স্কুল, হাসপাতাল এবং দোকান পুনর্নির্মাণ করতে হবে।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফও বলেছেন, এতে বছরের পর বছর সময় লাগতে পারে এবং এটি চলতে থাকলে ফিলিস্তিনিদের কোথাও যেতে হবে। ট্রাম্পের বিশ্বাস, ফিলিস্তিনিদের অনুপস্থিতিতে আমেরিকান মালিকানাধীন ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ সেই যুদ্ধের ছাই থেকে উঠে আসবে এবং হাজার হাজার কর্মসংস্থান, বিনিয়োগের সুযোগ এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বের মানুষের বসবাসের জন্য একটি জায়গা হয়ে উঠবে গাজা।
ট্রাম্পের মন্তব্য এত বিতর্কিত কেন?
ট্রাম্প এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যে তার প্রথম মেয়াদের বেশির ভাগ সময় মার্কিন মধ্যপ্রাচ্যনীতিকে উল্টে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর এবং অধিকৃত গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া।
কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কখনো ভাবেননি যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাত সমাধানের জন্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের একটি অংশ দখল করতে হবে এবং সেখানকার জনগণকে উচ্ছেদ করতে হবে। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, বলপ্রয়োগ করে এটি করা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হবে।
এ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কিছু ফিলিস্তিনি সম্ভবত গাজা ছেড়ে অন্যত্র তাদের জীবন গোছানোর বিষয়টি মেনে নেবেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি ইতিমধ্যেই এটি করেছে। কিন্তু অন্যরা তা চিন্তাও করতে পারবে না। কারণ তাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই অথবা গাজার প্রতি তাদের ভালোবাসা, যে ভূখণ্ডটাকে তারা ফিলিস্তিন বলে এবং সেই অনুভূতি খুব বেশি শক্তিশালী।
গাজার বাসিন্দার মধ্যে রয়েছেন ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় পালিয়ে যাওয়া অথবা তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়া লোকদের বংশধর। ফিলিস্তিনিরা ওই ঘটনাকে বা সময়কালকে ‘নাকবা’ (যার আরবি অর্থ বিপর্যয়) বলে। তাদের কাছে অন্য বিকল্পের কথা ভাবা প্রচণ্ড বেদনাদায়ক। তারা চাইবে গাজার অবশিষ্টাংশে তাদের ক্ষুদ্র জীবনকে তীব্র দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকড়ে ধরতে। যারা ইসরায়েলের মতো তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য এর কিছু অংশ হারানো অঙ্গচ্ছেদের মতো।
১৯৪৮ সাল থেকে গাজা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। ট্রাম্পের ২০২০ সালের ‘ভিশন ফর পিস’ টানেল বা রেলপথের পরিকল্পনা এই দুটি অঞ্চলকে সংযুক্ত করতে পারে, কিন্তু এখন ট্রাম্প উল্টো বলছেন ফিলিস্তিনিদের গাজা নিয়ে চিরতরে হাল ছেড়ে দিতে।
ট্রাম্প বেসামরিক নাগরিকদের জোরপূর্বক নির্বাসনের পক্ষে কথা বলছেন না বলে মনে হচ্ছে (যা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে), তবে ট্রাম্প স্পষ্টতই ফিলিস্তিনিদের চলে যেতে উৎসাহিত করছেন। এদিকে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তারা হাজার হাজার ক্যারাভ্যানের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, যা গাজাবাসীদের ভূখণ্ডের কম ক্ষতিগ্রস্ত অংশে থাকতে সাহায্য করতে পারত।
অন্যদিকে ট্রাম্প যেসব আরব দেশকে গাজার ১৮ লাখ শরণার্থীকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন, তারা বিশেষ করে মিসর এবং জর্দান এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, বরং ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
গাজার বর্তমান অবস্থা কী?
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক দখলের আগে গাজা ১৯ বছর ধরে মিসরের দখলে ছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, এটি এখনো ইসরায়েলের দখলে বলে বিবেচিত, তবে ইসরায়েল এর বিরোধিতা করে।
এ নিয়ে ইসরায়েলের যুক্তি, ২০০৫ সালে সেই দখলদারির অবসান ঘটেছে। যখন তারা একতরফাভাবে ইহুদি বসতি ভেঙে দিয়েছিল এবং তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তবে বেড়া এবং ইসরায়েলি সামুদ্রিক অবরোধে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন গাজা। এটি কখনো সত্যিকারের স্বাধীন অঞ্চল বলে মনে হয়নি।
ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া গাজাবাসী গাজার ভেতরে বা বাইরে যাতায়াত করতে পারে না। ১৯৯৮ সালে ব্যাপক আন্দোলনের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খোলা হয়েছিল কিন্তু ইসরায়েল সেটাও ধ্বংস করে দেয়। ২০০১ সালে দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সময় ইসরায়েল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি ধ্বংস করে দেয়। জাতিসংঘের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সদস্য গাজাকে সার্বভৌম ফিলিস্তিনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেয়নি।
২০০৬ সালে হামাস ফিলিস্তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। এর পরের বছর তীব্র লড়াই হয় এবং হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বীদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করার পর নিরাপত্তার কারণে ইসরায়েল এবং মিসর গাজার ওপর অবরোধ আরোপ করে। সর্বশেষ যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই ফিলিস্তিনিরা গাজাকে একটি উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল।
ট্রাম্প কি চাইলে গাজা দখল করতে পারবেন?
