দীর্ঘ নিদ্রার শেষে বাংলার জনসমাজে জাগরণের আভাস মিলতে শুরু করেছিল ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকেই। তার কেন্দ্র ছিল অবিভক্ত বাংলা ও ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা শহরে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট শুধু ইউরোপীয়দের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮০১ সালে এই কলেজে বাংলা বিভাগ খোলা হয়েছিল।
প্রবন্ধ
সেকালের ঢাকার জাগরণের অগ্রদূত
- খন্দকার মাহমুদুল হাসান
অন্যান্য

শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিক্ষেত্রে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের উত্থানপর্বে বেশ কিছু ব্যক্তি ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। ঊনবিংশ শতকে কলকাতা ও ঢাকার সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্যক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল লক্ষ করা যায়।
এখানে আমরা প্রধানত ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কালপর্বের কয়েকজন প্রতিনিধিত্বশীল দিকনির্দেশক ব্যক্তির অবদান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। পশ্চাত্পদ চিন্তা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের পর্বে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের ব্যাপক অংশগ্রহণের দলিল-প্রমাণও মেলে এ থেকে। উল্লেখ্য, ঢাকা পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ আধুনিক বাংলাদেশের প্রধান শহর ছিল। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামাজিক ঘটনাবলির প্রধান কেন্দ্রও ছিল এই শহর। সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দিক পরিবর্তনকারী ঘটনাগুলোও প্রধানত এই শহরকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল।
গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সি
ঊনবিংশ শতকের ঢাকার খুব বিখ্যাতদের একজন ছিলেন গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সি। পরবর্তী বংশধারায় শিক্ষার আলো জ্বালানোর মাধ্যমে উন্নত রুচি ও আধুনিকতার প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তাঁর বংশধারায় সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার দুটি শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। তিনি যেমন ছিলেন ধনী, তেমনি ছিল তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি। আদি নিবাস ছিল মানিকগঞ্জ জেলার বগজুড়ি গ্রামে। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে ছিল বাসভবন। তাঁর বিশাল গোঁফ নিয়ে ঊনবিংশ শতকে ঢাকায় লোকছড়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তাঁর কন্যা রূপলতা দেবীর ছেলে দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ। গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সির ছেলে চন্দ্রমোহন সেন ঢাকা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন বলে জানা যায়। তিনিও বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তাঁর ছেলে হীরালাল সেন ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক। কাজেই গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সি ছিলেন দুই দিগন্তের দুই জ্যোতিষ্ক যথাক্রমে হীরালাল সেনের পিতামহ ও দীনেশচন্দ্র সেনের মাতামহ।
মোহিনী মোহন দাস
ঊনবিংশ শতকের ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মোহিনী মোহন দাস এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষক। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও সবজিমহলের জমিদার হিসেবে তাঁর সামাজিক প্রভাবও অনেক ছিল। ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নাট্যশালা স্থাপনে তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল। তখনো বিশ্ববাসীর কাছে চলচ্চিত্র জিনিসটি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল এবং বেতার-টেলিভিশনের তো প্রশ্নই নেই। সংগীতের আসর এবং নাটক মঞ্চায়ন ছিল মানুষের বিনোদন-পিপাসা নিবারণের উপায়। পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমির সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ১৮৬৫ সালের কথা উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদ আবদুল কাইউম (সূত্র : উনিশ শতকের ঢাকার সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ১৯৯০)।
মুনশি রহমান আলী তায়েশ
বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ মুনশি রহমান আলী তায়েশ (১৮২৩-১৯০৮) ছিলেন ঊনবিংশ শতকের ঢাকার খুব নামকরা মানুষ। তাঁর বাবা মুনশি সুবহান আলী এবং দাদা মুনশি ওয়ারেস আলীও খুবই বিখ্যাত মানুষ ছিলেন।
