ইরিনা হানদোনো ইন্দোনেশিয়ার সুপরিচিত নওমুসলিম। ১৯৮৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। বর্তমানে একজন ইসলাম প্রচারক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। নওমুসলিমদের জন্য ইরিনা সেন্টার নামে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন এই নারী।
নওমুসলিমের কথা
সুরা ইখলাস পড়ে মুসলিম হই
—সিস্টার ইরিনা

আমি ইন্দোনেশিয়ার একটি ধার্মিক খ্রিস্টান পরিবারে বেড়ে উঠি। আমি প্রাচুর্যের ভেতরই বড় হয়েছি। আমার পরিবার ছিল ধনী। তারা আমার শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে সব করেছে।
খুব ছোট থেকে আমি ধর্মীয় অনুপ্রেরণা লাভ করি। আমি স্রষ্টার জন্য জীবন উৎসর্গ করার ইচ্ছা পোষণ করতাম। কিশোর বয়সে স্থানীয় চার্চের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতাম। একজন নান হওয়ার প্রবল স্বপ্ন ছিল আমার। একজন ক্যাথলিক হিসেবে জাগতিক জীবন চার্চে কাটাতে চাইতাম, যেখানে সবাই ভালো কাজ করে।
একজন শিক্ষানবিশ নান হিসেবে আমি কাজ শুরু করি। এ জন্য আমাকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। তবে চার্চের বাইরে বিশেষ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়েছিল। সেখানে ধর্ম-দর্শন বোঝার জন্য তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হয়। আমি এ সময় ইসলাম ধর্মের তাত্ত্বিক আলোচনায় মনোযোগী হলাম। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার দেশে জন্মালেও এটিই ছিল ইসলাম সম্পর্কে আমার প্রথম জ্ঞানার্জন। চার্চের সেই প্রশিক্ষণে আমি ইসলাম সম্পর্কে কিছু কুসংস্কারের চর্চা দেখতে পাই, যা আমি খ্রিস্টসমাজে আগেও দেখেছিলাম। মুসলিমরা দরিদ্র, অশিক্ষিত, অসভ্য ইত্যাদি। অবশ্য আমার ২০ বছর বয়সে আমি এসব কুসংস্কার কখনো গ্রহণ করিনি, বরং নিজে বিচার-বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি।
আমি অন্যান্য দেশ সম্পর্কে অধ্যয়ন শুরু করলাম। বিশেষত অমুসলিম দেশ সম্পর্কে। আমি দেখলাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দারিদ্র্যের শিকার আরো অনেক দেশ আছে। যেমন—ভারত, চীন, ফিলিপাইন, ইতালি (তখন) এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ। আমি আমার শিক্ষকের কাছে ইসলাম সম্পর্কে পড়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। আমার অধ্যয়নের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের ত্রুটিবিচ্যুতি ও দুর্বলতা খুঁজে বের করা। আমার মিশন শুরু হলো। আমি কোরআন নিয়ে বসলাম এবং এমন সব বিষয় অনুসন্ধান শুরু করলাম, যা ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারব। আমি তখনো জানি না, কোরআন ডান দিক থেকে পড়তে হয়। অন্যান্য বইয়ের মতো বাঁ দিক থেকে পড়তে লাগলাম। প্রথমেই আমার চোখে পড়ল—‘বলুন! তিনি আল্লাহ। তিনি এক। তিনি অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারো থেকে জন্ম নেননি। কেউ তাঁর সমকক্ষ নয়।’ (সুরা : ইখলাস)
কোরআনের এই সুরা পড়ে মুগ্ধ হলাম। আমার অন্তর সাক্ষ্য দিল আল্লাহ এক। স্রষ্টার কোনো সন্তান নেই। তিনি কারো সৃষ্টি নন। কোনো কিছুই তাঁর সমকক্ষ নয়। সুরা ইখলাস পাঠ করার পর একজন যাজকের কাছে স্রষ্টায় বিশ্বাসের মূলকথা কী জানতে চাইলাম। তাঁকে বললাম, আমি বুঝছি না একজন ঈশ্বর একই সময়ে একজন ও তিনজন কিভাবে হয়? তিনি বললেন, স্রষ্টা মূলত একজন। তবে তাঁর তিনটি প্রকাশ বা ব্যক্তিত্ব রয়েছে। ঈশ্বর যিনি পিতা, ঈশ্বর যিনি পুত্র, ঈশ্বর যিনি পবিত্র আত্মা। এটিকেই ত্রিত্ববাদ বলা হয়। তাঁর ব্যাখ্যা আমি গ্রহণ করলাম। কিন্তু রাতে সুরা ইখলাসের বক্তব্যগুলো আমার চিন্তায় উঁকি দিতে থাকে। স্রষ্টা একজন। তিনি কারো সৃষ্টি নন। কেউ তাঁর সন্তান নয়।