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ভূখণ্ডের ওপর আমেরিকার কোনো আইনি দাবি নেই। তবে ট্রাম্প কোন আইনে কিভাবে আমেরিকান শাসন এ ভূখণ্ডে চাপিয়ে দিতে চান, তা মোটেও স্পষ্ট নয়।
যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে দুটি প্রধান ফিলিস্তিনি দল হামাস এবং ফাতাহ প্রশাসন তদারকির জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠনে সম্মত হয়েছিল, কিন্তু চুক্তিটি এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। অন্য সময়ে এ আলোচনাগুলো একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী তৈরির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, সম্ভবত তা আরব দেশগুলোর সেনাদের নিয়েই গঠিত হবে।
গত মাসে রয়টার্স জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল গাজায় একটি অস্থায়ী প্রশাসন গঠনের বিষয়ে আলোচনা করেছে। তারা কাজ করবে, যতক্ষণ না একটি সংস্কারকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যেই পশ্চিম তীরের কিছু অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগে প্রকাশ্যে জোর দিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিচালনায় পিএ-এর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
মূলত, আমেরিকান সেনারা ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে। একটি মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা গাজা শহরের দক্ষিণে একটি গুরুত্বপূর্ণ চেকপয়েন্টের তদারকি এবং অস্ত্রের জন্য উত্তরে ফিরে আসা ফিলিস্তিনিদের যানবাহন তল্লাশি করার জন্য প্রায় ১০০ জন সাবেক মার্কিন বিশেষ বাহিনী নিযুক্ত করেছে। একই চেকপয়েন্টে মিসরীয় নিরাপত্তাকর্মীদেরও দেখা গেছে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির কি কোনো প্রভাব থাকতে পারে?
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে দুই সপ্তাহ ধরে চলমান যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সবেমাত্র শুরু হয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পের বোমা ফাটানোর মতো মন্তব্য কিভাবে তা এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে তা বোঝা কঠিন। যদি হামাস মনে করে যে এই পুরো প্রক্রিয়ার শেষ পরিণতি জনশূন্য গাজা, তাহলে ঘটনা কোন দিকে গড়াবে তা বোঝা মুশকিল।
নেতানিয়াহুর সমালোচকরা তাকে আলোচনা ভেঙে দেওয়ার এবং যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার জন্য অজুহাত খুঁজছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তারা এটা মনে করতে পারেন, ট্রাম্পও নেতানিয়াহুর একজন ইচ্ছুক সহযোগী। অন্যদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর ডানপন্থী সমর্থকরা মার্কিন দখল পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যার ফলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগের ঝুঁকি হ্রাস পাবে এবং নেতানিয়াহুর তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরো নিশ্চিত হয়ে উঠবে। এই অর্থে, ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখার জন্য একটি শক্তিশালী প্রণোদনা দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চিম তীর সম্পর্কে কী বলেছেন?
অধিকৃত পশ্চিম তীরের ওপর ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কি একমত, জানতে চাইলে ট্রাম্প উত্তর দেন, তিনি এখনো কোনো চিন্তা করেননি, তবে চার সপ্তাহের মধ্যে তিনি একটি ঘোষণা দেবেন। এই মন্তব্য ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। অনেকে এ ধরনের ঘোষণা অনিবার্যভাবে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কফিনের আরেকটি পেরেক হিসেবে দেখবে।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের বৈধতার স্বীকৃতি দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিষয়টিকে অবৈধ বলে মনে করে, যদিও ইসরায়েল এর বিরোধিতা করে আসছে। পূর্ববর্তী শান্তি আলোচনার সময় আলোচকরা স্বীকার করেছিলেন, ইসরায়েল একটি চূড়ান্ত চুক্তির অংশ হিসেবে বৃহৎ বসতি স্থাপন ধরে রাখতে পারবে, সম্ভবত ইসরায়েলি ভূখণ্ডের ছোট অংশের বিনিময়ে।
সূত্র : বিবিসি