শহরের লালবাগ দুর্গের সামনের দিকে ছিল মুনশি সুবহান আলীর বাসভবন। মুনশি ওয়ারেস আলী সঙ্গতটোলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তায়েশের জন্ম হয়েছিল বর্তমান পুরান ঢাকার সুপরিচিত স্থান সঙ্গতটোলায় নানার বাড়িতে। মোগল শাসন চলাকালে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি মুনশি ওয়ারেস আলী ঢাকা শহরের শ্বশুরালয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। মুনশি রহমান আলী ছিল মূল নাম, আর তায়েশ ছিল তাঁর ছদ্মনাম। এই নামে তিনি কবিতা লিখতেন এবং খুব জনপ্রিয় কবি ছিলেন। অনেক কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন তিনি। এখনো তাঁর লেখা ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বা ঢাকার ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থটি জনপ্রিয়।
ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দি সোহরাওয়ার্দী
ঢাকা মাদরাসার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক বা অধ্যক্ষ। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মুহসীন ফান্ডের সাহায্য নিয়ে যে তিনটি মাদরাসা স্থাপিত হয়েছিল তার অন্যতম ছিল ঢাকা মাদরাসা। ১৯০৬ সালে এ মাদরাসায় অ্যাংলো-পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট যুক্ত হয়, যা ১৯১৬ থেকে গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল নামে আলাদা প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়। ঢাকা পৌরসভার কমিশনার ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দি সোহরাওয়ার্দী (১৮৩২-৮৫)। তবে এসব ছাড়া তাঁর আরো পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নানা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে গঠিত প্রথম সমিতির নাম ছিল সমাজ সম্মিলনী। এই সমিতির তিনি ছিলেন প্রথম সাধারণ সম্পাদক। তিনি বহু গ্রন্থ লিখেছিলেন। নামকরা কবি ছিলেন। বাংলা, উর্দু, ইংরেজি, আরবি ও ফারসিতে পণ্ডিত ছিলেন (সূত্র : খন্দকার মাহমুদুল হাসান, ঢাকা অভিধান, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ১০৮)।
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার
ঊনবিংশ শতকে ঢাকায় মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের পথ বেয়ে এই শহর থেকে পত্রিকা প্রকাশের সূচনা হয়। শ্রী বঙ্কবিহারী কর ‘পূর্ব্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে (কলকাতা, ১৯৫১, পৃ. ২১, ২২) উল্লেখ করেছেন, ‘১৮৫৭ সালের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে দীনবন্ধু মৌলিক, ব্রজসুন্দর মিত্র, ভগবানচন্দ্র বসু (স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা) প্রভৃতির চেষ্টায় ঢাকায় সর্ব্বপ্রথম একটি বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়।’ ঢাকা থেকে প্রথমে ‘মনোরঞ্জিকা সভা’ ও পরে ‘মনোরঞ্জিকা পত্রিকা’ (১৮৬০) কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের উদ্যোগ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় এবং ঢাকা নরমাল স্কুলের অন্তর্গত মডেল স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন (সূত্র : প্রাগুক্ত, পৃ. ২২)। ১৮৬১ সালে ঢাকার প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকাশ’ প্রকাশিত হলে তার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তিনি। সংস্কৃত-বাংলা মাসিক বৈভাষিকীটি ১৮৮৬ সালে যশোর থেকে বের করেছিলেন। এর সম্পাদকও তিনিই ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপনী’ও প্রায় দেড় বছর ধরে সম্পাদনা করেন তিনি। একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৪-১৯০৭)। খুলনার সেনহাটি গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক নিবাস।
দীননাথ সেন
ঊনবিংশ শতকের ঢাকার শিক্ষা-সংস্কৃতিক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন দীননাথ সেন (১৮৪০-৯৮)। প্রথম ঢাকা সফরকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকার যে তিনটি দর্শনীয় জিনিসের কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে একটি হিসেবে তিনি দীননাথ সেনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বর্তমান গ্লোরিয়া আবাসিক এলাকার পত্তনকারী ও পূর্ববঙ্গের স্কুলগুলোর ডেপুটি ইন্সপেক্টর ছিলেন এবং গ্লোরিয়া রেলস্টেশনে যাওয়ার সড়ক তিনি নিজ খরচে তৈরি করে দিয়েছিলেন (সূত্র : মুনতাসীর মামুন, ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, অনন্যা, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ৬৯, ৭০)। ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর দ্বিতীয় সম্পাদক ছিলেন তিনি। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসুসহ দীননাথ সেন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ পত্রিকাটির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন এবং তাঁরা সবাই ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ছিলেন। ব্রাহ্ম স্কুল, অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি। ‘ব্রাহ্মসমাজ ও পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মমন্দির, অতঃপর স্ত্রী শিক্ষা সভা ও ইডেন স্কুল’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি (সূত্র : খন্দকার মাহমুদুল হাসান, ঢাকা অভিধান, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ২৫৩)।