পরদিন সকালে আমি আবারও আমার শিক্ষকের কাছে গেলাম। তাঁকে বললাম, ত্রিত্ববাদের ধারণাটি আমার বুঝে আসছে না। তিনি আমাকে একটি বোর্ডের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি ত্রিভুজ এঁকে বললেন, এখানে ত্রিভুজ একটি। কিন্তু তার দিক বা বাহু তিনটি। ত্রিত্ববাদের ধারণাটিও ঠিক তেমন। তাঁর বক্তব্যের পর আমি বললাম, তাহলে তো এটিও সম্ভব আমাদের প্রভুর চারটি দিক বা বাহু থাকবে। তিনি বললেন, তা সম্ভব নয়। আমি জানতে চাইলাম কেন? তিনি অধৈর্য হলেন। বারবার বলতে লাগলেন, সেটি সম্ভব নয়। অন্যদিকে আমি প্রশ্ন করেই গেলাম। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ত্রিত্ববাদের এই ধারণা আমি গ্রহণ করেছি। তবে তা আমার বুঝে আসে না। তুমিও এটি মেনে নাও, হজম করো। বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা পাপ। কিন্তু আমি হজম করতে পারলাম না। রাতে আবারও কোরআনের কাছে ফিরে এলাম। সুরা ইখলাস পাঠ করলাম, যেন কিছু আমার অন্তরে প্রবেশ করল। আমার কোনো সংশয় রইল না আল্লাহ এক। আমার ব্যক্তিগত চিন্তা ও গবেষণা থেকে বুঝতে পারলাম ত্রিত্ববাদের ধারণা মানুষের তৈরি, যার উদ্ভব হয়েছে ৩২৫ খ্রিস্টাব্দের পর। আগে তা ছিল না। বিষয়টি আমার ক্যাথলিক পরিচয়কেই বোঝা করে তুলল।
এরপর মুসলিম হতে এবং নতুন ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে আমার ছয় বছর লেগেছিল। যখন আমি ইসলাম গ্রহণের আবেদন করলাম, ধর্মীয় পণ্ডিত জানতে চাইলেন আমি কি পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত? তিনি বললেন, ইসলাম গ্রহণ করা সহজ। কিন্তু পরবর্তী জীবনে বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। আমি প্রস্তুত ছিলাম। নিজেকে রক্ষা করার, নিজের আত্মাকে রক্ষা করার অধিকার আমার ছিল। অমূলক কোনো মতবাদ নিয়ে পড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইসলাম গ্রহণের পর আমি আমার পরিবার ও সম্পদ হারাই। আমি একা হয়ে যাই। পরিস্থিতি খুব ভালো ছিল না। তবে আল্লাহ আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার আশ্রয়, একমাত্র আশ্রয়।
একজন নতুন মুসলিম হিসেবে আমি আমার করণীয় সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতাম, রমজানে রোজা রাখতাম এবং হিজাব পরতাম। আগেও আমার জীবন ছিল স্রষ্টার জন্য উৎসর্গিত। এখনো আমার জীবন আল্লাহর জন্য নিবেদিত। আলহামদুলিল্লাহ! আমার জীবন শুধু আল্লাহর জন্য।
ভাষান্তর : আবরার আবদুল্লাহ
সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা
- পর্ব, ৭৪২

আয়াতের অর্থ : ‘রাসুলকে আহ্বান করাকে তোমরা তোমাদের পরস্পরের প্রতি আহ্বানের মতো গণ্য কোরো না; তোমাদের মধ্যে যারা অলক্ষ্যে সরে পড়ে আল্লাহ তাদেরকে জানেন। সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা সতর্ক হোক যে বিপর্যয় তাদের ওপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর মর্মন্তুদ শাস্তি। জেনে রাখো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই। তোমরা যাতে ব্যাপৃত তিনি তা জানেন।
(সুরা : নুর, আয়াত : ৬৩-৬৪)
আয়াতদ্বয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. এ বিষয়ে সর্বযুগের সব আলেম একমত যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। আর তাঁর সম্মান হানি করা হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২. স্মরণ ও সম্বোধনে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক।
