রম ইসলামী শিক্ষার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।</p> <p>বিশেষত অখণ্ড বাংলা, বিহার ও আসাম অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা অর্জনের অন্যতম অবলম্বন আলিয়া মাদরাসা। আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তার বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন মোল্লা মাজদুদ্দিন আল-মাদানি। তিনি মোল্লা মদন নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মাদরাসা-ই-আলিয়া কলকাতার প্রথম পরিচালক ও হেড মাওলানা। সমকালীন আলেমরা তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য ‘বাহরুল উলুম’ (বিদ্যাসাগর) উপাধি দেন।</p> <p>জন্ম ও বেড়ে ওঠা : মোল্লা মাজদুদ্দিন ১৮ শতকে উত্তর ভারতের বেরেলি অঞ্চলের শাহজাহানপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম তাহির আল-হুসাইনি। হারদুইয়ের প্রখ্যাত আলেম শায়খ ওয়াহহাজ্জুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে তিনি লেখাপড়া করেন। ‘ইমামুল হিন্দ’ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.)-এর শিষ্য ছিলেন। তিনি দরসে নিজামি অনুসারে পাঠ গ্রহণ করেন এবং সমকালীন পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। বিশেষত ফিকহে ইসলাম বা ইসলামী আইনশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।</p> <p>শিক্ষক হিসেবে সাফল্য : ১৭৭৬ সাল থেকে মোল্লা মাজদুদ্দিন কলকাতায় অবস্থান করতেন। তাঁর কলকাতার বাড়িতেই তিনি দরসে নিজামির শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠ দান করতেন। তাঁর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের গভীরতা ছিল অপরিসীম। ফলে অল্প দিনেই তিনি সুখ্যাতি লাভ করেন। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে পাঠ গ্রহণ করতে হাজির হতো। তাঁর পাণ্ডিত্য ও সাবলীল পাঠদান পদ্ধতির কারণে কলকাতার নেতৃস্থানীয় মুসলিমরাও তাঁর গুণগ্রাহীতে পরিণত হন।</p> <p>মুসলিম নেতাদের অনুরোধ : তাঁরাই লর্ড হেস্টিংসের সঙ্গে দেখা করে মোল্লা মাজদুদ্দিনের নেতৃত্বে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেন। ৭ জুন ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অব ডিরেক্টরসের কাছে পেশকৃত বিবরণে লর্ড হেস্টিংস বলেন, ‘১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলমানদের একটি প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং আমাকে অনুরোধ করে যে প্রেসিডেন্সিতে মোল্লা মাজদুদ্দিন নামক জনৈক ব্যক্তিকে কলকাতায় স্থায়ীভাবে রাখতে আমি যেন সচেষ্ট হই, যাতে স্থানীয় মুসলিম শিক্ষার্থীরা প্রচলিত ইসলামী বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে। প্রতিনিধিদল আমাকে অবহিত করে যে এই ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগাধ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন। এই ধরনের গুণী লোক সচরাচর পাওয়া যায় না। ’</p> <p>আলিয়া মাদরাসার গোড়াপত্তনে  অবদান : মোল্লা মাজদুদ্দিনই আলিয়া মাদরাসার প্রথম পাঠক্রম প্রণয়ন করেন। তিনি প্রচলিত ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেন এবং এর সঙ্গে গণিত, যুুক্তিবিদ্যা ও দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর বাড়িতেই মাদরাসা-ই-আলিয়া কলকাতার প্রথম সাত মাসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাদরাসাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। বরেণ্য এই আলেমের ত্যাগ ও প্রচেষ্টার বিবরণও লর্ড হেস্টিংসের বর্ণনায় এসেছে। তিনি লেখেন, ‘আমি উক্ত মোল্লা মাজদুদ্দিনকে ডেকে পাঠাই এবং জিজ্ঞাসা করি যে মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না। তিনি আমার কথায় সম্মত হলেন এবং ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রস্তাবিত মাদরাসার জন্য কার্যক্রম শুরু করে দিলেন। এই ব্যক্তি সত্যি এই মাদরাসার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং তাঁর সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা অক্ষুণ্ন রাখেন। ’</p> <p>শেষ জীবন : ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসা মহালের সম্পত্তির আয়ের ধারা অক্ষুণ্ন রাখতে না পারা এবং ছাত্রদের বিশৃঙ্খলা রোধে ব্যর্থতার অভিযোগে মোল্লা মাজদুদ্দিনকে পদচ্যুত করা হয়। এরপর লখনউয়ের নবাব দ্বিতীয় সাআদাদ আলী খান তাঁকে কাজি (বিচারক) পদে নিযুক্ত করেন। কিছুদিন বিচারকের দায়িত্ব পালন করার পর তিনি বেরেলিতে ফিরে যান এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রের পাঠদানে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।</p> <p><em>তথ্যঋণ : বই : আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, প্রবন্ধ : Establishment of Calcutta Madrasah বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া</em></p>