কালীপ্রসন্ন ঘোষ
প্রবন্ধকার ও বাগ্মী হিসেবে বাংলাজুড়ে খ্যাতি ছিল কালীপ্রসন্ন ঘোষের (১৮৪৩-১৯১০)। বিদ্যাসাগর, রায়বাহাদুর ও আইই উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর’—তাঁর এই পঙিক্তটি আজও সমান সমাদৃত। ঊনবিংশ শতকের ঢাকার খুবই মানসম্পন্ন সাময়িকপত্র ‘বান্ধব’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন সাময়িকপত্রটির সম্পাদক ও প্রকাশক। এই মাসিক পত্রিকাটির মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলনের। পত্রিকাটি প্রথম পর্যায়ে ১১ বছর টিকে থাকার পর প্রকাশনা স্থগিত হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯০২ সাল থেকে পাঁচ বছর টিকে ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বান্ধব’কে ‘উত্কৃষ্ট মাসিক পত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন ঘোষের রচনা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষ্য ছিল—‘ভাষা সুন্দর, চিন্তা অসামান্য’ (ভারতী, বৈশাখ-আশ্বিন, ১৩১৭)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসে বলেছিলেন, ‘ঢাকার দর্শনীয় জিনিস তিনটি। প্রথম মা ঢাকেশ্বরী, এরপর কালীপ্রসন্ন বাবু ও দীননাথ বাবু।’ তাঁর জন্মস্থান ছিল বিক্রমপুরের তারাশঙ্কর গ্রাম। ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতিক্ষেত্রে কালীপ্রসন্ন ঘোষ এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন (সূত্র : খন্দকার মাহমুদুল হাসান, ঢাকা অভিধান, ২০১৪, পৃ. ১৩০, ৩৩৮)।
কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত
কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত (কে জি গুপ্ত) এবং তাঁর বাবা কালী নারায়ণ গুপ্ত—দুজনই ঊনবিংশ শতকের ঢাকার বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। কালী নারায়ণ গুপ্ত ছিলেন ভাবসংগীত রচয়িতা, ‘পূর্ব্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্মসমাজ’-এর অন্যতম ট্রাস্টি, কার্য নির্বাহক সভা, আচার্য এবং ট্রাস্টি (সূত্র : শ্রী বঙ্কবিহারী কর, পূর্ব্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্ত, কলকাতা, ১৯৫১, পৃ. ১৬৩)। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৮৫১ সালে জন্মগ্রহণকারী কে জি গুপ্ত ছিলেন পোগোজ স্কুল ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। তিনি বিলেতে যান ১৮৬৯ সালে। তিনি ব্যারিস্টার হন এবং বাংলাদেশের প্রথম সিভিল অফিসার হন (সূত্র : আপেল মাহমুদ সাথী, পূর্ব্ব বাঙ্গালার প্রথম আইসিএস, দৈনিক সংবাদ, ৬ এপ্রিল, ২০০৫)। তিনি ছিলেন পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদকারী ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের ভাগ্নে এবং বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের মামা।
নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়
এশিয়াবাসীর মধ্যে প্রথম পিএইচডি লাভ করেছিলেন একজন ঢাকাবাসী। ১৮৮২ সালে ইউরোপের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তা অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৮৭৩ সালে ইউরোপে গিয়ে লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয়ও ছিল ঢাকা অঞ্চলের প্রচলিত যাত্রাপালা। তাঁর নাম ছিল নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় (১৮৫২-১৯১০)। কৃষ্ণকমল গোস্বামীর (১৮১০-৮০) ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘বিচিত্রবিলাস’—এই তিনটি যাত্রাপালা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন। তিনি গোটা ইউরোপের মধ্যে প্রথম বাঙালি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ারও গৌরব অর্জন করেছিলেন। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভারতীয় ভাষা বিষয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি মজফফরপুর, মহীশুর ও হায়দরাবাদে অধ্যাপনার পেশায় যুক্ত ছিলেন। নিশিকান্তও ১৮৭০ সালের দিকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর বিশ্বাসে অটল ছিলেন। নিশিকান্তের মেয়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয়েছিল। ১৮৮৩ সালে ভারতে ফেরার পর হায়দরাবাদে থাকাকালে নিশিকান্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন (তথ্যসূত্র : মুনতাসীর মামুন, ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, দ্বিতীয় খণ্ড, অনন্যা, ঢাকা, ২০০৯, পৃ. ১১২-১১৩)।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ও ঢাকার নবাব পরিবার
