ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, অকালমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দেশে প্রায় ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলে। মাদকের কারণে সার্বিকভাবে কী পরিমাণ অপরাধ ঘটছে, তার কোনো একক জরিপ না থাকলেও মাদকদ্রব্য জব্দ ও আসামি গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান বলছে, মাদকের বিস্তার দিন দিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে এবং প্রতিনিয়িত দেখা যাচ্ছে মাদকসংশ্লিষ্টতার কারণে ঘটছে চাঞ্চল্যকর অপরাধ। মাদকাসক্ত অনেকে নেশার টাকা না পেয়ে পরিবারের সদস্যদেরও খুন করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি পরিবারে একজন সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে সেই পরিবারে নেমে আসে বিভীষিকাময় পরিবেশ। মাদককে ঘিরে যেসব সমস্যা তৈরি হয় তা একটি পরিবারকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। তছনছ হয়ে পড়ে সাজানো সংসার। মাদক সমস্যা পারিবার থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমাজে। শেষ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়।
লেখক ও মনোচিকিৎসক এম এ মোহিত কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মনে করি, মাদক হচ্ছে মস্তিষ্কের রাসায়নিক দানব। কোনো কোনো মাদক ব্রেইনে ঢুকে এক বছর পর্যন্ত অ্যাক্টিভ ফর্মে থাকে এবং চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি সব নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ন্ত্রণ সুশৃঙ্খল থাকে না, বিশৃঙ্খল করে দেয়। ব্যক্তি সহিংস হয়ে পড়ে, নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে মাদকাসক্তরা রাগের বশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খুনখারাবিও করতে দ্বিধা করে না। মা-বাবার মুখে বালিশ চাপা দিতে পারে, তাদের ওপর ছুরি-বঁটি চালাতে পারে। সাধারণ মানুষ এসব কর্ম করতে পারে না। অনেকে বলেন, আমার সন্তান এমন (বিশৃঙ্খল আচরণ) করছে, তার ভেতর দানব ঢুকে গেছে, সেটা বের করে দেন। এই সমস্যা বর্তমানে অনেক পরিবারেই রয়েছে।’
এই মনোচিকিৎসক আরো বলেন, ‘কোথাও কোথাও দেখা যায় মাদকাসক্তরা পুলিশের ওপর হামলা করছে। সুতরাং সবাইকে এর প্রতিরোধে, প্রতিকারে এগিয়ে আসতে হবে এবং আইনের সুরক্ষা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সার্বিক অপরাধ কমে আসবে।’
ঢাকার মানসিক ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রের মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর নুসরাত সাবরিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশির ভাগ পরিবার মাদকসেবীর কথা চেপে রাখে। এ নিয়ে কারো সঙ্গে বলতে চায় না বা চিকিৎসার প্রয়োজন মনে করে না। এভাবেও কিন্তু মাদকসেবী দিন দিন বাড়ছে।’
সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ড : গত ১৪ মার্চ টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহিষমারা ইউনিয়নে নেশার টাকা না দেওয়ায় মাদকাসক্ত ছেলে রাজিবের হাতে মা রেজিয়া খাতুন (৫০) খুন হন। ৮ মার্চ যশোর জেলায় পারিবারিক কলহের জেরে শরিফুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে খুন করেন তাঁর মাদকাসক্ত ছেলে মো. রমেন (২১)। ৪ মার্চ রংপুরের মিঠাপুকুরে মাদকাসক্ত ছোট ভাই শরিফুল ইসলামের (৪০) হাতে বড় ভাই আতিয়ার রহমানের (৫৫) মৃত্যু হয়। ৬ মার্চ খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বেলছড়িতে বাবা আব্দুর রহিম (৭০) এবং মা আমেনা বেগমকে (৬০) কুপিয়ে জখম করেন মাদকাসক্ত ছেলে আবুল কালাম (৩৮)।
এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার শহরতলির জগন্নাথপুর গ্রামে সাত বছর বয়সী ছেলে মাহিদকে মারধর করে হত্যা করেন মাদকাসক্ত বাবা খোকন মিয়া।
গত ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে মাদক সেবনের টাকা না দেওয়ায় ছেলে রিফাত (১৮) তাঁর বাবা শফিকুল ইসলামকে (৪৫) ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। এ ছাড়া ১ ডিসেম্বর মাগুরার আঠারোখাদা গ্রামে চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেয়ে মাদকাসক্ত ছেলে মো. মফিজুর তাঁর বাবাকে ছুরিকাঘাত করেন। এতে বাবা সুরমান শেখের মৃত্যু হয়।
মনোচিকিৎসকরা বলছেন, মাদক সেবনে শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার ক্ষতি হয়। নিয়মিত মাদক সেবনে ব্যক্তির সুস্থ চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পায়। এ কারণে কোনো ঘটনা, পরিস্থিতি কিংবা কোনো বিষয়ে সঠিক বিচার-বিবেচনা, মূল্যায়ন এবং অনুধাবন করার ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে না। এরই পরিণামে সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদকসেবীদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। তাদের অনেকের মধ্যে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে তারা মাদক সেবনের টাকা সংগ্রহ করতে পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা কিংবা ছিনতাইকালে সামান্য টাকার জন্য খুনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের একাংশ মাদক সেবনের টাকা জোগাড়ে চুরি-ছিনতাইসহ খুনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যও বলছে, খুন, ধর্ষণ, পরকীয়া, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সব কিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা।
মাদকে শারীরিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের কর্মকর্তারা জানান, পুরনো মাদকের পাশাপাশি নতুন অনেক মাদকও দেশে আসছে। নতুন মাদকের মধ্যে আইস সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভারের জটিলতা হতে পারে। এভাবে প্রতিটি মাদকই মানবদেহের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ।
মাদক নিরাময় কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা। এ ছাড়া পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, বিবাহবিচ্ছেদে সংসার ভেঙে যাওয়া, প্রেম ও চাকরিতে ব্যর্থতা থেকে হতাশা ইত্যাদি কারণেও যুবসমাজ মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। এভাবে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক পৌঁছে গেছে অনেক আগ থেকেই। বেশির ভাগ মাদক ব্যবহারকারী বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়াকে দোষারোপ করে। প্রথমবারের মতো মাদক গ্রহণের জন্য কৌতূহল অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।
এদিকে বিভিন্ন এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চললেও অভিযান চালানো হয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ফলে দেশে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপদ মাদক গ্রহণের স্থানে পরিণত হচ্ছে বলে জনপরিসরে আলোচনা আছে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। মাদকের এই নীল দংশন থেকে যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। এতে সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া দেশে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে মাদকের সরবরাহ চেইন বন্ধ করতে চোরাচালানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।