৩. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নাম ধরে সম্বোধন করা শিষ্টাচার পরিপন্থী। উত্তম হলো তাঁকে আল্লাহর নবী, আল্লাহর রাসুল বা তাঁর উপনাম আবুল কাসেম দ্বারা সম্বোধন করা।
৪. আল্লামা আলুসি (রহ.) বলেন, উম্মতের জন্য নবীরা যেমন, কোনো গোত্রের জন্য আলেমরাও তেমন। তাই তাঁদের সম্মান করা সাধারণ মানুষের জন্য আবশ্যক।
৫. একইভাবে সন্তান মা-বাবাকে, শিক্ষার্থী শিক্ষককে, ছোট বড়কে স্মরণ ও সম্বোধনে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে।
(আল কোরআন তাদাব্বুর ওয়াল আমল : ১৮/১৯)

আল্লাহর জন্য জান-মাল উৎসর্গের পুরস্কার
সাআদ তাশফিন

আল্লাহর জন্য যেকোনো কিছু ত্যাগ করার মানসিকতা ঈমানের পরিচায়ক। মুমিন তার জীবন, সময়, সম্পদ সব কিছু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিতে ভালোবাসে। মহান আল্লাহ তাঁর ত্যাগী বান্দাদের ভালোবাসেন। কখনো কখনো তিনি তাঁর বান্দাদের ওপর ত্যাগকে ফরজ করে দেন।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে কোরো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তাদেরকে রিজিক দেওয়া হয়।
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৯)
সুবহানাল্লাহ, তবে এত বড় পুরস্কার পাওয়ার জন্য মানুষের নিয়তও বিশুদ্ধ হতে হবে। লড়াইটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, মনগড়া পদ্ধতি কিংবা নিজের প্রভাব বিস্তার, সুনাম, সুখ্যাতির জন্য নয়। আবু মূসা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে যুদ্ধ কোনটি, কেননা আমাদের কেউ লড়াই করে রাগের বশবর্তী হয়ে, আবার কেউ লড়াই করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তিনি তার দিকে মাথা তুলে তাকালেন।
(বুখারি, হাদিস : ১২৩)
এমনিভাবে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পদ ব্যয় করে, মহান আল্লাহ তাদের বহুগুণে নিয়ামত বাড়িয়ে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছ না? অথচ আসমানসমূহ ও জমিনের উত্তরাধিকারতো আল্লাহরই? তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে।
উল্লেখ্য, কোরআনের অন্যান্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা লড়াই ছাড়াও দ্বিনের অন্যান্য কাজে ব্যয় করা, অভাবীর পাশে দাঁড়ানো, মুসাফিরের সহযোগিতা করা, পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা ইত্যাদিকেও আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ উৎসর্গ হিসেবে গণনা করা হয়। তাই আমাদের উচিত আমাদের জান-মালকে বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার মানসিকতা সৃষ্টি করা।

উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

৬৫৬ হিজরি মোতাবেক ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আরতুগ্রুলের ছেলে উসমানের জন্ম হয়। তাঁর দিকেই উসমানি সাম্রাজ্যের সম্বোধন করা হয়। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেন, সে বছরই মঙ্গোলীয়রা হালাকু খাঁর নেতৃত্বে আব্বাসি খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে আক্রমণ করে। এটি ছিল মর্মান্তিক একটি দুর্যোগ।
উম্মাহর সেই কঠিন ও দুর্যোগময় সময়ে উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের জন্ম হয়।
প্রথম উসমানের নেতৃত্বসুলভ গুণ
প্রথম উসমানের জীবন নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের সামনে তার ব্যক্তিত্বের কয়েকটি গুণ ভেসে ওঠে। যেমন—তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি, বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