ঢাকার সর্বকালের অন্যতম সেরা প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৬৬-১৯১৫)। তিনি ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বভারতীয় পর্যায়ের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের শিক্ষা বিস্তার ও জনকল্যাণমূলক বহু কাজের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল এবং তিনি এমন বহু কাজের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তাঁর বাবা নবাব আহসানউল্লাও জীবদ্দশায় ছিলেন ঢাকার একজন প্রধান প্রভাবশালী ব্যক্তি। সলিমুল্লাহ একসময় ঢাকা শহরের ঘটনাবলির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক। তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়। আহসানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা, যেটি এখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। তিনি ছিলেন ঢাকার পঞ্চায়েতের প্রধান। ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ, মজফফরপুর ও ত্রিপুরায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ঢাকায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল কলকাতায়। তাঁর সমাধি ঢাকায়।
ঢাকার নবাব পরিবারের আবাসস্থল আহসান মঞ্জিলে জন্ম হয়েছিল নবাব সলিমুল্লাহর। ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ঢাকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির কেন্দ্র ছিল এই বাড়ি। আধুনিক জল সরবরাহ (১৮৭৮), বিদ্যুৎ সরবরাহ (১৯০১) ব্যবস্থা এই পরিবারের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। ক্রিকেট-হকির মতো আধুনিক খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতাও এই পরিবার করেছিল। লর্ড কার্জনের ঢাকা আগমনকালে (১৯০৪) নবাব সলিমুল্লাহ আধুনিক মোটরগাড়ি আমদানি করেছিলেন। নবাব আহসানউল্লার আমন্ত্রণে জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিজ ক্যাপ ঢাকায় এসে নবাবপুর রোডে ফটোগ্রাফিক স্টুডিও স্থাপন করেছিলেন। সলিমুল্লাহও ছিলেন ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার আজীবন সদস্য। ঢাকার প্রথম পর্যায়ের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর অনেকটির উদ্যোক্তা ছিল নবাব পরিবার। ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎও এই পরিবার। ঢাকায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুকুমারী’ (১৯২৭-২৮) ও প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ নির্মাণের যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন নবাব পরিবারের সদস্যরা। প্রধান অভিনেতাও এই পরিবারের লোকেরাই ছিলেন। এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ অম্বুজ গুপ্ত ছিলেন পরিচালক।
হীরালাল সেন
উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের উকিল চন্দ্রমোহন সেনের ছেলে এবং গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সির পৌত্র। তাঁদের বাড়ি ছিল জিন্দাবাহার লেনে। তবে গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের বগজুড়ি গ্রামে। ১৮৬৬ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল। হীরালালের ভাই মতিলালও ছিলেন উপমহাদেশের অগ্রণী চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। হীরালাল সেনের তৃতীয় সন্তান প্রতিভা সেনের স্বামী নরনাথ সেন ছিলেন বিখ্যাত চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেনের শ্বশুর আদিনাথ সেনের ছোট ভাই। প্রতিভা সেনের ডাকনাম ছিল তিথি এবং তিনি সুচিত্রা সেনের খুড়তুতো শাশুড়ি (সূত্র : বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাস : ১৮৯৭ থেকে ১৯৪৭, প্রথম সংস্করণ, ১৯৬৩, নবরূপে পত্রভারতী সংস্করণ, ২০১২, কলকাতা, পৃ. ৮১)। অর্থাৎ হীরালাল সেন ছিলেন সুচিত্রা সেনের এই শাশুড়ির বাবা। হীরালাল সেন কাহিনিচিত্র, সংবাদচিত্র, তথ্যচিত্র, প্রচারচিত্র প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। ঢাকায় তিনি চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণ এবং চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করেছিলেন।
দীনেশচন্দ্র সেন
