গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেগবান করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে দেশের ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো (এনজিও)। ব্যাংকগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছতে না পারা এবং ঋণের নানা শর্তের কারণে সুদের হার কিছুটা বেশি হলেও গ্রামে এখনো এনজিওগুলোই বেশি জনপ্রিয়। আগে যেখানে একটি গ্রামে দু-একটির বেশি এনজিও ছিল না, সেখানে বর্তমানে দেশের গ্রামগুলোতে গড়ে পাঁচ-ছয়টি করে এনজিও রয়েছে। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বেশি হওয়ায় সুদের হারও কম হচ্ছে।
গ্রামের মহাজনের অতিসুদের চাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিআইডিএস কনফারেন্সরুমে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে ‘ক্ষুদ্রঋণ প্রতিযোগিতা এবং মহাজনদের উপস্থিতি : তত্ত্ব এবং প্রমাণ’ শীর্ষক গবেষণাটি তুলে ধরেন অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক শ্যামল চৌধুরী।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. কাজী ইকবাল।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের কারণে গ্রামের মহাজনের কাছ থেকে অতিসুদে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা প্রায় ৩৩ শতাংশ কমে গেছে। গ্রামগুলোতে নতুন নতুন এনজিও আসায় সুদের হারও ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। বর্তমানে দেশের গ্রামগুলোতে পাঁচ-ছয়টি করে এনজিও রয়েছে।
যার ফলে গ্রামের মহাজন বা দাদনদাতাদের কাছ থেকে অতিসুদে ঋণ কমে যাচ্ছে। মহাজনের ঋণের গড় সুদের হার ১৪৫ শতাংশ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে অধ্যাপক শ্যামল চৌধুরী বলেন, ‘অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা যখন শুরু করেছিল, তখন তাঁর ইচ্ছাই ছিল যে মহাজনের কাছে যাতে মানুষ আর ঋণ নিতে না যায়। কারণ তাদের সুদের হার অনেক বেশি। এনজিওগুলো যখন গ্রামে যাওয়া শুরু করেছে, তখন থেকে মহাজনদের দেওয়া ঋণের পরিমাণ কমছে।
একটি গ্রামে যদি একটি এনজিও বাড়ে, তবে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ২৫ শতাংশ কমে যায়।’
তিনি বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ ও সিলেটের চার জেলার ১৫০টি গ্রামে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এসব এলাকায় অনেক ব্যাংক হয়েছে। তার পরও মহাজনরা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ আসছে ২০-৩০ শতাংশ। তবে গ্রামের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ এজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে এখনো ৫ শতাংশের কম। কারণ ব্যাংকগুলো এখনো সেভাবে পৌঁছেনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাজারে মহাজন থাকবে কি না তা নির্ভর করছে মহাজনের ঋণের চাহিদার ওপর। চাহিদা থাকলে মহাজনও থাকবে। কারণ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে মহাজনের কাছে এখনো মানুষ যাচ্ছে।’
শ্যামল চৌধুরী বলেন, ‘উৎপাদনশীল খাতের ঋণ আসছে এনজিওদের কাছ থেকে। যেমন—কৃষিজমি বা খাদ্যশস্য বন্ধক দিয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু অন্য কোনো কারণে হঠাৎ করে ঋণের দরকার পড়ছে, তখন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংক থেকে এনজিওরা সুদ বেশি নেয়। আমাদের এখানে মহাজনের গড় সুদের হার ১৪৫ শতাংশ, এনজিওর সুদের হার ২৪ থেকে ২৮ শতাংশ।’
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কাজী ইকবাল বলেন, ‘মহাজনরা একদিকে উচ্চ সুদ নিলেও অন্যদিকে দ্রুত ঋণ দিতে পারে, যা এখনো গ্রামীণ অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এনজিওর সংখ্যা বাড়ার ফলে এই প্রবণতা কমে আসছে।’
পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘এমএফআই ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ বিতরণে সময়সীমা নিয়ে যে অমিল রয়েছে, তা অনেক সময় গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য বাধ্য করে।’