<p>অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের করা আবেদন নাকচ করে দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রবিবার (২৩ জুন) বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু তিনি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হননি। তবে গত বৃহস্পতিবার আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে অব্যাহতি আবেদন করেছিলেন যা নাকচ করা হয়েছে। সেখানে তিনি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে এ পর্যন্ত ক্রোক ও ফ্রিজ করা সম্পদ সম্পূর্ণ বৈধ বলে দাবি করেন।</p> <p>এ অবস্থায় দুবার সময় দেওয়ার পরও দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে সরাসরি হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে যে আবেদন করেছেন, তা নাকচ করে দিয়েছে কমিশন। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেনজীর প্রথম থেকেই দুদককে এড়ানোর চেষ্টা করছেন। প্রথম দফায় গত ৬ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে তলব করা হয়। নির্ধারিত সময়ে তিনি হাজির না হয়ে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। তাতে তিনি বেনজীরের অব্যাহতি আবেদন নাকচজিজ্ঞাসাবাদে হাজির হওয়ার জন্য সময় চাননি। উল্টো অভিযোগের বিষয়ে তাঁর লিখিত বক্তব্য রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। সেই লিখিত বক্তব্য জমা দিতে দুই মাস সময়ের আবেদন করেন। আর এবার তিনি তাঁর লিখিত বক্তব্য দাখিল করে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছেন। কমিশন অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির না হয়ে বেনজীর মূলত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হাতছাড়া করলেন।’</p> <p>এদিকে গতকাল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আজ (গতকাল) দিন ধার্য ছিল। তিনি যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়ায় অনুসন্ধান টিম আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আগামীকাল (আজ সোমবার) তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুসন্ধান টিম নোটিশ দিয়েছে। তাঁরাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপস্থিত না হলে তাঁদের বিষয়েও অনুসন্ধান টিম আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ দুই দিন আগে আইনজীবীর মাধ্যমে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এবার নতুন করে সময়ের আবেদন করেননি। লিখিত বক্তব্যে তিনি তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী- কন্যাদের অর্জন করা সম্পদের বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন, তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।’</p> <p>দুদক সচিব বলেন, ‘অনুসন্ধানকারী দলের কাছে অনুসন্ধান রিপোর্ট দাখিলের জন্য এখনো সময় আছে। অনুসন্ধান রিপোর্টে এসব বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া থাকবে। কমিশন রিপোর্ট দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’</p> <p><strong>একাধিক মামলার প্রস্তুতি</strong><br /> প্রথম দফার পর দ্বিতীয় দফায়ও দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির না হয়ে বেনজীর আহমেদ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে আর সময় দেওয়া হবে না বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য দুদক আইনে সময় চেয়ে দ্বিতীয়বার আবেদন করার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই তাঁর ঠিকানায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠানো হবে। এরপর ২১ কর্মদিবস এবং পরে সময়ের আবেদন করলে আরো ১৫ কর্মদিবস সময় পাবেন তিনি। তবে বিদেশে অবস্থান করায় বেনজীর যেমন দুদকের নোটিশ গ্রহণ করতে পারবেন না, তেমনি দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিলও করতে ব্যর্থ হবেন। সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে দুটি মামলা হবে। দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার জন্য হবে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা, আর বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের যেসব অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে আরেকটি ‘অবৈধ (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত) সম্পদ অর্জনের’ মামলা হবে। কমিশনের অনুসন্ধানকারী দল তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদক আইনে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর এবং নন-সাবমিশন মামলায় তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে।</p> <p><strong>বেনজীর পর্তুগালে, পরিবার দুবাইয়ে</strong><br /> গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পরপরই স্ত্রীর চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমায় বেনজীর ও তাঁর পরিবার। সেখান থেকে তাঁরা ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের অধীনে বেনজীরের কেনা মালয়েশিয়ার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর মালয়েশিয়া থেকে সপরিবারে চলে যান দুবাই। সেখানে পরিবারের সদস্যদের রেখে তিনি পর্তুগালে পাড়ি জমান বলে জানা গেছে।</p> <p><strong>সপরিবারে দুদকে তলব</strong><br /> গত ২৮ মে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাঁদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে ৬ জুন বেনজীর আহমেদ এবং ৯ জুন তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির থাকতে বলা হয়। আরেক মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি। তবে প্রথম দফায় দুদকের ডাকে হাজির হননি বেনজীর আহমেদ। দ্বিতীয় দফায় ২৩ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ফের দুদকে তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায়ও তিনি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হননি। অন্যদিকে বেনজীরের স্ত্রী ও দুই মেয়েকে আজ সোমবার (২৪ জুন) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে। তবে দুবাইয়ে অবস্থান করায় তাঁরাও জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হচ্ছেন না বলে জানা গেছে।</p> <p><strong>বেনজীরের সম্পদ জব্দে হ্যাটট্রিক</strong><br /> দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত তিন দফায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত। সর্বশেষ তৃতীয় দফায় গত ১২ জুন বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা আরো আটটি ফ্ল্যাট এবং ২৫ একর (৬০.৫ কাঠা) ২৭ কাঠা জমি জব্দের (ক্রোক) আদেশ দেন আদালত। এই ফ্ল্যাটগুলোর অবস্থান রাজধানীর বাড্ডা ও আদাবরে। জমি নারায়ণগঞ্জ, বান্দরবান ও উত্তরায়। একই সঙ্গে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বেসরকারি সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশও দিয়েছেন আদালত।</p> <p>দ্বিতীয় দফায় গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের আদেশ দেন। সাভারের কিছু জমিও রয়েছে একই আদেশের আওতায়।</p> <p>আর প্রথম দফায় গত ২৪ মে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), চারটি ক্রেডিট কার্ড ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ দেন।</p> <p><img alt="1" height="226" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/24-06-2024/890-00-.jpg" width="400" /></p> <p><strong>বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু যেভাবে</strong><br /> সর্বপ্রথম কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এরপরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।</p> <p>বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাঁদের মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।</p>