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কৃতী সন্তানদের একজন ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯)। তাঁর মাতামহ ছিলেন ঢাকা শহরের জিন্দাবাহার লেনের বাসিন্দা গোকুল কৃষ্ণ সেন মুন্সি। দীনেশচন্দ্র সেনের আপন মামাতো ভাই ও ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। দীনেশচন্দ্রের বাবা ঈশ্বরচন্দ্র সেন মানিকগঞ্জ শহরে থাকতেন, আইনজীবী ছিলেন। তবে গ্রামের বাড়ি ছিল সুয়াপুরে। দীনেশচন্দ্রের শিক্ষাজীবনের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে ঢাকা শহরে। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, যে বিদ্যালয়টি ১৮৩৫ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল নামে যাত্রা শুরু করেছিল। এটিই ছিল উপমহাদেশের প্রথম সরকারি ইংরেজি স্কুল। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন পুঁথি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে তাঁর লেখা ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ নামের অমর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার’ (১৯১১), ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়’ (১৯১৪), ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’, (১৯২৩), ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ (১৯২৬) ও ‘বৃহত্বঙ্গ’ (১৯৩৫) তাঁর অমর কীর্তি।
অতুলপ্রসাদ সেন
পঞ্চকবির অন্যতম এবং বাংলা গানে ঠুমরির প্রবর্তক অতুলপ্রসাদ সেনের (১৮৭১-১৯৩৪) জন্ম হয়েছিল ঢাকা শহরে। পৈতৃক নিবাস শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার মগর গ্রামে হলেও ঢাকায় নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম হয়। খুব ছোট থাকতেই তাঁর বাবা মারা যান এবং নানা কালীনারায়ণ গুপ্ত তাঁকে লালন-পালন করেন। মাতামহ ছিলেন ভাবসংগীত রচয়িতা। এই সংগীত প্রতিভার নিবিড় সংস্পর্শ শৈশব থেকেই তাঁকে সংগীতমুখী ও ভগবদ্ভক্ত করে তোলে। তিনি ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডনে লেখাপড়া করেন এবং ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসেন ১৮৯৪ সালে। তিনি এক আলোকিত পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। দেশাত্মবোধক, প্রেমবিষয়ক ও ভাব-ভক্তিমূলক গান তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাঁর গান মাত্র ২০৬টি (সূত্র : বাংলাপিডিয়া)। ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’ এবং ‘দেখ মা এবার দুয়ার খুলে/গলে গলে এল মা/তোর হিন্দু মুসলমান দু ছেলে’ গান দুটি তাঁরই লেখা। সংগীতে সুর ও বাণীর কারণে তিনি অমরত্ব পেয়ে পঞ্চকবির (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্ত সেন) অন্যতম হিসেবে বাঙালির মনে ঠাঁই পেয়েছেন।
আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী
ঢাকা শহরের রায়সাহেব বাজার মহল্লায় জন্ম হয়েছিল আব্দুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দীর (১৮৭৭-১৯৩৫)। তিনি ছিলেন ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দির চতুর্থ সন্তান এবং বাংলাদেশের জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মামা। ঢাকা মাদরাসা ও ঢাকা কলেজের এই কৃতী ছাত্র ১৮৯৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তিনি লন্ডনে লেখাপড়া করেছিলেন এবং ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনকল্পে যে সভা হয়েছিল তাতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ফারসি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হাবলুল মতিন’-এর ইংরেজি সংস্করণের তিনি সম্পাদক ছিলেন।
হাকিম হাবিবুর রহমান
জ্ঞানতাপস হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭) ঢাকা জাদুঘর (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু গুণের অধিকারী ছিলেন। বাংলা ও আসাম প্রদেশের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক ইউনানি চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্র তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ। চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ঢাকার ইতিহাস ও পুরাকীর্তি বিষয়ক বহু মূল্যবান গ্রন্থের তিনি প্রণেতা। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, কবি, পত্রিকার সম্পাদক, বহুভাষাবিদ, প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রাহকসহ আরো অনেক কিছু। উর্দু মাসিক ‘আল মাশরিক’ সম্পাদনা করেছিলেন তিনি (১৯০৬)। খাজা মোহাম্মদ আদেলসহ তিনি উর্দু মাসিক পত্রিকা ‘জাদু’ বের করেন (১৯২৩)। ১৯০৬ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সভায় তিনি যোগ দেন। ১৯০৮ সালে গঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হয়েছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ এবং তিনি ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক।