বীরত্ব : ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের বুরুসা, মাদানুস, আদ্রানুস, কাত্তাহ, কাস্তালাহ প্রভৃতি অঞ্চলের খ্রিস্টান রাজারা উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান বিন আরতুগ্রুলের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ডাক দেয়। খ্রিস্টানরা এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দেয় এবং এই উঠতি সালতানাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ গ্রহণ করে। উসমান তাঁর সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে যান। যুদ্ধের ময়দানে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে তিনি ক্রুসেড যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাঁর বীরত্ব উসমানিদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে যায়। (জাওয়ানিবুল মুক্তিনগ্রাহ ফি তারিখিল উসমানিধিনাল আতরাক, পৃষ্ঠা-১৯৭)
হিকমত বা প্রজ্ঞা : স্বীয় গোত্রের নেতৃত্ব হাতে নেওয়ার পর তিনি ভেবে দেখলেন, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অবস্থান করা বুদ্ধির কাজ হবে। তাই তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও দুর্গ জয়ে সুলতানকে সাহায্য করেন। এর ফলে তিনি রোমের সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিনের দরবারে আমির হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।
(কিয়ামুদ দাওলাতিল উসমানিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২৫)
ঈমানি জজবা : বুরুসার অধিপতি ইকরিনুসের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর এই গুণের কথা জানা যায়। যুদ্ধ শেষে ইকরিনুস ইসলাম গ্রহণ করেন। সুলতান উসমান তাঁকে ‘বেক’ উপাধি প্রদান করেন। এরপর তিনি উসমানি সালতানাতের প্রথম সারির সেনাপতিদের কাতারে পৌঁছে যান। অনেক কনস্টান্টিনোপলিয়ান সেনাপতি উসমানের ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁরা উসমানের দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুকরণ করে উসমানি সালতানাতকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তখন অনেক মুসলিম সৈন্যদল উসমানি সালতানাতের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ছিল গাজিয়ারোম অর্থাৎ রোমের একদল যোদ্ধা। তারা আব্বাসীয় খিলাফতের সময় থেকে রোম সীমান্তে একতাবদ্ধভাবে অবস্থান করত এবং মুসলিমদের ওপর রোমীয়দের আক্রমণ প্রতিহত করত।
আরেক দল ছিল ইখওয়ান অর্থাৎ ভাইদের দল। তারা মুসলিমদের সাহায্য করত এবং যোদ্ধাদের সেবা করার জন্য সৈন্যদলের সঙ্গে অবস্থান করত।
আরেক দল ছিল হাজিয়াতে রোম অর্থাৎ রোমের হাজিদের কাফেলা। ইসলামী ফিকহ নিয়ে কাজ করত আরেকটি দল। তারা শরিয়তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণা করত।
(আত তারাজুযুল হাজারি ফিল আলামিল ইসলামি, ড. আলি আবদুল হালিম, পৃষ্ঠা-৩৩১-৩৩২)
ন্যায়পরায়ণতা : তুর্কি ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ৬৮৩ হিজরি মোতাবেক ১২৮৫ হিজরিতে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের কাছ থেকে কুরুহজাহ দুর্গ জয় করার পর আরতুগ্রুল তাঁর ছেলে উসমানের হাতে সে অঞ্চলের শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন। তখন উসমান তুর্কি মুসলিমদের বিপরীতে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের শাসন করেছিলেন। এতে অভিভূত হয়ে এক খ্রিস্টান উসমানকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিভাবে আপনি আমাদের কল্যাণ সাধন করেন, অথচ আমরা আপনার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী?