নলিনীকান্ত ভট্টশালী
ঢাকা জাদুঘরের (বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডক্টর নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮-১৯৪৭)। তিনি প্রাচীন মুদ্রা ও মূর্তিতত্ত্বে মহাপণ্ডিত ছিলেন। উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ন পরিচয় বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচনে তাঁর পথিকৃৎ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। বিক্রমপুর, সাভারসহ একাধিক প্রত্নস্থলের প্রত্নসামগ্রীকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। ‘Coins and Choronology of Early Independent Sultans of Bengal’ এবং ‘Inconography of Buddhist and Brahmanical Sculpture in Dacca Museum’ এই গ্রন্থ দুটি তাঁর অমর কীর্তি। তিনি ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর (১৯১৪-৪৭) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও বাংলা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ অনুবাদ করেছিলেন তিনি। এই বিখ্যাত ইতিহাসবিদ গল্প-নাটিকাও রচনা করেছিলেন। বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জ জেলার) টঙ্গিবাড়ী উপজেলার পাইকপাড়ায় জন্ম হয়েছিল তাঁর।
আবুল হুসেন
ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর জনমানসে আধুনিকতার সঞ্চার ও প্রসারে যাঁরা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮)। তাঁর জন্মস্থান ছিল যশোরের পানিসারা গ্রাম, আর মৃত্যু হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ছিলেন তিনি। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনসমাজে আধুনিকতার সঞ্চার ও কুসংস্কারমুক্তির বাণী পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম সাহিত্য সমাজের (১৯২৬) বিরাট ভূমিকা ছিল। এই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তিনি তারও পথিকৃৎ ছিলেন।
লীলা নাগ
বিপ্লবী নারী নেত্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন লীলা নাগ (১৯০০-৭০)। স্বাধীনতা ও সাম্যের সংগ্রাম এবং নারীশিক্ষার বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ঢাকার এই অবিস্মরণীয় নারী। তাঁর সহযোদ্ধা এবং স্বামী অনিল রায় ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত বিপ্লবী। শ্রীসংঘের এই নেতা ১৯৫২ সালে কলকাতায় ক্যান্সারে মারা যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে যে দুজন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন লীলা নাগ, অন্যজন সুষমা সেনগুপ্তা। ঢাকার বকশীবাজারে তাঁর বাবা সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা গিরীশচন্দ্র নাগের বাড়ি ছিল। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের বাসিন্দা। তিনি বেথুন কলেজে অধ্যয়নকালে ইংরেজিতে অনার্সে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকার গুপ্ত সংগঠনের (শ্রীসংঘ) প্রথম নারী নেত্রী। তিনি ছিলেন গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বিনা বিচারে আটক (১৯৩১-৩৭) নারী। সাতচল্লিশ-পরবর্তী ঢাকায় শরণার্থী পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তিনি সোচ্চার ছিলেন (১. সম্পাদনা : অজয় রায়, লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৩; ২. খন্দকার মাহমুদুল হাসান, ঢাকা অভিধান, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৪৪৭)। কিন্তু ১৯৫১ সালে তিনি দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন।
সোমেন চন্দ
মার্ক্সীয় আদর্শে উজ্জীবিত গল্পকার সোমেন চন্দ (১৯২০-৪২) ঢাকার প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা শহরে ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি আত্মদান করেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। ‘বনস্পতি’ ও ‘ইঁদুর’ তাঁর লেখা দুটি বিখ্যাত গল্প। তিনি পোগোজ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৯৩৬) পাসের পর ঢাকার মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হয়েও খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। তাঁর আত্মদানের ঘটনা এবং লেখা গল্পগুলো ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গে প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তারে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছিল।
ঢাকায় আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জন্মেছেন, খ্যাতিমান হয়েছেন, পূর্ববঙ্গের সমাজ-সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছেন। এখানে শুধু রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো, শিকড় জানার জন্য যেটুকু খুব দরকার।
সম্পর্কিত খবর