উসমান জবাব দিয়েছিলেন, আমি কেন তোমাদের কল্যাণ কামনা করব না! আমরা তো আল্লাহর ইবাদত করি। তিনি আমাদের বলেছেন—‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার হকদারের কাছে পৌঁছে দাও এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসন করো।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
তাঁর এই ন্যায়পরায়ণতার কারণে লোকটি তার গোত্রসহ ইসলাম গ্রহণ করে। (জাওয়ানির মুক্তিয্যাজ, পৃষ্ঠা-৩৩)

ইসলামে মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর গুরুত্ব
মাইমুনা আক্তার

মুসলমান মুসলমানের ভাই। নবীজি (সা.) তাদের উপমা দিয়েছেন এক দেহের সঙ্গে। অর্থাৎ দেহের কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন সারা দেহ জ্বরে আক্রান্ত হয়, তেমনি গোটা মুসলিম উম্মাহও তাদের কোনো মুসলিম ভাইয়ের বিপদে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। ইসলামের প্রতি মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের কিছু হক আছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হক হলো, তাকে জালিমের হাত থেকে রক্ষা করা।
তাই কোনো মুসলিম যেমন তার অন্য কোনো মুসলিম ভাইয়ের ওপর জুলুম করতে পারে না, তেমনি তাকে কোনো শত্রুর হাতে জুলুমের শিকার হতে দেখে বসে থাকতে পারে না। ঈমানের দাবি হলো, নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো। তাকে জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। কেননা নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান একজন অন্যজনের ভাই।
দোষত্রুটি যে লোক গোপন করে রাখে আল্লাহ তাআলা কিয়ামত দিবসে তার দোষত্রুটি গোপন করে রাখবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৪২৬)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ও আবু ত্বালহা ইবনু সাহল আল-আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের মান-ইজ্জত নষ্ট হওয়ার স্থানে তাকে ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করা হতে বিমুখ থাকবেন, যেখানে সে তাঁর সাহায্য কামনা করে।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রয়োজনে মজলুমকে রক্ষায় জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আর তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী।” (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭৫)
জুলুমের শিকার মজলুমরা যেমন মহান আল্লাহর কাছে ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়, তেমনি তখন তাদের অপর মুসলিম ভাইরাও পরীক্ষায় থাকে, তারা তাদের মুসলিম ভাইদের সহযোগিতায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে আল্লাহ তা দেখেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে লোক সব! তোমরা তো অবশ্যই এই আয়াত তিলাওয়াত করে থাকো : ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের নিজেদেরই কর্তব্য তোমাদেরকে সংশোধন করা। যদি তোমরা সৎপথে থাকো তাহলে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা তোমাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১০৫) অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, মানুষ যদি কোনো অত্যাচারীকে অত্যাচারে লিপ্ত দেখেও তার দুহাত চেপে ধরে তাকে প্রতিহত না করে তাহলে আল্লাহ তাআলা অতি শিগগিরই তাদের সবাইকে তাঁর ব্যাপক শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত করবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৮)
নাউজুবিল্লাহ, অতএব, প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব নিজের সবটুকু নিয়ে মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রাখা এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মজলুমের পক্ষে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।